ড. মইনুল ইসলাম
পাকিস্তানের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ওই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। তারা অনেক দিন আগে আইএমএফের কাছে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাইলেও আইএমএফ এমন অনেকগুলো কঠোর শর্ত আরোপ করতে চাইছে, যেগুলো পূরণের ক্ষমতা পাকিস্তানের শাসক জোটের নেই। সে জন্য আইএমএফ এক বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় দিয়ে আর কোনো অর্থ ছাড় করছে না। এমনকি দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন ও সৌদি আরবও এখন আর পাকিস্তানের দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। চীনের অর্থে পাকিস্তান যে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো নির্মাণ করেছে, সেগুলোর বহুদিন আটকে থাকা কিস্তির পাওনা পরিশোধ না করায় ওই প্ল্যান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চীন, যে কারণে সারা পাকিস্তানের বিদ্যুৎব্যবস্থা ভয়ানক লোডশেডিংসহ প্রায়ই গ্রিড-ফেইলুরের শিকার হচ্ছে। পাকিস্তানি রুপিতে ডলারের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে এক ডলার এখন ২৭৫ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। পাকিস্তানি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে এখন এক কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে, এক কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপির বেশি।
পাকিস্তান যে ক্রমেই একটা ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত হচ্ছে, সেটা বেশ আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। এর প্রধান কারণ, সাড়ে পাঁচ লাখ সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করা পাকিস্তানের পক্ষে কোনো যুক্তিতেই সম্ভব নয়, যদিও জন্ম-শত্রু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এত বড় সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলে পুষছে তারা। ১৯৪৭-৪৯ সালের কাশ্মীর যুদ্ধ দিয়ে দুই দেশের শত্রুতার শুরু, যার শেষ হয়েছিল জাতিসংঘ-আরোপিত অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে কোনো পক্ষের জয়-পরাজয় নিশ্চিত না হলেও তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যে যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়েছিল, তাতে কূটনৈতিক বিজয় ভারতেরই হয়েছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী, যার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বাংলাদেশ বিজয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল ১৬ ডিসেম্বর। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধেও পাকিস্তান তার উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়ে অস্ত্রবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতলগত হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশকে হারানোর পর ১৯৭১-২০২৩ পর্বেও পাকিস্তানের শাসকের ভূমিকা থেকে সামরিক বাহিনীকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, কিছুদিন পরপর সামরিক একনায়কেরা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করছেন। আবার যখন কিছুদিনের জন্য সামরিক বাহিনী সিভিলিয়ান শাসকদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, তখনো শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছে তারা। বর্তমান পর্বে ইমরান খান নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রিয়পাত্র হিসেবে তাদের মদদে, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে কিছুদিন আগে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও যে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টই কলকাঠি নেড়েছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।
এই ক্ষমতাদখলের খেলায় সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের মহাপরাক্রমশালী হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তান সরকারের বাজেটের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিরক্ষা খাত, যেখান থেকে ৭৫ বছরেও ওই খাতকে সরানো যায়নি। এ ধরনের রাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা খাতের বাজেটে হাত দেওয়ার ধৃষ্টতা পাকিস্তানের কোনো সরকারেরই থাকার প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু এই অসহনীয় বোঝা যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ‘মেল্টডাউনের গিরিখাতে’ ধাবিত করছে, সেই সত্যটা বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে উদ্ভাসিত হতে চলেছে এবার। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে এখন সাড়ে ২২ কোটি অতিক্রম করেছে, যাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দেওয়া এত বড় সশস্ত্র বাহিনীর খাই মেটানোর পর কোনোমতেই পাকিস্তানের কোনো শাসক দল বা জোটের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির বার্ষিক রপ্তানি আয় এখনো ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়ে গেছে, অথচ আমদানি ব্যয় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। প্রতিরক্ষা খাতের বিপুল ব্যয় বরাদ্দ মেটানোর পর জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা সরকারের সাধ্যের বাইরে থেকে যাচ্ছে প্রতিবছর। ফলে এই দুটো খাতে পাকিস্তান ক্রমেই পিছিয়ে পড়ায় জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বরে উন্নীত হয়েছে, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৪৭ নম্বরে। ১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:
এক.মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৫৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।
দুই.বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
তিন.বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, গত ১৭ মাসে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি মোতাবেক ২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও সেটা পাকিস্তানের ছয় গুণের বেশি। (বাংলাদেশ সরকারের হিসাব মোতাবেক বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার)।
চার.বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
পাঁচ.বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।
ছয়.বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।
সাত.বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ আর পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২২ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ।
আট.বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে ২৭৫ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।
নয়.বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ১৭ শতাংশ, অথচ পাকিস্তানে তা ৪৬ শতাংশ (ওয়াকিবহাল মহলের মতে আরও বেশি)।
দশ.বাংলাদেশের নারীদের ৩৬ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।
এগারো. বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ আর পাকিস্তানের ৫৯।
বারো. বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনোই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০-২২ পর্বে করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আবার সাড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মতো ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অতিদ্রুত উচ্চ-মধ্যম আয়ের ক্যাটাগরিতে উন্নীত হবে, সে ব্যাপারে উন্নয়ন-চিন্তকেরা আশাবাদী। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আকার আড়াই লাখের মতো, তবে সরকারি বাজেটে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অনেক রকম সুবিধা ভোগ করেন।
১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালে সামরিক একনায়কেরা বাংলাদেশে ক্ষমতা জবরদখল করেছিলেন, ২০০৭-০৮ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে সামরিক বাহিনীই ক্ষমতাসীন ছিল। ওই সময় সরাসরি ক্ষমতা দখলের নানা কারসাজি চালিয়েও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু সুযোগ পেলে আবারও কোনো সামরিক একনায়ক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে না—বলা যাবে কি? বিশেষ করে ১৯৯১ সালের পর দুই বছর বাদে ৩০ বছর ধরে ভোটের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়া যে ‘প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকারব্যবস্থা’ বাংলাদেশে চালু রয়েছে তা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মতো মূল সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে দমন করতে পারছে না এবং দুঃখজনকভাবে ২০১৮ সালে ভোটের গণতন্ত্রই লাইনচ্যুত হয়ে গেছে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ওই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। তারা অনেক দিন আগে আইএমএফের কাছে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাইলেও আইএমএফ এমন অনেকগুলো কঠোর শর্ত আরোপ করতে চাইছে, যেগুলো পূরণের ক্ষমতা পাকিস্তানের শাসক জোটের নেই। সে জন্য আইএমএফ এক বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় দিয়ে আর কোনো অর্থ ছাড় করছে না। এমনকি দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন ও সৌদি আরবও এখন আর পাকিস্তানের দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। চীনের অর্থে পাকিস্তান যে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো নির্মাণ করেছে, সেগুলোর বহুদিন আটকে থাকা কিস্তির পাওনা পরিশোধ না করায় ওই প্ল্যান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চীন, যে কারণে সারা পাকিস্তানের বিদ্যুৎব্যবস্থা ভয়ানক লোডশেডিংসহ প্রায়ই গ্রিড-ফেইলুরের শিকার হচ্ছে। পাকিস্তানি রুপিতে ডলারের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে এক ডলার এখন ২৭৫ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। পাকিস্তানি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে এখন এক কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে, এক কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপির বেশি।
পাকিস্তান যে ক্রমেই একটা ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত হচ্ছে, সেটা বেশ আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। এর প্রধান কারণ, সাড়ে পাঁচ লাখ সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করা পাকিস্তানের পক্ষে কোনো যুক্তিতেই সম্ভব নয়, যদিও জন্ম-শত্রু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এত বড় সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলে পুষছে তারা। ১৯৪৭-৪৯ সালের কাশ্মীর যুদ্ধ দিয়ে দুই দেশের শত্রুতার শুরু, যার শেষ হয়েছিল জাতিসংঘ-আরোপিত অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে কোনো পক্ষের জয়-পরাজয় নিশ্চিত না হলেও তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যে যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়েছিল, তাতে কূটনৈতিক বিজয় ভারতেরই হয়েছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী, যার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বাংলাদেশ বিজয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল ১৬ ডিসেম্বর। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধেও পাকিস্তান তার উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়ে অস্ত্রবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতলগত হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশকে হারানোর পর ১৯৭১-২০২৩ পর্বেও পাকিস্তানের শাসকের ভূমিকা থেকে সামরিক বাহিনীকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, কিছুদিন পরপর সামরিক একনায়কেরা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করছেন। আবার যখন কিছুদিনের জন্য সামরিক বাহিনী সিভিলিয়ান শাসকদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, তখনো শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছে তারা। বর্তমান পর্বে ইমরান খান নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রিয়পাত্র হিসেবে তাদের মদদে, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে কিছুদিন আগে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও যে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টই কলকাঠি নেড়েছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।
এই ক্ষমতাদখলের খেলায় সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের মহাপরাক্রমশালী হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তান সরকারের বাজেটের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিরক্ষা খাত, যেখান থেকে ৭৫ বছরেও ওই খাতকে সরানো যায়নি। এ ধরনের রাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা খাতের বাজেটে হাত দেওয়ার ধৃষ্টতা পাকিস্তানের কোনো সরকারেরই থাকার প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু এই অসহনীয় বোঝা যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ‘মেল্টডাউনের গিরিখাতে’ ধাবিত করছে, সেই সত্যটা বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে উদ্ভাসিত হতে চলেছে এবার। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে এখন সাড়ে ২২ কোটি অতিক্রম করেছে, যাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দেওয়া এত বড় সশস্ত্র বাহিনীর খাই মেটানোর পর কোনোমতেই পাকিস্তানের কোনো শাসক দল বা জোটের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির বার্ষিক রপ্তানি আয় এখনো ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়ে গেছে, অথচ আমদানি ব্যয় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। প্রতিরক্ষা খাতের বিপুল ব্যয় বরাদ্দ মেটানোর পর জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা সরকারের সাধ্যের বাইরে থেকে যাচ্ছে প্রতিবছর। ফলে এই দুটো খাতে পাকিস্তান ক্রমেই পিছিয়ে পড়ায় জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বরে উন্নীত হয়েছে, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৪৭ নম্বরে। ১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:
এক.মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৫৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।
দুই.বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
তিন.বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, গত ১৭ মাসে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের হিসাব-পদ্ধতি মোতাবেক ২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও সেটা পাকিস্তানের ছয় গুণের বেশি। (বাংলাদেশ সরকারের হিসাব মোতাবেক বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার)।
চার.বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
পাঁচ.বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।
ছয়.বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।
সাত.বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ আর পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২২ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ।
আট.বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে ২৭৫ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।
নয়.বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ১৭ শতাংশ, অথচ পাকিস্তানে তা ৪৬ শতাংশ (ওয়াকিবহাল মহলের মতে আরও বেশি)।
দশ.বাংলাদেশের নারীদের ৩৬ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।
এগারো. বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ আর পাকিস্তানের ৫৯।
বারো. বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনোই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০-২২ পর্বে করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আবার সাড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মতো ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অতিদ্রুত উচ্চ-মধ্যম আয়ের ক্যাটাগরিতে উন্নীত হবে, সে ব্যাপারে উন্নয়ন-চিন্তকেরা আশাবাদী। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আকার আড়াই লাখের মতো, তবে সরকারি বাজেটে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অনেক রকম সুবিধা ভোগ করেন।
১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালে সামরিক একনায়কেরা বাংলাদেশে ক্ষমতা জবরদখল করেছিলেন, ২০০৭-০৮ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে সামরিক বাহিনীই ক্ষমতাসীন ছিল। ওই সময় সরাসরি ক্ষমতা দখলের নানা কারসাজি চালিয়েও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু সুযোগ পেলে আবারও কোনো সামরিক একনায়ক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে না—বলা যাবে কি? বিশেষ করে ১৯৯১ সালের পর দুই বছর বাদে ৩০ বছর ধরে ভোটের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়া যে ‘প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকারব্যবস্থা’ বাংলাদেশে চালু রয়েছে তা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মতো মূল সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে দমন করতে পারছে না এবং দুঃখজনকভাবে ২০১৮ সালে ভোটের গণতন্ত্রই লাইনচ্যুত হয়ে গেছে।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে