গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি: শিল্পের চাপও পড়বে ভোক্তার ঘাড়েই

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১০: ৪৯

বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কমতে কমতে আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ নিচে নেমেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া এ পণ্যটির দাম সহনীয় পর্যায়ে আসার সময়ে দেশে এক লাফে দাম বাড়ানো হলো প্রায় তিন গুণ। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দুই সপ্তাহের ব্যবধানে গ্যাসের দাম এতটা বাড়ানোয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ায় ঝুঁকি তৈরি হবে রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতায়ও। গ্যাসের বাড়তি দামে সরকারের হাতে টাকা বাড়লেও এলএনজি আমদানিতে প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান এতে হবে না। বরং রিজার্ভের ওপরই চাপ বাড়বে।

লোকসান কমাতে দাম বাড়ানোর যুক্তি দেখানো হলেও বিদ্যমান গ্যাস থেকেই যে ৮ শতাংশ অপচয় হচ্ছে, তা বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নেই। অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা মনে করেন, বিশ্ববাজার পরিস্থিতি আরও পর্যবেক্ষণ না করে দাম এতটা বাড়ানোয় দেশে সব জিনিসের দাম বেড়ে যাবে। এতে শেষ বিচারে দুর্ভোগ বাড়বে সাধারণ মানুষের।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জ্বালানির দাম সমন্বয়ের যৌক্তিকতা হয়তো থাকতে পারে; কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমতে থাকায় আরও অপেক্ষা করা যেত, বাজার পর্যবেক্ষণ করা যেত। জ্বালানির ক্ষেত্রে উৎপাদক বা শিল্পের ওপর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই পড়বে।’

এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, একসঙ্গে এত দাম বাড়া সাংঘাতিক ব্যাপার। এতে রোজার আগে চিনি, তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। ভোক্তারা এর ভোগান্তির শিকার হবে। কারখানার খরচ বাড়বে। রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে।

বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, শুধু রপ্তানি নয়, স্থানীয় বাজারেও প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়বে। উৎপাদকেরা তা ভোক্তার ঘাড়ে দিয়ে দেবে। এটা কিন্তু ৫ বা ১০ শতাংশ নয় যে সমন্বয় করা যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, কোনো সন্দেহ নেই।

ক্যাবের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, দাম নির্ধারণে ভোক্তার কথা বলার প্ল্যাটফর্ম বিইআরসির ক্ষমতা সরকার খর্ব করেছে। তারা ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেখানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে মূল্য নির্ধারণ করেছে, সেটা কতটা ভোক্তাবিরোধী হবে, তা তো তাদের সিদ্ধান্তেই বোঝা যাচ্ছে।

বিশ্বে তেল, গ্যাসের দাম কমছেই 
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামসহ বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা এবং স্থানীয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে জানা যায়, বিশ্ব অর্থনীতির সংকটকালে অনেক দেশে মন্দা শুরু হলেও কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় হচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস, গম, ভোজ্যতেলের দাম কমছেই। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের এর সুফল পাওয়ার কথা; কিন্তু দেশে পণ্যগুলোর দাম কমছে না।

বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকায় গত জুলাই মাসে এলএনজি আমদানি বন্ধ করা হয়। ধরে নেওয়া হয়, দাম কমলে আবার আমদানি শুরু হবে। কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দামও কমছে। বর্তমান দাম এক বছর আগের চেয়ে ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ নিচে।

বৈশ্বিক পণ্যমূল্য গবেষণা সংস্থা ট্রেডিং ইকোনমিকসের গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, গ্যাসের দাম বিশ্ববাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ ৩ দশমিক ৩২ ডলার। গত বছরের ২২ আগস্ট এর সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ৯ দশমিক ৬৪ ডলারে। গত এক মাসে পণ্যটির দাম কমেছে ৩৬ শতাংশেরও বেশি। এক সপ্তাহে কমেছে ১০ শতাংশের বেশি।

গত বছর এলএনজি আমদানি বন্ধ করার পর শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে যায় প্রায় ৩০ শতাংশ। গ্যাস-সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনও ব্যাহত হয়। তখন লোডশেডিংয়ের মধ্যে উৎপাদন চালু রাখতে বেশি খরচ করে জেনারেটর চালাতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। তখন তাঁরা বাড়তি দাম দিয়ে হলেও এলএনজি আমদানির পরামর্শ দিয়েছিলেন। সরকার তখনো ডলার সংকটে এলএনজি আমদানি করেনি। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। টাকায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ঠিকই; কিন্তু এলএনজি আমদানি করতে যে ডলার লাগবে, তা বিদ্যমান রিজার্ভ থেকেই যাবে। ফলে ডলার বাজারের ওপর কেমন চাপ তৈরি করবে, তা নিয়েও শঙ্কা আছে।

পণ্যের দাম বাড়বে 
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, এত দিন এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় ডলার সাশ্রয় হয়েছে। এখন আমদানি শুরু হলে মজুত ডলার কমবে। তখন সরকার কীভাবে ঝুঁকি কমাবে, সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপের কথা জানা যায়নি। তাঁরা মনে করেন, এখন এলএনজি আমদানি করতে হলে, শুধু যে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে তা-ই নয়; বরং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি মাত্রা ছাড়াবে।

জানা যায়, গ্যাসের দাম বাড়ানোয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও উৎপাদন খরচ বাড়বে। এখন সব শিল্পের জন্য একই দাম প্রযোজ্য হওয়ায় কারখানার মালিক ও উদ্যোক্তারা সব শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের দামই বাড়িয়ে দেবেন। কয়েক হাত ঘুরে প্রতিটি পণ্য যখন বাজারে যাবে, তখন ভোক্তাদের বেশি দামে কেনা ছাড়া উপায় থাকবে না। রপ্তানি বাজারে যেসব পণ্য যায়, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, সিরামিক, ওষুধসহ প্রায় সব খাতে উৎপাদন খরচ তখন বাড়বে। গত কয়েক মাস রপ্তানি প্রবৃদ্ধি সামান্য বেশি হলেও বাড়তি উৎপাদন খরচে পণ্যের দাম আরও বাড়বে। তখন বিশ্বক্রেতারা বাড়তি দাম দিতে কতটা প্রস্তুত, সে নিয়েও ঝুঁকি আছে। আর যদি রপ্তানি পণ্যের ক্রয়াদেশ কমে, তাহলে রপ্তানি কমে যাবে। তখন লোকসানে পড়ে কারখানা বন্ধ হওয়া, ছাঁটাইসহ নানা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও দেখছেন উদ্যোক্তারা।

বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, ‘দাম সরকার বাড়াতেই পারে। কিন্তু একসঙ্গে তিন গুণ বাড়ানো পৃথিবীর ইতিহাসে আছে কি না, আমার জানা নেই। এর ফলে উৎপাদন খাত যে সংকটে পড়বে, তা সহ্য করার ক্ষমতা শিল্পের আছে কি না, এ বিষয়ে আমি সন্দিহান। বিশ্ব অর্থনীতি এখন কী অবস্থায় আছে, এটাও ভাবার দরকার ছিল।’

দক্ষতা বাড়ানো হয়নি 
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ২০১৮-১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। সে বছর সিস্টেম লসে পুড়েছে ১০০৩ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস, যা তিতাসের কেনা মোট গ্যাসের ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। এই গ্যাসের মূল্য ৭৬৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অথচ এর আগের অর্থবছরে সিস্টেম লস ছিল মোট কেনা গ্যাসের ১ দশমিক ১৭ শতাংশ বা ২০১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ঘনমিটার; অর্থাৎ সিস্টেম লস বা অপচয় বাড়ছে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এমনিতেই মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। জ্বালানির দাম বাড়ায় এর প্রভাব উৎপাদনের ওপর, রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর, আমদানির প্রতিস্থাপক শিল্পের ওপরও পড়বে। শেষ পর্যন্ত সেটি মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা ভোক্তার চাপ আরও বাড়িয়ে দেবে; অথচ গ্যাস খাতের দক্ষতা বাড়ানো হয়নি। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত