গ্রামীণ বিতর্ক: আইন কী বলে?

মামুন-অর-রশিদ
Thumbnail image

গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ড. এ কে এম সাইফুল মজিদ গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনামণ্ডলীর ১৫৫তম সভার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ টেলিকমে তিনজন এবং গ্রামীণ কল্যাণে দুজন পরিচালক মনোনয়ন দিয়েছেন।

এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক থেকে উভয় প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যানও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে মনোনীত চেয়ারম্যান এবং পরিচালকেরা মিরপুরে অবস্থিত গ্রামীণ টেলিকম ভবনে দায়িত্ব নিতে গেলে বর্তমানে কর্মরত গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালকদের সঙ্গে বিবাদপূর্ণ পরিস্থিতির তৈরি হয়।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ টেলিকম ভবনে অবস্থিত ইউনূস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলন করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা। সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান এবং পরিচালক পদে তাঁদের নিজস্ব ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশবাসীর কাছে হয়রানি করা এবং বিশ্বব্যাপী তাঁর গ্রহণযোগ্য সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার নীলনকশা ও পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এমন পরিস্থিতিতে এই প্রশ্ন আসা খুবই স্বাভাবিক যে গ্রামীণ ব্যাংক কোন ক্ষমতাবলে ওই প্রতিষ্ঠান দুটিতে চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ দিল, কী তার আইনি ভিত্তি? গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ কল্যাণের প্রকৃত মালিক কিংবা নিয়ন্ত্রণকারী আইনত কারা? এই উত্তর পেতে হলে আমাদের জানতে হবে ওই প্রতিষ্ঠান দুটির গঠনপ্রক্রিয়া।

১৯৯৪ সালের ১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৩৭তম বোর্ড সভায় গ্রামীণ ব্যাংককে অন্যান্য বিনিয়োগকারীকে সঙ্গে নিয়ে একটি কনসোর্টিয়ামে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় এবং একই সঙ্গে গ্রামীণফোন নামের একটি পৃথক ‘নট ফর প্রফিট’ কোম্পানি স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৯৫ সালের ৮ অক্টোবর ‘কোম্পানি আইন-১৯১৪’ অনুযায়ী, ‘গ্রামীণ টেলিকম’ নামে একটি কোম্পানি তৈরি করা হয়।

কোম্পানির মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমে সর্বোচ্চ ২৫ জন সদস্য থাকবেন এবং এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক সর্বোচ্চ ১০ জনকে মনোনীত করতে পারবে। এ ছাড়া গ্রামীণ টেলিকমের আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন ৩২ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ১০ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পরিষদের তিনজন সদস্য মনোনয়ন দেবে। আর ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংক মনোনীত একজন ব্যক্তি।

১৯৯৫ সালের ১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ৪১তম বোর্ড সভায় ‘গ্রামীণ টেলিকম’ নামে পৃথক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদকে অবহিত করা হয়। ওই সভায় গ্রামীণ টেলিকমকে গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল ‘এসএএফ’ ফান্ড থেকে ১১ শতাংশ সরল সুদে ৩০ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ওই সভায় আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে ‘এসএএফ’ ফান্ড থেকে প্রদত্ত ঋণের জন্য ১১ শতাংশ সুদ প্রদান ছাড়াও গ্রামীণ টেলিকম তার লভ্যাংশের অন্ততপক্ষে ৫০ ভাগ ‘এসএএফ’ ফান্ডকে প্রদান করবে। তাই এটি অনস্বীকার্য যে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এবার আসা যাক, গ্রামীণ কল্যাণের বিষয়ে। ১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ৪২তম বোর্ড সভায় গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও কর্মীদের কল্যাণের জন্য ‘কোম্পানি আইন-১৯৯৪’-এর আওতায় ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ওই সভায় আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ প্রতিষ্ঠার পর গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণদানের জন্য অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত টাকা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ‘এসএএফ’ ফান্ডের টাকা গ্রামীণ কল্যাণে হস্তান্তর করা হবে।

১৯৯৬ সালের ৪ নভেম্বর ‘কোম্পানি আইন-১৯৯৪’-এর আওতায় ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল অনুযায়ী, গ্রামীণ কল্যাণে সর্বোচ্চ ২৫ জন সদস্য থাকবেন এবং এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক সর্বোচ্চ ১০ জনকে মনোনীত করতে পারবে। গ্রামীণ কল্যাণের আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন ৩২ অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ৯ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পরিষদের দুজন সদস্য মনোনয়ন প্রদান করবে এবং ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান হবেন গ্রামীণ ব্যাংক মনোনীত একজন ব্যক্তি।

১৯৯৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর দাতাদের কাছ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাপ্ত অনুদানের ৩৪৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল ‘এসএএফ’ ফান্ডের ৪৪ দশমিক ২৫ কোটি টাকা গ্রামীণ কল্যাণে স্থানান্তর করা হয়। পরে দাতা সংস্থা নরাদের (NORAD) আপত্তির কারণে ১৯৯৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং ২০০৩ সালের ১ নভেম্বর দুই দফায় অনুদানের ৩৪৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরিয়ে আনা হলেও, ‘এসএএফ’ ফান্ডের অর্থ ফেরত আনা হয়নি। উপরন্তু ১৯৯৬ সালের পর Imputed Interest-এর আরও ২৫ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা গ্রামীণ কল্যাণকে দেওয়া হয়; অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণে প্রদত্ত মোট অর্থের পরিমাণ ৬৯ দশমিক ৮২ কোটি টাকা। অতএব এটি অনস্বীকার্য যে গ্রামীণ কল্যাণ গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের কল্যাণে কাজ করার উদ্দেশ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল ‘এসএএফ’ ফান্ডের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

অতএব এটি পরিষ্কার যে গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ কল্যাণ উভয় প্রতিষ্ঠানই গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তায় তৈরি হয়েছিল। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনেই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবেই ওই প্রতিষ্ঠান দুটির চেয়ারম্যান নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইস্তফা দিলেও তিনি এই প্রতিষ্ঠান দুটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়েননি।

উল্লেখ্য, ২০২০ সাল পর্যন্তও এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে গ্রামীণ ব্যাংক মনোনীত পরিচালকেরা ছিলেন। অতএব গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ কল্যাণে চেয়ারম্যান এবং পরিচালক নিয়োগে কোনো আইনি ব্যত্যয় ঘটেনি; বরং ড. মুহাম্মদ ইউনূসই বিধিবহির্ভূতভাবে ওই প্রতিষ্ঠান দুটিতে চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত