‘টাইম ইজরানিং আউট’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৮: ৫০
Thumbnail image

ঢাকার উত্তাল রাজপথে ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী চিত্র। মাঝিমাল্লারা সব বইঠা হাতে নেমে এসেছিল রাজপথে। সেদিনের রাজপথ ছিল মাঝিমাল্লাদের দখলে। ১১৫ নম্বর সামরিক ফরমান জারির প্রতিবাদে সেদিন বেসরকারি কর্মচারীরাও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। দেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রতিবাদে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর ‘হেলাল-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই দিন নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসার ব্যাপারে শর্তারোপ করেন। তিনি অবশ্য বলেন, ‘যদি প্রেসিডেন্ট দাবি পূরণের ইচ্ছা নিয়ে আলোচনায় বসতে চান, তাহলে আমি বসতে পারি।’ তবে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বৈঠকে কোনোভাবেই তৃতীয় কোনো পক্ষ উপস্থিত থাকতে পারবে না। 

পরদিন ঢাকার বেশির ভাগ সংবাদপত্রে প্রধান শিরোনাম হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা। দৈনিক সংবাদে ব্যানার হেডলাইন ছিল ‘বাঙ্গালীরা নতি স্বীকার করিবে নাঃ মুজিব’। দৈনিক ইত্তেফাকের মূল খবরের শিরোনাম করা হয়, ‘অসহযোগ চলিবে: সর্বসাধারণের প্রতি মুজিবের নয়া নির্দেশ’। দৈনিক পাকিস্তানের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘হুমকির কাছে নতি স্বীকার করবেন না’। শোল্ডারে ছিল ‘জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এগিয়ে চলেছেঃ মুজিব’। পূর্বদেশের শিরোনাম ছিল ‘আন্দোলন চলবেঃ হরতাল অব্যাহত থাকবে’। 

তবে একাত্তরের ১৪ মার্চ দৈনিক ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে যৌথ সম্পাদকীয় বেরিয়েছিল ‘আর সময় নাই’ শিরোনামে। ইংরেজি দৈনিকগুলোর সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল ‘টাইম ইজ রানিং আউট’। অভিন্ন সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ‘আমরা ঢাকায় সংবাদপত্রসমূহ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আজ সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিন আসিয়াছে এবং এই মুহূর্তে এক বাক্যে এক সুরে কয়েকটি কথা বলা আমাদের অবশ্যকর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তেইশ বছরের ইতিহাসে জাতি আজ চরমতম সঙ্কটে নিপতিত। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক জীবন পদ্ধতি কায়েমের আশায় সমগ্র দেশ জীবনের সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে শরীক হওয়ার পর দেশের আজ এই অবস্থা। জনগণই দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী: দেশের প্রশাসনিক কাঠামো কী হইবে, কী ধরনের সরকারই বা কায়েম হইবে তা নির্ধারণের ক্ষমতার অধিকারী কেবল তাহাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই। গণতন্ত্রে যদি বিশ্বাস থাকে তাহা হইলে দেশের আইন-কানুন প্রণয়ন বা রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে জনগণের প্রতিনিধিদের এই অধিকার কেউ অস্বীকার করিতে পারেন না। এটি একটি যৌক্তিক রাজনৈতিক প্রতিপাদ্যও বটে।

ক্ষমতায় যাঁহারা আজ সমাসীন আর ক্ষমতাসীনদের সহিত কানাকানি করার সুযোগ যাঁহাদের আছে তাঁহাদের ব্যর্থতাই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির এই অবনতির কারণ। বহিরাক্রমণ হইতে দেশের সীমান্ত রক্ষাই হইল সামরিক বাহিনীর কাজ। রাজনৈতিক বিতর্কে হস্তক্ষেপ বা পক্ষ গ্রহণ করা তাহাদের কোনো দায়িত্বের আওতায় আসে না। জনগণের সংগ্রাম যাতে অহিংস পথেই পরিচালিত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁহাদের হস্ত শক্তিশালী করাই আজ প্রয়োজন। দেশের দুই অংশের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কী হইবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেশবাসী জনসাধারণ ও তাঁহাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। আমরা মনে করি, আজ সময় আসিয়াছে যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক জীবনের এই বাস্তব সত্যগুলো স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। আমাদের বিচারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উচিৎ দেশের বুক হইতে সামরিক আইন তুলিয়া লইয়া অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত একটি মীমাংসায় উপনীত হওয়া যার ফলশ্রুতিতে জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়।’ 

একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ছয় দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে ছাত্র ইউনিয়ন এক সমাবেশ থেকে দেশের সাত কোটি মানুষকে সৈনিক হিসেবে সংগ্রামে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানায়। জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান অস্থায়ী সরকার গঠন করতে বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি জানান। পরদিনের পত্রপত্রিকায় ঠাঁই পায় এসব সংবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত