ওয়াশিংটন ডিসির বইমেলা

মামুনুর রশীদ
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯: ৪২
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯: ৪২

ডালাসকে প্রথমবারের মতো বিদায় জানিয়ে হৃদয়ের চাপা কষ্ট লুকিয়ে পুত্র পল্লব ও পুত্রবধূ জয়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওয়াশিংটনের পথে রওনা দিলাম। বাঙালির চিরাচরিত প্রথায় তারা আমায় বিদায় জানাল। ওয়াশিংটনের বাল্টিমোর বিমানবন্দরে নামার পরেই সাক্ষাৎ হলো সামিনা আমিনের স্বামী ইরাজ তালুকদারের সঙ্গে। তিনি পৌঁছে দিলেন আমার ভাগনে বুলবুলের বাসায়।

বেশ রাত হয়েছিল, নির্জন পথ। মেরিল্যান্ডের রাস্তার দুই পাশে ঘন সবুজ বন কম কিন্তু রাস্তায় কোনো আলো নেই, গাড়ির হেডলাইটের স্বল্পালোকে যতটা দেখা যায়, মনে পড়ে আমাদের সেই গ্রামের কথা। যখন গ্রামের মেঠোপথে আলো থাকার প্রশ্নই ওঠে না, হারিকেন বা টর্চলাইটের আলোয় যতটুকু দেখা যায়। ওই রাতে ভাগনে বুলবুল চৌধুরীর বাড়িতে থাকার কথা। চিরাচরিত বাঙালি পরিবারের মতো বুলবুলের স্ত্রী নাঈমা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। এর আগেই সে জেনে নিয়েছিল কী কী খাবার আমার পছন্দ। যা-ই হোক, মধ্যরাতে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ ডালাস ভ্রমণের গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে উঠেই দেখলাম দ্রুত নাশতা তৈরি করে নাঈমা স্কুলে চলে যাচ্ছে। সে একটি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ইতিমধ্যে বুলবুলের মেয়ে নায়লাও অফিসে চলে গেছে, বয়সে তরুণী কিন্তু চাকরিটা করে বেশ ভারী। বুলবুল প্রাচীন পিতা, সর্বক্ষণ কন্যাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন, অফিসের যাত্রাপথেও খবর নিচ্ছে। আবার অফিসে গিয়ে মেয়ে খবর দিচ্ছে, সে ঠিকমতো পৌঁছে গেছে। আশ্চর্য, পাশ্চাত্য সমাজে এ একেবারেই উল্টো নিয়ম! প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর কোনো ছেলেমেয়ে মা-বাবার ধার ধারে না। কিন্তু এই আমেরিকায়ও বাঙালি পরিবারগুলো এখনো তাদের নিজস্ব পারিবারিক সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।

যা-ই হোক, দুপুরের পরে আমাদের হোটেলে চলে যেতে হবে। ওয়াশিংটনের একটি হোটেল, সেখানে বইমেলা হবে। আমেরিকায় এটাই আমার মূল কাজ—বইমেলার উদ্বোধন এবং প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ। এবার স্যুটকেস গোছানোর পালা। বুলবুল অনেকটা ওর বাবার মতো ভীষণ সাবধানি এবং সময় মেনে চলার মানুষ। ওর বাবা সেই পাকিস্তান আমলের আমলা। এককথার মানুষ। কিন্তু ভীষণ মানবিক। শেষ বয়সেও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাঁড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া ও প্রয়োজনীয় সাহায্য করা তার একটা চমৎকার অভ্যাস ছিল। আজকাল এ রকম মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

দুপুরের পরপরই আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম, বেশ বড় হোটেল। বইমেলার জায়গাটাও বিশাল। ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল সদাহাস্যময়ী কবিতা ও দিলওয়ারের সঙ্গে। উদ্যোক্তাদের অনেকেই এসে ভিড় জমালেন, নির্দিষ্ট রুমে ঢুকে গেলাম। একটা বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমার জন্য তা হলো, আমার অত্যন্ত প্রিয়জন লুৎফর রহমান রিটনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যথারীতি ছোট্ট একটা ছড়া কেটে উষ্ণ আলিঙ্গন এবং এ-ও জানা গেল, তিন দিন রিটন আমার কক্ষেই থাকবে। আমি নিশ্চিন্ত। কারণ এই বয়সে ওষুধ খাওয়া এবং আরও অনেক দেখভালের ব্যাপার রিটনই দেখবে।

ধীরে ধীরে হোটেল পূর্ণ হয়ে উঠল। নিউইয়র্ক থেকে অনেকে এসেছে, বেশ বড় একটি বাহিনী টরন্টো থেকে এসেছে, রিটন এসেছে অটোয়া থেকে। অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হলো আর সার্বক্ষণিক দেখাশোনাও করছেন উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া আছে লেখক, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই। আমার বারবার প্রশ্ন জাগছে, আমি নাটক লিখি, দু-চারটে উপন্যাসও আছে, নিয়মিত কলামও লিখি, তারপরও প্রিন্ট মিডিয়ায় যাদের লেখা নিয়মিত বের হয়, আমি তাদের মতো নই। আমাকে কেন এখানে প্রধান অতিথি করে নিয়ে আসা হলো? একটা যুক্তি অবশ্য আছে, তা হলো—আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষেরা নাটক-সিনেমাকে বই বলতেন।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি নাটক বা সিনেমা দেখে এসে বলতেন, একটা বই দেখে এলাম। নাটক বা সিনেমা তখনো স্বনামে আত্মপ্রকাশ করেনি, তারা বইয়ের অন্তর্গত। সেই দিক থেকে আমরা বই নির্মাণ করি এবং এই সব মাধ্যমে প্রথম কাজটিই হচ্ছে বই লেখা। একদা এসব মাধ্যমকে শাসন করত সাহিত্য। এই মাধ্যমে একসময় রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্র সাহিত্যের দাসত্ব করিবে, তত দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্রের মুক্তি নাই।’ সারা বিশ্বেই এই মুক্তি এখনো মেলেনি। কারণ কালজয়ী সাহিত্যের চলচ্চিত্র এবং নাট্যরূপ এখনো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

খণ্ড খণ্ড আড্ডা জমে ওঠে। সেখানে আমরা চেষ্টা করি বাংলাদেশের রাজনীতি যাতে ঢুকে না পড়ে। উদ্যোক্তাদেরও একই উদ্দেশ্য। সমকালীন রাজনীতিকে তাঁরা পরিহার করবেন। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের রাজনীতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে না; বরং বিভক্ত করে। একে অপরকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেন, তাতে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো ভেঙে যায়, মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। সেদিক থেকে বইমেলা অনেকটাই মুক্ত, আলোচনায় সাহিত্যই স্থান পায়। কয়েকজন লেখকের সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠে।

প্রিন্ট মিডিয়ার শুভ প্রত্যাবর্তনের একটা বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে সারা পৃথিবীতে। মানুষ বই পড়ে বলে বইমেলা হয়। ঢাকায় একুশের বইমেলা সারা বিশ্বে সমাদৃত। কলকাতার বইমেলা, ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা একইভাবে লেখক-পাঠকদের নানাভাবে আকৃষ্ট করে থাকে। নিউইয়র্কের বইমেলাও এখন বাঙালিদের আকর্ষণের বিষয়। এসব নিয়ে গল্প করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল এবং রাতের খাবারে জুটল সম্প্রতি বাঙালির অতিপ্রিয় যুক্ত হওয়া খাবার—বিরিয়ানি। ঢাকা-কলকাতায় তো বটেই, বাঙালি যেখানেই আছে, সেখানেই বিরিয়ানি একটা স্থান করে নিয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসিতেও বিরিয়ানি উপস্থিত।

পরদিন সকালে বইমেলার উদ্বোধন। সকাল থেকেই বইয়ের স্টলগুলো বসতে শুরু করেছে। তখন নাশতা খাওয়ার সময়। এই নাশতার টেবিল পৃথিবীর সবখানেই গল্প করার এবং পরিচিত হওয়ার একটা জায়গা। জুস, দুধ, কফি বা ব্রাউন রুটি, বাটার, জেলি এসব নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং টেবিলে বসেই গল্প শুরু হয়ে যায়। কখনো কখনো হোটেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া সময়সীমা পার হয়ে যায়। যদিও প্রথম দিনে সেই উপায় নেই। কারণ উদ্বোধন যথাসময়ে করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিদিনই অনেক সেমিনার থাকছে। সদ্য প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও আছে। কাজেই প্রাতরাশের আড্ডাটা আর জমল না। চলে আসতে হলো উদ্বোধনের জায়গায়।

ওয়াশিংটনে অবস্থানরত অনেকেই এসেছেন, একদা বিখ্যাত তিনজন সুপরিচিত কণ্ঠের অধিকারী সংবাদ পাঠক রোকেয়া হায়দার, ইকবাল বাহার চৌধুরী ও সরকার কবির উদ্দিন এসেছেন। ঘটনাক্রমে ইকবাল বাহার চৌধুরী একসময়ে মঞ্চে অভিনয় করতেন, সরকার কবিরও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। আবার এই তিনজনই ভয়েস অব আমেরিকায় সংবাদ পাঠক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করে এখন অবসর জীবন পার করছেন। ওয়াশিংটনে আমাদের মান্যবর রাষ্ট্রদূত ডা. ইমরানও এসেছেন। যথারীতি ফিতা কেটে উদ্বোধন হলো এবং প্রদীপ প্রজ্বালন করে উদ্বোধন ঘোষণা করা হলো।

উদ্বোধন ঘোষণার সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি বলার চেষ্টা করলাম। সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার বাঙালি লেখকেরা একটা কথা স্বীকার করে আসছেন যে বাংলাদেশই হবে বাংলা সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র। সেই সঙ্গে এ কথাও যুক্ত হচ্ছে, প্রবাসে যে বাঙালিরা আছেন, তাঁরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করবেন। এই রক্ষা করার প্রবণতা আমি অনেক জায়গায় দেখেছি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, মেলবোর্ন, লন্ডনের কাউন্টিগুলোতে, আমেরিকার প্রায় সর্বত্র। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় এবং বেশ কিছু প্রবাসী লেখক তাঁদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে বাংলার ভাবনাকে তুলে ধরেন। বাংলাদেশে প্রবাসের ইতিহাসের যে ব্যাপক সূচনা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর, তা ভবিষ্যতে অনেক দিন চলবে এবং বাংলা ভাষার চর্চাও সেই সঙ্গে চলতেই থাকবে।

প্রকাশনাগুলোর মধ্যে একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে স্থান পেয়েছে তা হলো, মুক্তিযুদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, প্রবাসীদের মৌলবাদবিরোধী একটা শক্ত অবস্থান লক্ষ করা গেল। এখানেই পরিচয় হলো টরন্টোপ্রবাসী হাসান মাহমুদের সঙ্গে, যিনি ফতেহ মোল্লা নামে পরিচিত। শরিয়াহ আইন নিয়ে তিনি অনেক গবেষণা এবং কার্যকর কিছু পদক্ষেপও নিচ্ছেন এবং এই শরিয়াহ আইন কীভাবে ইসলামকে অপব্যাখ্যা করছে তা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছেন। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার এই মানুষটি সদালাপী এবং বিষয় উত্থাপনে অত্যন্ত দক্ষ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে বেশ আলোকিত হওয়া গেল।

এরপর শুরু হলো বিভিন্ন সেমিনার ও প্রকাশনা উৎসব। লেখকেরা তাঁদের প্রবাসের অভিজ্ঞতা এবং দেশের স্মৃতিকথা কীভাবে তাঁদের লেখায় এসেছেন, তা ব্যক্ত করতে থাকলেন। আমিও সেই সঙ্গে কিছু কিছু বিষয় যুক্ত করার চেষ্টা করছি, এর মধ্যে অনেক পরিচিতজনকেও খুঁজে পেলাম। আবেগে, উচ্ছ্বাসে, ভালোবাসায় সময় কাটতে লাগল।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আবু সাঈদকে ৪–৫ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নেওয়া হয়—শেখ হাসিনার দাবির সত্যতা কতটুকু

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

বিমানবন্দরে সাংবাদিক নূরুল কবীরকে হয়রানির তদন্তের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

ভারত ও তরুণ প্রজন্মের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রসঙ্গে যা বললেন মির্জা ফখরুল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত