ড. মইনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম নগরী বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাশের বেশ কয়েক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। চট্টগ্রাম বন্দরও কর্ণফুলী নদীর উত্তর পারে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এলাকায় অবস্থিত। অথচ নদীর স্বাভাবিক খাঁড়ি নদীর দক্ষিণ পাড়সংলগ্ন জলধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উল্টো দিকে নদীর জলপ্রবাহের সঙ্গে আসা পলিমাটি জমা হওয়াই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
তাই উত্তর পাড়ের বন্দরের জেটিগুলোর নাব্যতা সংরক্ষণের জন্য প্রতিবছর খননকাজ চালাতে হয়, কয়েক বছর পরপর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, প্রায় ১ হাজার ৩০০ বছর আগে যখন চট্টগ্রাম নৌবন্দর গড়ে উঠেছিল, তখন প্রধানত কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়েই বন্দরের অবস্থান ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে যখন আধুনিক বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তখন তদানীন্তন ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ সহজে ও সুলভে প্রতিষ্ঠার যুক্তিতে বন্দরের জেটিগুলো নদীর উত্তর পাড়েই নির্মাণ করা হয়, যার ফলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাণিজ্যকেন্দ্র এবং আবাসিক এলাকাগুলোও ওই বন্দরকে ঘিরে গড়ে ওঠে। চট্টগ্রাম বন্দরও কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে সম্প্রসারিত হয়নি, যেহেতু বন্দরের অবস্থানের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা থেকে কর্ণফুলী নদীর মোহনা পর্যন্ত নদীতে কোনো সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই। নব্বইয়ের দশকে বাকলিয়ায় সেতু নির্মাণের আগে শুধু জলপথেই ওই এলাকার জনগণ চট্টগ্রাম শহরে আসতে পারত। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী এখনো চট্টগ্রামের সবচেয়ে অনুন্নত দুটি উপজেলা রয়ে গেছে, যদিও আকাশপথে এ দুটি উপজেলা চট্টগ্রাম নগরী থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী এলাকা।
গত ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দুটি টিউবের একটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়া উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিলেন। দুই লেনের এই টিউব জানুয়ারি মাসে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পুরো কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় কর্ণফুলী টানেলই হবে নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল। আমি এই প্রকল্পের একজন বড় সমর্থক। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে এই টানেলের সুদূরপ্রসারী ও বহুল বিস্তৃত ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী উপকার সাধন করবে। অবশ্য এটাও বলা প্রয়োজন, প্রাথমিকভাবে কয়েক বছর টানেলটি স্বল্প ব্যবহৃত থাকবে। সে জন্য সাধারণ জনগণের কাছে এই প্রকল্পকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল মনে হওয়াই স্বাভাবিক। টানেলটি নির্মাণের জন্য মোট ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, যে ঋণ পরিশোধের বার্ষিক কিস্তি ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশের জন্য বোঝা হিসেবে চেপে বসবে।
টানেল নির্মাণের কাজে যে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তারাও কয়েকবার প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে নিয়েছে। মনে হতে পারে যে টানেলটি বাংলাদেশের আরেকটি ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পেরই নজির। কারণ, প্রথম কয়েক বছর এই টানেল স্বল্প ব্যবহৃত (আন্ডার-ইউটিলাইজড) সড়কপথ হিসেবে থেকে গেলে এর টোলের আয় থেকে ঋণের বার্ষিক কিস্তির অর্থ পরিশোধ করা যাবে না।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওপরে উল্লিখিত বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতেই হবে। বাকলিয়ায় শাহ আমানত সেতুর যেখানে অবস্থান, সেখান থেকে কর্ণফুলী নদীর ভাটি অঞ্চলের ২০ কিলোমিটারে আর কোনো সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানের কারণে। অতএব, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের পটিয়া ও আনোয়ারা হয়ে সাঙ্গু নদীর দক্ষিণে অবস্থিত বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজারের অন্যান্য এলাকায় চট্টগ্রাম নগরী থেকে সড়কপথে যাতায়াতের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার কমে যাচ্ছে এই ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে। নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধু টানেল এতদঞ্চলের এই সীমাবদ্ধতাগুলো চিরতরে দূর করে দেবে। অবিলম্বে নগর-পরিকল্পনা গ্রহণ করলে কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রাম নগরীকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনস’-এ পরিণত করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে।
টানেল নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শিল্পায়ন, আবাসন ও বাণিজ্য উন্নয়নের প্রধান বাধাগুলো আর না থাকায় অঞ্চলজুড়ে দ্রুত উন্নয়ন ও শিল্পায়নযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে। উপরন্তু, চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকটি জেটি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে নির্মাণের সুযোগও সৃষ্টি হয়ে যাবে। ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য বহুদিন ধরেই হাপিত্যেশ করছে। কয়েকটি নতুন জেটি নির্মাণ করা গেলে এই অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি সহজেই চট্টগ্রাম বন্দরকে আঞ্চলিক ব্যবহারের জন্য আরও উপযুক্ত করে তুলবে। ইতিমধ্যে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড স্থাপিত হয়ে গেছে। চীনের জন্যও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ‘ইকোনমিক জোন’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আরও কয়েকটি দেশ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে ‘ইকোনমিক জোন’ স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কর্ণফুলী টানেল স্থাপিত হয়ে গেলে ওই অঞ্চলে ‘শিল্প এলাকা’ গড়ে তোলার হিড়িক পড়বে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ, টানেল নির্মীয়মাণ থাকতেই দেশের বড় বড় শিল্পপতি তাঁদের শিল্পকারখানা ওই অঞ্চলে সম্প্রসারিত করে ফেলেছেন। টানেলের পার্শ্ববর্তী আনোয়ারায় অবস্থিত কর্ণফুলী সার কারখানা ও চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) টানেলের ফলে সরাসরি পরিবহন ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ের মাধ্যমে উপকৃত হবে এবং আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকত অতিদ্রুত একটি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে।
কিন্তু কর্ণফুলী টানেলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যবহার নিশ্চিত হবে যখন মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী থেকে বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত ‘মেরিন ড্রাইভ’ সড়ক প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে। প্রস্তাবিত মেরিন ড্রাইভটি মিরসরাই থেকে কর্ণফুলী টানেল পর্যন্ত ছয় লেনের সড়ক এবং টানেলের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হিসেবে নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বলে খবর দেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে। বলা হচ্ছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ২০২৩ সালে শুরু হয়ে ২০২৬ সালে সম্পন্ন হবে। আমার মতে, এই মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্প মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি সুবিশাল আবাসন ও শিল্পায়ন জোন গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মীয়মাণ গভীর সমুদ্রবন্দরের বহুল বিস্তৃত ও যথাযথ অর্থনৈতিক উপযোগিতা এবং ব্যয় সাশ্রয়সংক্রান্ত উপকার পেতে হলে এই মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্প অগ্রাধিকার সহকারে গড়ে তোলা সরকারের জন্য ‘ফরজ’ হয়ে পড়েছে নিঃসন্দেহে। অতএব, এ ব্যাপারে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব অচিরেই ঝেড়ে ফেলতে হবে। এই মেরিন ড্রাইভ কর্ণফুলী টানেলকেও ‘অপটিমাম লেভেলে ব্যবহারের’ পথ সুগম করে দেবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরী থেকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের পটিয়া ও আনোয়ারা হয়ে সাঙ্গু নদীর দক্ষিণে অবস্থিত বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজারের অন্যান্য এলাকায় চট্টগ্রাম নগরী থেকে সড়কপথে যাতায়াতের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার হ্রাস করবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে যাতায়াতকারী এতদঞ্চলের ট্রাফিক চট্টগ্রাম নগরীতে না ঢুকে সরাসরি নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে পারবে টানেলের মাধ্যমে, যার ফলে যানবাহনগুলোর সময় ও খরচ বিপুলভাবে সাশ্রয় হবে। চট্টগ্রাম নগরীর যানজট সমস্যারও উল্লেখযোগ্য সমাধান আসবে এর ফলে। আউটার রিং রোড ব্যবহার করে চট্টগ্রাম নগরী থেকে এতদঞ্চলে যাতায়াতকারী ট্রাফিকও টানেল ব্যবহার করে প্রস্তাবিত মেরিন ড্রাইভের সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
আরেকটি বিষয়কেও বিবেচনায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। শুধু শিল্পায়ন জোন নয়, এই পুরো এলাকাকে একটি বিশ্বমানের ‘পর্যটন ও আবাসন জোন’ হিসেবে গড়ে তোলার যে সুযোগ কর্ণফুলী টানেল সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, সেটার গুরুত্বকেও খাটো করা মোটেই সমীচীন হবে না। আরও আকর্ষণীয়, যেসব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এই এলাকা ধারণ করছে, তা হলো সমুদ্র উপকূলে ভবিষ্যতে আরও অনেকগুলো বন্দর ও ‘আউটার এনকোরেজ’ গড়ে তোলার সুযোগ। কয়েক বছরের মধ্যে সাঙ্গু নদীর মোহনায় ও নিকটবর্তী সাগর উপকূলে আরেকটি বন্দর গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা এখনই শুরু করলে অসুবিধা কোথায়? আমি আবারও বলছি, কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রামের পাশাপাশি পুরো দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দেবে। পুরো চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকাকে ‘দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর’ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে কর্ণফুলী টানেল। পদ্মা সেতুর পাশাপাশি এই টানেলও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের ফসল। আমি প্রধানমন্ত্রীকে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সফল বাস্তবায়নের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম নগরী বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাশের বেশ কয়েক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। চট্টগ্রাম বন্দরও কর্ণফুলী নদীর উত্তর পারে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এলাকায় অবস্থিত। অথচ নদীর স্বাভাবিক খাঁড়ি নদীর দক্ষিণ পাড়সংলগ্ন জলধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উল্টো দিকে নদীর জলপ্রবাহের সঙ্গে আসা পলিমাটি জমা হওয়াই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
তাই উত্তর পাড়ের বন্দরের জেটিগুলোর নাব্যতা সংরক্ষণের জন্য প্রতিবছর খননকাজ চালাতে হয়, কয়েক বছর পরপর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, প্রায় ১ হাজার ৩০০ বছর আগে যখন চট্টগ্রাম নৌবন্দর গড়ে উঠেছিল, তখন প্রধানত কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়েই বন্দরের অবস্থান ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে যখন আধুনিক বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তখন তদানীন্তন ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাংশের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ সহজে ও সুলভে প্রতিষ্ঠার যুক্তিতে বন্দরের জেটিগুলো নদীর উত্তর পাড়েই নির্মাণ করা হয়, যার ফলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাণিজ্যকেন্দ্র এবং আবাসিক এলাকাগুলোও ওই বন্দরকে ঘিরে গড়ে ওঠে। চট্টগ্রাম বন্দরও কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে সম্প্রসারিত হয়নি, যেহেতু বন্দরের অবস্থানের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা থেকে কর্ণফুলী নদীর মোহনা পর্যন্ত নদীতে কোনো সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই। নব্বইয়ের দশকে বাকলিয়ায় সেতু নির্মাণের আগে শুধু জলপথেই ওই এলাকার জনগণ চট্টগ্রাম শহরে আসতে পারত। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী এখনো চট্টগ্রামের সবচেয়ে অনুন্নত দুটি উপজেলা রয়ে গেছে, যদিও আকাশপথে এ দুটি উপজেলা চট্টগ্রাম নগরী থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী এলাকা।
গত ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দুটি টিউবের একটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়া উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছিলেন। দুই লেনের এই টিউব জানুয়ারি মাসে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পুরো কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় কর্ণফুলী টানেলই হবে নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল। আমি এই প্রকল্পের একজন বড় সমর্থক। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে এই টানেলের সুদূরপ্রসারী ও বহুল বিস্তৃত ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী উপকার সাধন করবে। অবশ্য এটাও বলা প্রয়োজন, প্রাথমিকভাবে কয়েক বছর টানেলটি স্বল্প ব্যবহৃত থাকবে। সে জন্য সাধারণ জনগণের কাছে এই প্রকল্পকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল মনে হওয়াই স্বাভাবিক। টানেলটি নির্মাণের জন্য মোট ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, যে ঋণ পরিশোধের বার্ষিক কিস্তি ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশের জন্য বোঝা হিসেবে চেপে বসবে।
টানেল নির্মাণের কাজে যে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তারাও কয়েকবার প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে নিয়েছে। মনে হতে পারে যে টানেলটি বাংলাদেশের আরেকটি ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পেরই নজির। কারণ, প্রথম কয়েক বছর এই টানেল স্বল্প ব্যবহৃত (আন্ডার-ইউটিলাইজড) সড়কপথ হিসেবে থেকে গেলে এর টোলের আয় থেকে ঋণের বার্ষিক কিস্তির অর্থ পরিশোধ করা যাবে না।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওপরে উল্লিখিত বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতেই হবে। বাকলিয়ায় শাহ আমানত সেতুর যেখানে অবস্থান, সেখান থেকে কর্ণফুলী নদীর ভাটি অঞ্চলের ২০ কিলোমিটারে আর কোনো সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানের কারণে। অতএব, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের পটিয়া ও আনোয়ারা হয়ে সাঙ্গু নদীর দক্ষিণে অবস্থিত বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজারের অন্যান্য এলাকায় চট্টগ্রাম নগরী থেকে সড়কপথে যাতায়াতের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার কমে যাচ্ছে এই ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে। নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধু টানেল এতদঞ্চলের এই সীমাবদ্ধতাগুলো চিরতরে দূর করে দেবে। অবিলম্বে নগর-পরিকল্পনা গ্রহণ করলে কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রাম নগরীকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনস’-এ পরিণত করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে।
টানেল নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শিল্পায়ন, আবাসন ও বাণিজ্য উন্নয়নের প্রধান বাধাগুলো আর না থাকায় অঞ্চলজুড়ে দ্রুত উন্নয়ন ও শিল্পায়নযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে। উপরন্তু, চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকটি জেটি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে নির্মাণের সুযোগও সৃষ্টি হয়ে যাবে। ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য বহুদিন ধরেই হাপিত্যেশ করছে। কয়েকটি নতুন জেটি নির্মাণ করা গেলে এই অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি সহজেই চট্টগ্রাম বন্দরকে আঞ্চলিক ব্যবহারের জন্য আরও উপযুক্ত করে তুলবে। ইতিমধ্যে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড স্থাপিত হয়ে গেছে। চীনের জন্যও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ‘ইকোনমিক জোন’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আরও কয়েকটি দেশ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে ‘ইকোনমিক জোন’ স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কর্ণফুলী টানেল স্থাপিত হয়ে গেলে ওই অঞ্চলে ‘শিল্প এলাকা’ গড়ে তোলার হিড়িক পড়বে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ, টানেল নির্মীয়মাণ থাকতেই দেশের বড় বড় শিল্পপতি তাঁদের শিল্পকারখানা ওই অঞ্চলে সম্প্রসারিত করে ফেলেছেন। টানেলের পার্শ্ববর্তী আনোয়ারায় অবস্থিত কর্ণফুলী সার কারখানা ও চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) টানেলের ফলে সরাসরি পরিবহন ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ের মাধ্যমে উপকৃত হবে এবং আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকত অতিদ্রুত একটি আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে।
কিন্তু কর্ণফুলী টানেলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যবহার নিশ্চিত হবে যখন মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী থেকে বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত ‘মেরিন ড্রাইভ’ সড়ক প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে। প্রস্তাবিত মেরিন ড্রাইভটি মিরসরাই থেকে কর্ণফুলী টানেল পর্যন্ত ছয় লেনের সড়ক এবং টানেলের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হিসেবে নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বলে খবর দেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে। বলা হচ্ছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ২০২৩ সালে শুরু হয়ে ২০২৬ সালে সম্পন্ন হবে। আমার মতে, এই মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্প মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি সুবিশাল আবাসন ও শিল্পায়ন জোন গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মীয়মাণ গভীর সমুদ্রবন্দরের বহুল বিস্তৃত ও যথাযথ অর্থনৈতিক উপযোগিতা এবং ব্যয় সাশ্রয়সংক্রান্ত উপকার পেতে হলে এই মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্প অগ্রাধিকার সহকারে গড়ে তোলা সরকারের জন্য ‘ফরজ’ হয়ে পড়েছে নিঃসন্দেহে। অতএব, এ ব্যাপারে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব অচিরেই ঝেড়ে ফেলতে হবে। এই মেরিন ড্রাইভ কর্ণফুলী টানেলকেও ‘অপটিমাম লেভেলে ব্যবহারের’ পথ সুগম করে দেবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরী থেকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের পটিয়া ও আনোয়ারা হয়ে সাঙ্গু নদীর দক্ষিণে অবস্থিত বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজারের অন্যান্য এলাকায় চট্টগ্রাম নগরী থেকে সড়কপথে যাতায়াতের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার হ্রাস করবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে যাতায়াতকারী এতদঞ্চলের ট্রাফিক চট্টগ্রাম নগরীতে না ঢুকে সরাসরি নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে পারবে টানেলের মাধ্যমে, যার ফলে যানবাহনগুলোর সময় ও খরচ বিপুলভাবে সাশ্রয় হবে। চট্টগ্রাম নগরীর যানজট সমস্যারও উল্লেখযোগ্য সমাধান আসবে এর ফলে। আউটার রিং রোড ব্যবহার করে চট্টগ্রাম নগরী থেকে এতদঞ্চলে যাতায়াতকারী ট্রাফিকও টানেল ব্যবহার করে প্রস্তাবিত মেরিন ড্রাইভের সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
আরেকটি বিষয়কেও বিবেচনায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। শুধু শিল্পায়ন জোন নয়, এই পুরো এলাকাকে একটি বিশ্বমানের ‘পর্যটন ও আবাসন জোন’ হিসেবে গড়ে তোলার যে সুযোগ কর্ণফুলী টানেল সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, সেটার গুরুত্বকেও খাটো করা মোটেই সমীচীন হবে না। আরও আকর্ষণীয়, যেসব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এই এলাকা ধারণ করছে, তা হলো সমুদ্র উপকূলে ভবিষ্যতে আরও অনেকগুলো বন্দর ও ‘আউটার এনকোরেজ’ গড়ে তোলার সুযোগ। কয়েক বছরের মধ্যে সাঙ্গু নদীর মোহনায় ও নিকটবর্তী সাগর উপকূলে আরেকটি বন্দর গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা এখনই শুরু করলে অসুবিধা কোথায়? আমি আবারও বলছি, কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রামের পাশাপাশি পুরো দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দেবে। পুরো চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকাকে ‘দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর’ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে কর্ণফুলী টানেল। পদ্মা সেতুর পাশাপাশি এই টানেলও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের ফসল। আমি প্রধানমন্ত্রীকে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সফল বাস্তবায়নের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১৪ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে