সিংহভাগ নিদর্শনই থেকে যায় দৃষ্টির আড়ালে

শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকা
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১১: ২২

জনসাধারণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা, প্রদর্শন, প্রকাশনা এবং বিনোদনমূলক আকর্ষণীয় প্রদর্শনীর মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন যার অভিলক্ষ্য, শতবর্ষী সেই প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। এক লাখের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ধারণকারী প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে একুশে পদকও পেয়েছে।

কিন্তু জায়গার অভাব, দীর্ঘদিন ধরে সনাতনি কৌশলে নিদর্শন দেখানো এবং দর্শকের কাছে চিত্তাকর্ষক রূপে উপস্থাপন করতে না পারার অভিযোগ বেশ পুরোনো। বিশেষ করে গ্যালারির অপ্রতুলতায় সিংহভাগ নিদর্শনই দেখার সুযোগ পায় না দর্শকেরা। জাদুঘর কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, স্মার্ট ও আধুনিক জাদুঘরে রূপান্তরের লক্ষ্যে বহুতল ভবন বানানোর একটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে। তাতে দর্শক আরও বেশি নিদর্শন দেখার সুযোগ পাবে।

জানা যায়, ১৯১৩ সালে ‘ঢাকা যাদুঘর’ নামে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। ৩৭৯টি নিদর্শন নিয়ে তৎকালীন সচিবালয়ে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) এটি খুলে দেওয়া হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট। ১৯১৫ সালে নিয়ে যাওয়া হয় নিমতলীর নায়েব নাজিমের বারোদুয়ারি ও দেউড়িতে। ১৯৮৩ সালে ঢাকা যাদুঘর আত্তীকরণ করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শাহবাগে স্থানান্তর করা হয়।

জাতীয় জাদুঘর সূত্রমতে, ১১০ বছর পেরিয়ে বর্তমানে জাদুঘরে নিদর্শনের সংখ্যা লাখের কাছাকাছি। ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জাদুঘরে নিদর্শন ছিল ৯৩ হাজার ৭৩৮টি। এসব নিদর্শন দেখানো হয় ৪৫টি গ্যালারিতে। বিপুলসংখ্যক নিদর্শনের মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ৩৯৫টি অর্থাৎ শতকরা ৫ ভাগ নিদর্শন দেখার সুযোগ পায় দর্শকেরা।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষের দাবি, মূলত জায়গার সংকটের কারণে গ্যালারি কম। তাই এত নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও দর্শকেরা সেগুলো দেখতে পারছে না। বিষয়ে জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের উপকিপার দিবাকর সিকদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জাদুঘর বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক-বাহক। এর মাধ্যমেই আমরা মানুষের কাছে আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিতে পারি। আসলে জায়গার অপ্রতুলতার কারণে সব নিদর্শন দেখানোর সুযোগ থাকে না। আর পৃথিবীর সব জাদুঘরই সব নিদর্শন দেখাতে পারে না। আমরা প্রতিবছরই বিশেষ নিদর্শন ছাড়া বেশ কিছু নিদর্শন পরিবর্তন করি, যাতে দর্শকেরা আমাদের সংগ্রহশালার অন্য সব নিদর্শন দেখার সুযোগ পায়।’ তিনি জানান, একুশ শতকে এসে জাদুঘরকে দর্শকের কাছে চিত্তাকর্ষক ও স্মার্ট হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। সেটি কাটানোর চেষ্টা চলছে।

গত চার দশকে প্রদর্শনীসজ্জায় খুব একটা উন্নতি চোখে পড়ে না। বৈচিত্র্যহীন অভ্যন্তরীণ নকশা, সেকেলে উপস্থাপন কৌশল, নিদর্শন নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকাসহ নানা কারণে দর্শক আকৃষ্ট হচ্ছে না। ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত জাদুঘরের দর্শকসংখ্যা বছরে ৫-৭ লাখের মধ্যেই আটকে আছে। কোভিডের পরে তা নেমে আসে ২ লাখ ২৯ হাজারে। জানা গেছে, আশির দশকেও বছরে ১৭ লাখ দর্শকসমাগম হতো।

দিবাকর সিকদার জানান, গ্যালারি আধুনিকায়নের চেষ্টা তাঁরা করছেন। বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনী স্থাপন শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ৩৭,৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর গ্যালারিকে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছে। প্রথম তিনটি গ্যালারিতে ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম পর্যন্ত এবং ৪০ নম্বর গ্যালারিতে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নিদর্শন রাখা হয়েছে। এখানে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে লাইট, সাউন্ড অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া প্রজেকশনের মাধ্যমে। আছে কিয়স্ক ও টাচস্ক্রিনের সাহায্যে তথ্য ও আলোকচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পর্ষদের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘জাদুঘরের সব নিদর্শন দেখার সুযোগ থাকে না। কারণ, কিছু নিদর্শন নির্দিষ্ট তাপমাত্রার বাইরে নেওয়া যায় না। এটা পৃথিবীর সর্বত্র। তবে হ্যাঁ, যে পরিমাণ নিদর্শন এখন প্রদর্শন করা হয় এর চেয়ে বেশি নিদর্শন রোটেশন করে দেখানো যেতে পারে। তা ছাড়া, জায়গার অপ্রতুলতাও ছিল।

সেটার সমাধান হয়ে যাচ্ছে শিগগির। জাদুঘরের পেছনে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। এ ব্যাপারে পর্ষদ, জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয় কাজ করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ঘাটতি তো আছেই। রাতারাতি এমন একটা প্রতিষ্ঠানকে তো পাল্টে দেওয়া যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছে, এর আধুনিকায়নও হচ্ছে ধীরে ধীরে।’   

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত