দেশপ্রেমিক এক কর্মবীরের মহাপ্রয়াণ

মহিউদ্দিন খান মোহন
Thumbnail image

নিখাদ দেশপ্রেম ও মানবসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কর্মবীর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চলে গেলেন না-ফেরার জগতে। ১১ এপ্রিল রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরকে গণমুখী করার লক্ষ্যে আজীবন নিরলস কাজ করে যাওয়া এই মহান ব্যক্তির মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়েছে গোটা জাতি। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা কোনো দিন পূরণ হবে না।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৬৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর উচ্চশিক্ষার্থে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। সেখানে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন তিনি। কিন্তু ১৯৭১ সাল তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে যোগ দেন যুদ্ধে। ভারতের আসামের মেলাঘরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ডা. এম এ মবিনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই ফিল্ড হাসপাতাল আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষায় অসামান্য অবদান রাখে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর ফিল্ড হাসপাতালকে জনগণের হাসপাতালে রূপ দেওয়ার চিন্তা করেন। এই চিন্তাভাবনা থেকেই জন্ম নেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রথমে কুমিল্লায় ও পরে ঢাকার নিকটবর্তী জনপদ সাভারে জমি কিনে তিনি এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পথচলা শুরু করেন। দিনে দিনে তা এক মহিরুহের রূপ ধারণ করে। তাঁর কথা ছিল, কেউ যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় তা নিশ্চিত করা। বলতে দ্বিধা নেই, সে স্বপ্ন তিনি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হয়তো পারেননি। তবে তা যে অসম্ভব নয়, তার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন। ঢাকার ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে রোগীরা স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে চলেছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন, যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের কাউকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে না। তাঁর আরেকটি বড় কীর্তি জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন। সরকারকে প্রভাবিত করে তিনি সেটা করিয়েছিলেন। এটা যে কত বড় একটি কাজ, তা পরে আমাদের দেশীয় ওষুধশিল্পের বিস্ময়কর প্রসার থেকে অনুমান করা যায়।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেশপ্রেম কতটা নিখাদ ছিল তা বোঝা যায় যুদ্ধ শেষে পুনরায় লন্ডনে না গিয়ে দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি বেছে নেন সহজ-সরল সাধারণ জীবনযাপনের পথ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, লন্ডনে পড়া অবস্থায় বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন তিনি।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তাঁর চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন আনে। বিলাসী জীবনের পেছনে অর্থ ব্যয়কে তাঁর বাহুল্য মনে হতে থাকে। সেই অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করাকেই তিনি কর্তব্য বলে মনে করেন। ডা. জাফরুল্লাহ ইচ্ছা করলে স্বাধীনতার পর লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে পারতেন। তাঁর নামের পেছনে দেশি-বিদেশি হরেক রকম ডিগ্রি হয়তো শোভ পেত। কিন্তু তিনি শুধু এমবিবিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তার হয়েই থাকলেন। তবে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না হয়েও তিনি যে সফলতা অর্জন করেছেন, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। আজ গণমানুষের ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এক পরিচিত ও সমাদৃত নাম।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকেও বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, অপবাদ দিয়ে তাঁর ভাবমূর্তি বিনষ্টের অপচেষ্টা করা হয়েছে। স্বল্পমূল্যে করোনা টেস্টের কিট উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁর গণস্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তা নিয়ে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ যে ন্যক্কারজনক খেলা খেলেছে, তা শুধু দুঃখজনকই ছিল না, নিন্দনীয়ও বটে। অথচ ওই কিট আবিষ্কার করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যক্তিগত কোনো ফায়দা লুটতে চাননি; বরং বিদেশ থেকে কিট আমদানি করে অহেতুক বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেই কীর্তিমান মানুষটির সৎ উদ্দেশ্যকেও বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

শেষের দিকে রাজনৈতিক কারণে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। একসময়ের বামপন্থী ছাত্রনেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ২০১৮ সালে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে প্রধান নিউক্লিয়াসের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সেই প্রচেষ্টা কতটা সফল হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে। তবে তাঁর দৃষ্টিতে দেশে একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারবিরোধী একটি জাতীয় জোট অপরিহার্য ছিল। এটা কোনো অপরাধ ছিল না।

দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তার বাস্তবায়নে তিনি ও রকম উদ্যোগ-আয়োজনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতেই পারেন।এ জন্য তাঁকে কম হেনস্তা হতে হয়নি। সেই সময়ে হঠাৎ করে তাঁর বিরুদ্ধে জমি দখল, পুকুরের মাছ চুরির মতো বমি উদ্রেককারী অভিযোগ আনা হয়েছিল। অবাক হয়ে ভেবেছি, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশীর্বাদ নিয়ে তাঁরই প্রদত্ত জায়গায় গণস্বাস্থ্যের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। অথচ তাঁরই কন্যার আমলে সরকারের কতিপয় অতি উৎসাহী লোকের কারসাজিতে জাফরুল্লাহ হলেন চুরির মামলার আসামি! দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে!

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৯ সালের দিকে। সে সময় মাসিক গণস্বাস্থ্য নিয়মিত পড়তাম। ১৯৮০ সালের একটি ঘটনা। সেবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সম্ভবত ঢাকা মেডিকেল কলেজ জাসদ ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছিল। তাতে আহত হয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পত্রিকায় তাঁর রক্তাক্ত ছবি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এ নিয়ে আমি দৈনিক দেশ-এ (বর্তমানে লুপ্ত) একটি কলাম লিখেছিলাম ‘শহীদদের শ্রদ্ধার নমুনা’ শিরোনামে। তাতে মন্তব্য করেছিলাম, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণসভায় আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার ওপর এমন হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যারা ওই হামলা করেছে, শহীদদের প্রতি তাদের কতটুকু শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর নয়।

এ কথা ঠিক কয়েক বছর ধরে তিনি বর্তমান সরকারবিরোধী ভূমিকা পালন করছিলেন। তবে তা নিজের কোনো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নয়।দেশে একটি সাবলীল গণতান্ত্রিক ধারা প্রবহমান করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তিনি সব পক্ষ থেকেই সমালোচনা, অপমান-অপদস্থের শিকার হয়েছেন। স্পষ্টভাষী এই মানুষটি বিএনপিকে মাঝেমধ্যে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু দলটি তাঁর কোনো পরামর্শ তো গ্রহণ করেইনি, উল্টো তাঁকে অপদস্থ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ২০২১ সালের ২৬ জুন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের সংগঠন ‘এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ’-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বক্তৃতায় তিনি বিএনপির নেতৃত্ব সম্পর্কে পরামর্শমূলক কিছু কথা বলছিলেন। তাঁর বক্তৃতার মাঝখানেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক উদ্ধত কর্মী তাঁকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করে বক্তৃতা বন্ধ করতে বলে। মুখের ওপর এমন অপমানজনক ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কথা বাড়াননি। সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার হলো, বিএনপির ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহকে এহেন অপদস্থ করার পরও ওই ছাত্রদল কর্মীকে কোনো কৈফিয়তের মুখোমুখি হতে হয়নি।

সত্যবাদী স্পষ্টভাষীরা কখনোই কারও প্রিয় হতে পারেন না। ডা. জাফরুল্লাহ তাঁদেরই একজন। যা ভালো বুঝেছেন, সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন, অকপটে তা বলে দিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৩ এপ্রিল একটি দৈনিকে লিখেছেন, ‘তিনি দেশের কাছে একটা স্থায়ী স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবেন। ডা. জাফরুল্লাহকে আমরা একেকজন একেকভাবে মনে রাখব। যেহেতু তাঁর বহু পরিচয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে তাঁর যে পরিচয় ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে সেটা হলো, ডা. জাফরুল্লাহ সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের নতুন পরিচিতির রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছেন।’ অপর একটি দৈনিকে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ অর্থবহ একটি জীবন কাটিয়ে গেছেন।’

জীবন তো আমরা সবাই কাটিয়ে যাই, যাচ্ছি, যাব। কিন্তু কজন কাটাতে পারি আক্ষরিক অর্থে একটি অর্থবহ জীবন? সবাই পারে না। তা শুধু ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মানুষেরাই পারেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত