সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরে উন্নতি যে হয়েছে, তা ঠিক। শত বিপদের মধ্যেও ওই উন্নয়ন থেমে নেই, নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সে উন্নতি যে এক বিশেষ প্রকারের, এ-সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী একটা সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের দিয়েছেন। মন্ত্রীদের বক্তব্য আমাদের শুনতে হয়। না শুনে উপায় থাকে না। চোখ-কান খোলা রাখার দরকার পড়ে না। বক্তব্যগুলো চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে। সেসব বক্তব্য সাধারণত আলো দেয় না, অনেক ক্ষেত্রে অন্ধকারই বরং বৃদ্ধি করে। এরই মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এসেছে পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যটি। গত ১৯ আগস্টের কাগজে পড়েছি সেটা। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল বৈষম্য বাড়াচ্ছে’এবং ‘খুব সহসা যে তা কমবে এমন সম্ভাবনা নেই।’এ ধরনের সত্য কথা গুরুত্বপূর্ণ লোকদের কাছ থেকে পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল সারা বিশ্বে অত্যন্ত প্রশংসিত, অন্যরা অনুকরণে ভীষণ আগ্রহী—এসব কথাই শুনে আসছি। ওই উন্নয়ন যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে অধিকাংশ মানুষের দুঃখ বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে, এ কথাটা তো এমনকি জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছ থেকেও সচরাচর শুনতে পাই না। পরিকল্পনামন্ত্রীকে ধন্যবাদ এবং এটা আমাদের মনে পড়ে যে উন্নয়ন পাকিস্তান আমলেও বিস্তর হয়েছে। কিন্তু ওই উন্নতি বৈষম্যমূলক ছিল বলেই তার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে। ভয়ংকর রকমের বিপদ মাথায় নিয়ে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রীর এই বক্তব্য যে তাঁর সঙ্গের লোকদের কানে পৌঁছাবে এবং উন্নয়ন নিয়ে চিন্তিত হবে, এমন ভরসা একেবারেই নেই। তাঁর সঙ্গের লোকেরা উন্নয়নের বাজনা বাজাচ্ছেন এবং সেই নিনাদে তাঁদের কর্ণে বিপরীত শব্দের প্রবেশ দুঃসাধ্য হওয়ারই কথা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেশবাসীর জন্য সুখ যে বয়ে আনেনি, সেটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়ন বেড়েছে কিন্তু কর্মসংস্থান তার সঙ্গে যে পাল্লা দিয়ে বাড়বে, তেমনটি ঘটেনি। অথচ মেহনতি মানুষের শ্রমের ওপর ভর করেই সৌধটি দাঁড়িয়েছে। করোনাকালে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে খাবে কী? আয়-উপার্জনের কী বন্দোবস্ত? একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। পাবনা অঞ্চলের এক দম্পতি ঢাকা শহরে কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। কাজ হারিয়ে গ্রামে ফেরত গেছেন। গ্রামে গিয়ে কাজ না পেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছেন। দুজন। একসঙ্গে। (কালের কণ্ঠ, ১২-০৭-২১)
ওদিকে আমাদের জন্য মহা সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে বন্যা। উন্নতি বন্যার অভিশাপ নিরসনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কার্যকর হয়নি। বন্যা ফি বছর হয়, সমাধানের দাবি ওঠে, কিন্তু তারপর যে সেই। চাপা পড়ে যায়। এটাই বাস্তবতা। বন্যার কথা খুব করে বলতেন মওলানা ভাসানী। তিনি কৃষকদের দুর্দশা জানতেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা প্রতিশ্রুতির মধ্যে ৭ নম্বরটি ছিল, ‘খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।’ ১৯৬৫ সালে ঘোষিত ন্যাপের ১৪ দফা ছিল গোটা পাকিস্তানের কর্মসূচি, সেখানেও ১৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা প্রতিরোধ করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।’ বহু কষ্টে পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদায় করা গেছে, কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরেও বন্যার অভিশাপ আমাদের কাঁধ থেকে নামেনি। প্রধান কারণ সমস্যাটা বিত্তবানদের স্পর্শ করে না। পাকিস্তান আমলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এবং গিয়েছিলও যে বন্যা সমস্যার সমাধান মূলত নদীর সমস্যা। যে জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেই ফারাক্কা কার্যকর করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য শুষ্ক মৌসুমে কম পানি ও বর্ষায় প্লাবনের দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে। মওলানা ভাসানী সমস্যাটির গুরুত্ব কখনো ভোলেননি। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এবং অসুস্থ অবস্থায়ও ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে তিস্তাসহ অন্যান্য নদী নিয়েও মস্ত মস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা ভুক্তভোগী হচ্ছি। কিন্তু এ নিয়ে রাষ্ট্র-কর্তাদের তেমন দুশ্চিন্তা দেখা যায় না। ওদিকে বর্ষা এলেই নদীর ভাঙনকাজ শুরু হয়ে যায়। শত শত মানুষ গৃহহীন হয়। জমি কমে আসে। আবার গ্রীষ্মের সময় অনেক এলাকায় দেখা দেয় নিদারুণ খরা। খাওয়ার পানির আকাল পড়ে। উন্নতির উৎসবের নিচে হারিয়ে যায় বিপন্ন মানুষের উদ্বেগ ও আর্তনাদ।
তবে উন্নতির যথেচ্ছাচারের সংবাদ ও প্রমাণ দেখা যাচ্ছে যত্রতত্রই। যেমন সংসদীয় নির্বাচনে। অভিনবত্বের দিক থেকে আমাদের গত দুটি নির্বাচনই অসামান্য; তবে দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রথমটিতে বিরোধী দল অংশ নেয়নি; ফলে সরকারি দল ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী হতে পেরেছে। দ্বিতীয়টিতে বিরোধী দল কোনো মতে হাজির হয়েছিল; তবে এবার ভোটারদের পক্ষে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, সরকারি স্বেচ্ছাসেবকেরা ভোটারদের হয়ে মধ্যরাতেই ভোটদানের কষ্টকর কাজটি সম্পন্ন করে দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক তিনটি উপনির্বাচনে দেখা গেল আরেক ধাপ উন্নতি। প্রার্থী কেনাবেচা। ভোট কারচুপি, ভোট কেনাবেচা—এসব আগে শুনেছি, উন্নত পরিস্থিতিতে এবার খবর পাওয়া গেল প্রার্থী কেনাবেচার। বিএনপি শিগগিরই আর ভোটে দাঁড়াচ্ছে না; সেই ফাঁকে জাতীয় পার্টি প্রার্থী হাজির করেছিল তিনটি আসনেই। মনেপ্রাণে সরকার-সমর্থক হলেও তারাই তো এখন বিরোধী দল। ঢাকা ও কুমিল্লা আসনে প্রার্থীরা বিক্রি হয়ে গেছেন। দাম পেয়েছেন খুব ভালো। লক্ষ্মীপুরের প্রার্থীও বিক্রি হওয়ার আশায় ছিলেন; কিন্তু মতিগতি টের পেয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রার্থীকে বসে পড়তে দেননি, দাঁড় করিয়েই রেখেছেন। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ভোট; নিকটতম প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রাপ্তি ১ হাজার ৫৬৮ ভোট। লক্ষ্মীপুরের ওই নির্বাচনী আসনটির অবশ্য একটি পূর্ব ইতিহাস আছে। আগের নির্বাচনে আসন ভাগাভাগিতে ওই আসনটি পড়েছিল জাপার ভাগে। জাপার সেই প্রার্থী বসে যান, স্বতন্ত্র প্রার্থীকে আসনটি ছেড়ে দিয়ে। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন; পরে তাঁর স্ত্রীও সংসদের সদস্য হন নারীদের সুরক্ষিত আসন থেকে। এরপর তাঁরা সরকারি দলে যোগ দেন এবং এমপি সাহেব মানব পাচারসহ নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে বহু কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। তবে ধরা পড়েন, শাস্তি হয়; আসন হারান। ক্রয়-বিক্রয়ের ওই শূন্য আসনেই উপনির্বাচন। সেবার জাপার যে প্রার্থী বসে পড়েছিলেন, তিনি তাঁর ওই কাজের বিনিময়ে কয়েক কোটি পেয়েছিলেন বলে শোনা গেছে। জাপার এবারকার প্রার্থীর ক্ষোভ, বসে পড়ার সুযোগ থেকে তাঁকে কেন বঞ্চিত করা হলো? এক যাত্রায় ফল কেন পৃথক হবে?
প্রার্থী বেচাকেনার খবরটা পত্রিকায় যেভাবে এসেছে তাতে কৌতুকের আভাস রয়েছে। ইত্তেফাক লিখেছে, ‘বিনা ভোটে এমপি হওয়ার নতুন খেলা। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে জাপার প্রার্থী’। সমকালের হেডিং একটু ভিন্ন ধরনের, ‘আর্থিক সুবিধা নিয়ে সরে দাঁড়াচ্ছেন প্রার্থীরা’। প্রথম আলো: ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা “বিক্রি” হচ্ছেন’। কালের কণ্ঠ লিখেছে, ‘জাপার প্রার্থী সরে দাঁড়াচ্ছেন, ক্ষুব্ধ নেতৃত্ব’। পত্রিকাটির খবরে আরও জানা যাচ্ছে, ‘ভোটে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন প্রার্থীর’। প্রশ্নটা করেছেন লক্ষ্মীপুরের প্রার্থী, যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দণ্ডায়মান থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছে যে তিনি বলির পাঁঠা হয়েছেন। মনে হওয়ার পেছনে যুক্তি যে নেই, তা তো নয়। কোথায় ১ লাখ আর কোথায় ১ হাজার ভোট।
ভবিষ্যতে দেশে আরও কত রকমের উন্নতি হবে, কে জানে। তবে প্রশ্ন থাকবে, পুঁজিবাদের এই যে স্রোত, একে রোধিবে এখন কোন বাঁধ? না, পুঁজিবাদী বাঁধ দিয়ে পুঁজিবাদের প্লাবন রোধ করা যাবে না; সামাজিক মালিকানার দিকে যেতে হবে এবং খুব জরুরিভাবে সেই ব্যবস্থা দরকার হবে, যাতে জনপ্রতিনিধিরা টাকার জোরে নির্বাচিত হবেন না। তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা হবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা, অন্য কিছু নয়। কিন্তু তেমনটি ঘটার আশু কোনো সম্ভাবনা কি দেখা যাচ্ছে? ব্যাপার-স্যাপার মনে হবে কৌতুকের, কিন্তু আসলে কী তাই?
নানা দিক থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। চালের দাম, তেলের দাম বাড়ছে। বলা হচ্ছে সিন্ডিকেট দায়ী। তা সিন্ডিকেটকে কি সরকার চেনে না? সিন্ডিকেট ভাঙা হচ্ছে না কেন? এমনকি ব্যক্তিগত আলাপও তো দেখছি এখন অনিরাপদ। টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রস্তুত রয়েছে খপ্ করে ধরে ফেলার জন্য। কোভিড-১৯ তো তার কাজ করছেই, ডেঙ্গুও আগের অবস্থায় থাকছে না। তার প্রকোপে উন্নতি ঘটেছে। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লেগেও বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। বজ্রপাতেও প্রতিবছর মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর একটা বড় কারণ বৃক্ষনিধন। গাছ যে কতটা উপকারী, সেটা বোঝা হয় না। তা বৃক্ষনিধনের দায়টা কার? এককথায় বলতে গেলে দায় পুঁজিবাদী উন্নয়নের। দেখলাম এই উন্নয়নকারীদের বিরুদ্ধে ভালো একটা অবস্থান নিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট। হাইকোর্ট ভারতের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে ৪০ কোটি রুপি জরিমানা করেছেন, ৬০০ গাছ কেটে ফেলার জন্য। কলকাতা শহরের একেবারে কেন্দ্রে একটি খোলা জায়গায় বহুতল আবাসন নির্মাণের অছিলায় প্রতিষ্ঠানটি ওই ৬০০ বৃক্ষ নিধন করেছিল। হাইকোর্টের হিসাবে এতে ক্ষতি হয়েছে ৪০ কোটি রুপি। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে জরিমানা বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হবে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার কাজে। এটা একটা ভালো দৃষ্টান্ত এবং প্রয়োজনীয় বার্তাপ্রেরণ। কিন্তু কেবল এতে যে কাজ হবে, তা তো নয়; বদলানো চাই উন্নয়নের পুঁজিবাদী ধারণা ও ধারাকেই।
বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরে উন্নতি যে হয়েছে, তা ঠিক। শত বিপদের মধ্যেও ওই উন্নয়ন থেমে নেই, নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সে উন্নতি যে এক বিশেষ প্রকারের, এ-সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী একটা সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের দিয়েছেন। মন্ত্রীদের বক্তব্য আমাদের শুনতে হয়। না শুনে উপায় থাকে না। চোখ-কান খোলা রাখার দরকার পড়ে না। বক্তব্যগুলো চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে। সেসব বক্তব্য সাধারণত আলো দেয় না, অনেক ক্ষেত্রে অন্ধকারই বরং বৃদ্ধি করে। এরই মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এসেছে পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্যটি। গত ১৯ আগস্টের কাগজে পড়েছি সেটা। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল বৈষম্য বাড়াচ্ছে’এবং ‘খুব সহসা যে তা কমবে এমন সম্ভাবনা নেই।’এ ধরনের সত্য কথা গুরুত্বপূর্ণ লোকদের কাছ থেকে পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল সারা বিশ্বে অত্যন্ত প্রশংসিত, অন্যরা অনুকরণে ভীষণ আগ্রহী—এসব কথাই শুনে আসছি। ওই উন্নয়ন যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে অধিকাংশ মানুষের দুঃখ বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে, এ কথাটা তো এমনকি জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছ থেকেও সচরাচর শুনতে পাই না। পরিকল্পনামন্ত্রীকে ধন্যবাদ এবং এটা আমাদের মনে পড়ে যে উন্নয়ন পাকিস্তান আমলেও বিস্তর হয়েছে। কিন্তু ওই উন্নতি বৈষম্যমূলক ছিল বলেই তার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে। ভয়ংকর রকমের বিপদ মাথায় নিয়ে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রীর এই বক্তব্য যে তাঁর সঙ্গের লোকদের কানে পৌঁছাবে এবং উন্নয়ন নিয়ে চিন্তিত হবে, এমন ভরসা একেবারেই নেই। তাঁর সঙ্গের লোকেরা উন্নয়নের বাজনা বাজাচ্ছেন এবং সেই নিনাদে তাঁদের কর্ণে বিপরীত শব্দের প্রবেশ দুঃসাধ্য হওয়ারই কথা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেশবাসীর জন্য সুখ যে বয়ে আনেনি, সেটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়ন বেড়েছে কিন্তু কর্মসংস্থান তার সঙ্গে যে পাল্লা দিয়ে বাড়বে, তেমনটি ঘটেনি। অথচ মেহনতি মানুষের শ্রমের ওপর ভর করেই সৌধটি দাঁড়িয়েছে। করোনাকালে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে খাবে কী? আয়-উপার্জনের কী বন্দোবস্ত? একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। পাবনা অঞ্চলের এক দম্পতি ঢাকা শহরে কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। কাজ হারিয়ে গ্রামে ফেরত গেছেন। গ্রামে গিয়ে কাজ না পেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছেন। দুজন। একসঙ্গে। (কালের কণ্ঠ, ১২-০৭-২১)
ওদিকে আমাদের জন্য মহা সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে বন্যা। উন্নতি বন্যার অভিশাপ নিরসনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কার্যকর হয়নি। বন্যা ফি বছর হয়, সমাধানের দাবি ওঠে, কিন্তু তারপর যে সেই। চাপা পড়ে যায়। এটাই বাস্তবতা। বন্যার কথা খুব করে বলতেন মওলানা ভাসানী। তিনি কৃষকদের দুর্দশা জানতেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা প্রতিশ্রুতির মধ্যে ৭ নম্বরটি ছিল, ‘খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।’ ১৯৬৫ সালে ঘোষিত ন্যাপের ১৪ দফা ছিল গোটা পাকিস্তানের কর্মসূচি, সেখানেও ১৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা প্রতিরোধ করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।’ বহু কষ্টে পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদায় করা গেছে, কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরেও বন্যার অভিশাপ আমাদের কাঁধ থেকে নামেনি। প্রধান কারণ সমস্যাটা বিত্তবানদের স্পর্শ করে না। পাকিস্তান আমলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এবং গিয়েছিলও যে বন্যা সমস্যার সমাধান মূলত নদীর সমস্যা। যে জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সময় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেই ফারাক্কা কার্যকর করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য শুষ্ক মৌসুমে কম পানি ও বর্ষায় প্লাবনের দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে। মওলানা ভাসানী সমস্যাটির গুরুত্ব কখনো ভোলেননি। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এবং অসুস্থ অবস্থায়ও ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে তিস্তাসহ অন্যান্য নদী নিয়েও মস্ত মস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা ভুক্তভোগী হচ্ছি। কিন্তু এ নিয়ে রাষ্ট্র-কর্তাদের তেমন দুশ্চিন্তা দেখা যায় না। ওদিকে বর্ষা এলেই নদীর ভাঙনকাজ শুরু হয়ে যায়। শত শত মানুষ গৃহহীন হয়। জমি কমে আসে। আবার গ্রীষ্মের সময় অনেক এলাকায় দেখা দেয় নিদারুণ খরা। খাওয়ার পানির আকাল পড়ে। উন্নতির উৎসবের নিচে হারিয়ে যায় বিপন্ন মানুষের উদ্বেগ ও আর্তনাদ।
তবে উন্নতির যথেচ্ছাচারের সংবাদ ও প্রমাণ দেখা যাচ্ছে যত্রতত্রই। যেমন সংসদীয় নির্বাচনে। অভিনবত্বের দিক থেকে আমাদের গত দুটি নির্বাচনই অসামান্য; তবে দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রথমটিতে বিরোধী দল অংশ নেয়নি; ফলে সরকারি দল ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী হতে পেরেছে। দ্বিতীয়টিতে বিরোধী দল কোনো মতে হাজির হয়েছিল; তবে এবার ভোটারদের পক্ষে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, সরকারি স্বেচ্ছাসেবকেরা ভোটারদের হয়ে মধ্যরাতেই ভোটদানের কষ্টকর কাজটি সম্পন্ন করে দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক তিনটি উপনির্বাচনে দেখা গেল আরেক ধাপ উন্নতি। প্রার্থী কেনাবেচা। ভোট কারচুপি, ভোট কেনাবেচা—এসব আগে শুনেছি, উন্নত পরিস্থিতিতে এবার খবর পাওয়া গেল প্রার্থী কেনাবেচার। বিএনপি শিগগিরই আর ভোটে দাঁড়াচ্ছে না; সেই ফাঁকে জাতীয় পার্টি প্রার্থী হাজির করেছিল তিনটি আসনেই। মনেপ্রাণে সরকার-সমর্থক হলেও তারাই তো এখন বিরোধী দল। ঢাকা ও কুমিল্লা আসনে প্রার্থীরা বিক্রি হয়ে গেছেন। দাম পেয়েছেন খুব ভালো। লক্ষ্মীপুরের প্রার্থীও বিক্রি হওয়ার আশায় ছিলেন; কিন্তু মতিগতি টের পেয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রার্থীকে বসে পড়তে দেননি, দাঁড় করিয়েই রেখেছেন। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ভোট; নিকটতম প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রাপ্তি ১ হাজার ৫৬৮ ভোট। লক্ষ্মীপুরের ওই নির্বাচনী আসনটির অবশ্য একটি পূর্ব ইতিহাস আছে। আগের নির্বাচনে আসন ভাগাভাগিতে ওই আসনটি পড়েছিল জাপার ভাগে। জাপার সেই প্রার্থী বসে যান, স্বতন্ত্র প্রার্থীকে আসনটি ছেড়ে দিয়ে। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন; পরে তাঁর স্ত্রীও সংসদের সদস্য হন নারীদের সুরক্ষিত আসন থেকে। এরপর তাঁরা সরকারি দলে যোগ দেন এবং এমপি সাহেব মানব পাচারসহ নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে বহু কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। তবে ধরা পড়েন, শাস্তি হয়; আসন হারান। ক্রয়-বিক্রয়ের ওই শূন্য আসনেই উপনির্বাচন। সেবার জাপার যে প্রার্থী বসে পড়েছিলেন, তিনি তাঁর ওই কাজের বিনিময়ে কয়েক কোটি পেয়েছিলেন বলে শোনা গেছে। জাপার এবারকার প্রার্থীর ক্ষোভ, বসে পড়ার সুযোগ থেকে তাঁকে কেন বঞ্চিত করা হলো? এক যাত্রায় ফল কেন পৃথক হবে?
প্রার্থী বেচাকেনার খবরটা পত্রিকায় যেভাবে এসেছে তাতে কৌতুকের আভাস রয়েছে। ইত্তেফাক লিখেছে, ‘বিনা ভোটে এমপি হওয়ার নতুন খেলা। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে জাপার প্রার্থী’। সমকালের হেডিং একটু ভিন্ন ধরনের, ‘আর্থিক সুবিধা নিয়ে সরে দাঁড়াচ্ছেন প্রার্থীরা’। প্রথম আলো: ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা “বিক্রি” হচ্ছেন’। কালের কণ্ঠ লিখেছে, ‘জাপার প্রার্থী সরে দাঁড়াচ্ছেন, ক্ষুব্ধ নেতৃত্ব’। পত্রিকাটির খবরে আরও জানা যাচ্ছে, ‘ভোটে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন প্রার্থীর’। প্রশ্নটা করেছেন লক্ষ্মীপুরের প্রার্থী, যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দণ্ডায়মান থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছে যে তিনি বলির পাঁঠা হয়েছেন। মনে হওয়ার পেছনে যুক্তি যে নেই, তা তো নয়। কোথায় ১ লাখ আর কোথায় ১ হাজার ভোট।
ভবিষ্যতে দেশে আরও কত রকমের উন্নতি হবে, কে জানে। তবে প্রশ্ন থাকবে, পুঁজিবাদের এই যে স্রোত, একে রোধিবে এখন কোন বাঁধ? না, পুঁজিবাদী বাঁধ দিয়ে পুঁজিবাদের প্লাবন রোধ করা যাবে না; সামাজিক মালিকানার দিকে যেতে হবে এবং খুব জরুরিভাবে সেই ব্যবস্থা দরকার হবে, যাতে জনপ্রতিনিধিরা টাকার জোরে নির্বাচিত হবেন না। তাঁদের একমাত্র যোগ্যতা হবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা, অন্য কিছু নয়। কিন্তু তেমনটি ঘটার আশু কোনো সম্ভাবনা কি দেখা যাচ্ছে? ব্যাপার-স্যাপার মনে হবে কৌতুকের, কিন্তু আসলে কী তাই?
নানা দিক থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। চালের দাম, তেলের দাম বাড়ছে। বলা হচ্ছে সিন্ডিকেট দায়ী। তা সিন্ডিকেটকে কি সরকার চেনে না? সিন্ডিকেট ভাঙা হচ্ছে না কেন? এমনকি ব্যক্তিগত আলাপও তো দেখছি এখন অনিরাপদ। টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রস্তুত রয়েছে খপ্ করে ধরে ফেলার জন্য। কোভিড-১৯ তো তার কাজ করছেই, ডেঙ্গুও আগের অবস্থায় থাকছে না। তার প্রকোপে উন্নতি ঘটেছে। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লেগেও বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। বজ্রপাতেও প্রতিবছর মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর একটা বড় কারণ বৃক্ষনিধন। গাছ যে কতটা উপকারী, সেটা বোঝা হয় না। তা বৃক্ষনিধনের দায়টা কার? এককথায় বলতে গেলে দায় পুঁজিবাদী উন্নয়নের। দেখলাম এই উন্নয়নকারীদের বিরুদ্ধে ভালো একটা অবস্থান নিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট। হাইকোর্ট ভারতের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে ৪০ কোটি রুপি জরিমানা করেছেন, ৬০০ গাছ কেটে ফেলার জন্য। কলকাতা শহরের একেবারে কেন্দ্রে একটি খোলা জায়গায় বহুতল আবাসন নির্মাণের অছিলায় প্রতিষ্ঠানটি ওই ৬০০ বৃক্ষ নিধন করেছিল। হাইকোর্টের হিসাবে এতে ক্ষতি হয়েছে ৪০ কোটি রুপি। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে জরিমানা বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হবে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার কাজে। এটা একটা ভালো দৃষ্টান্ত এবং প্রয়োজনীয় বার্তাপ্রেরণ। কিন্তু কেবল এতে যে কাজ হবে, তা তো নয়; বদলানো চাই উন্নয়নের পুঁজিবাদী ধারণা ও ধারাকেই।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে