ছাদে হবে সবজির চাষ

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৭: ৩৫
আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৭: ০৯

শহুরে জীবনযাপনের অংশ হয়ে উঠেছে কৃষি। শখ ও প্রয়োজন—দুটোই মিটছে এ থেকে। বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দা ভরে উঠছে সবজি ও ফুলের গাছে। ছাদ বেশ প্রশস্ত এবং ভালো রোদ পাওয়া যায় বলে বাগান করার জন্য সেটি উত্তম জায়গা।

কোন সবজির বাগান
ছাদে প্রায় সব ধরনের সবজি উৎপাদন সম্ভব। তবে অল্প সময়ে উৎপাদনের জন্য ভালো হবে লালশাক, পালংশাক, ধনেপাতা, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, কলমিশাক ইত্যাদি। আর একটু বড় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, করলা, শিম, লাউ, পটোল, বরবটি, শসার উৎপাদন অনেকটাই সহজ।

বীজ বিষয়ে
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শাকের বীজ অনলাইন, অফলাইন—দুভাবেই কেনা যায়। তবে যেটাই কিনুন না কেন, ভালো জাত ও জার্মিনেশন রেট ভালো দেখে কিনুন। চারা কিনলেও জাতের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। নইলে দিন শেষে পরিশ্রমটাই বৃথা যেতে পারে। কারণ, ভালো জাতের বীজ বা চারা না হলে যত্ন করেও ভালো ফসল না পাওয়ার আশঙ্কা আছে।

বীজ বপনের আগে
প্রথমে বীজ মিনিট বিশেক রোদে রাখুন। তারপর  কিছুটা সময় ছায়ায় রেখে দিন। এরপর যেটা করবেন তা হলো, এক রাত ছত্রাকনাশক মেশানো পানিতে ভিজিয়ে রেখে টিস্যু বা কাপড়ে পেঁচিয়ে একটা বাক্সে ভরে রাখুন। বাক্সটা একটু গরম জায়গায় রাখতে পারলে ভালো।শিকড় গজানো বীজ মিডিয়ায় লাগালে তা দ্রুত বড় হবে। সরাসরি বীজ মিডিয়ায় লাগালে অনেক সময় তা গজাতে পারে না। জার্মিনেশন রেট কম হয়। তাতে ফসল খাওয়ার উপযোগী হতে সময় লাগবে অনেক বেশি। তবে লালশাকের বীজ ছত্রাকনাশক মেশানো পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে তারপর লাগানো যায়। এক রাত ভিজিয়ে না রাখলে তেমন সমস্যা নেই।

গাছ রোপণের পাত্র
অল্প জায়গায় বেশি বা একাধিক সবজি একই সঙ্গে চাষের জন্য জিও ব্যাগের বেড উত্তম; বিশেষ করে শাকজাতীয় সবজির চাষ করতে চাইলে। জিও ব্যাগের বেড লম্বা ও প্রশস্ত। গভীরতা যতটুকু, তা সবজি চাষের জন্য উপযুক্ত। লাউ, শিম, শসাজাতীয় লতানো গাছের বেড তৈরির জন্য ফলের ক্রেট, ড্রাম, বস্তার ব্যবহার ভালো। এই গাছগুলোর শিকড় গভীরে যেতে পছন্দ করে। দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদনে থাকে বলে এগুলোর খাবারও লাগে বেশি। এ ছাড়া পানি বা তেলের জার (পাচ লিটার কিংবা তার চেয়ে বড়), টব ইত্যাদিতেও সবজির চাষ করা সম্ভব। 

পানিনিষ্কাশন
ছাদকৃষিতে ব্যর্থতার বড় কারণ পাত্রে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা সঠিকভাবে না থাকা। পাত্রের নিচে কয়েকটি ফুটো করে দিতে হবে। তারপর সুরকি বা খোলামকুচি দেওয়া যেতে পারে। পাত্রটি ড্রাম হলে কয়েকটি ইটের ওপর বসালে ভালো। তাহলে ছাদে ময়লা কম হবে। পানিনিষ্কাশন কেমন হচ্ছে তা বুঝতে পারা যাবে।

মিডিয়া
গাছের জন্য সবচেয়ে বেশি পুষ্টির উপাদান থাকে পাতা পচা সারে। এরপর কেঁচো সার এবং পরের অবস্থান গোবর সারের। পাতা পচা সার সহজলভ্য নয় বলে দাম বেশি। কেঁচো ও গোবর সার সহজলভ্য। দামেও সস্তা। মাটিতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কেঁচো বা গোবর সার, একটু ছত্রাকনাশক, নিম খৈল, হাড়ের গুঁড়া, শিংকুচি, সরিষার খৈল দিতে হবে। পাশাপাশি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কোকোপিট বা কোকো ডাস্ট দেওয়া যেতে পারে। ২০ শতাংশ দিলেও ক্ষতি নেই। এই দুটি উপাদান মিডিয়ায় আর্দ্রতা ধরে রাখবে। ওজনে হালকা বিধায় তাতে ছাদের ওপর চাপ কম পড়বে। গাছ দ্রুত শিকড় ছড়িয়ে দিতে পারবে। মাটি হবে ঝরঝরে। দলা পাকানো, আঠালো বা শক্ত নয়। এ জন্য একটু বালি (ধোয়া সিলেটী বালি) দিলে ক্ষতি নেই। সবকিছু দিয়ে মিডিয়া প্রস্তুত করে কমপক্ষে দিন দশক রেখে দিন। এরপর সবজির বীজ লাগালে দ্রুত বড় হবে। 

বেশি ফলন পেতে
লাউ, শিম, বরবটি, শসা ইত্যাদি গাছ গোড়া থেকে ১০ পাতা হলে ডগা কেটে দিন। তাহলে বেশি শাখা-প্রশাখা বের হবে এবং ফলন হবে বেশি। এভাবে ডগা কেটে ছাদের অল্প জায়গায় গাছ ছোট কিন্তু ঝোপালো রেখে ফসল তুলে নিতে হবে।

যা করবেন না

  • অল্প জায়গায় বেশি গাছ লাগানো যাবে না। এতে খাদ্যের অভাবে গাছে আশানুরূপ ফল আসবে না।
  • পানি দিতে হবে পরিমিত। এতে মাটি আর্দ্র থাকবে। গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না। লাগাতার বৃষ্টি হলে শেড দিতে পারেন।
  • কৃষিতে একদম নতুন হলে দু-একটি সবজি দিয়ে শুরু করতে হবে।
  • কাঁচা গোবর ও বৃষ্টির সময় সরিষার খৈল পচানো পানি সবজিগাছের গোড়ায় দেওয়া যাবে না।
  • ধারালো চাকু দিয়ে কেটে নিতে হবে সবজি, ছিঁড়ে নয়। 

গাছের জন্য জৈব টোটকা

  • মাটি থেকে গাছ প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে। কিন্তু মাটিতে ক্ষতিকারক ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। মাটি শোধনের জন্য চুন ও বায়োডার্মা সলিড ব্যবহার করা যায়। চুন মাটির পিএইচ মান ঠিক রাখে। অন্যদিকে বায়োডার্মা সলিড হলো জৈব ছত্রাকনাশক। এটি মাটিতে বসবাসকারী ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, নেমাটোডকে মেরে ফেলে।
  • রসুন ও গোল মরিচবাটা পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করলে অনেক ক্ষতিকর পোকা দূর হবে।
  • যাঁরা মরিচ চাষ করেন, বিশেষ করে বোম্বাই মরিচ, তাঁরা কাপড়ে ন্যাপথলিন পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে দিন গাছের আশপাশে। এতে পোকা কম আসবে। তা ছাড়া নিমপাতা বেটে এর রস পানিতে গুলে গাছের পাতায় স্প্রে করলে পোকার উপদ্রব কমবে। এভাবে সপ্তাহে অন্তত এক দিন গাছে স্প্রে করুন।
  • খেয়াল করলে দেখবেন, টমেটোসহ অন্যান্য ফলের নিচের অংশ পচে যায়। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে খাওয়ার চুন পানিতে গুলে মাটিতে দিন। মূলত ক্যালসিয়ামের অভাবে এমনটা হয়।
  • লাউ ও শসাগাছের পাতার নিচে পোকা বসবাস করে। সাদা কাগজ নিয়ে পাতার নিচে ঘষলে এসব পোকা মরে যাবে।
  • সাদা মাছি বা শুঁয়োপোকা দমনে হলুদ কাপড়ে আঠা লাগিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখুন।
  • শীতকালে কুয়াশার কারণে গাছের পাতায় ছত্রাক বাসা বাঁধে। এ জন্য গাছে পানি দেওয়ার সময় সজোরে পাতার ওপর ও নিচে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
  • অতিরিক্ত রোদ বা উত্তাপ হলে গাছের গোড়া মালচিং পেপারে ঢেকে দিতে হবে। গাছের পাতা দুপুরের দিকে নেতিয়ে পড়লেও চিন্তার কিছু নেই। বিকেলের দিকে পানি দিলে ঠিক হয়ে যাবে।
  • পুকুর ও খালের কাদা গাছের গোড়ায় দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
  • বছরে অত্যন্ত তিনবার জিব্রালিক অ্যাসিড গুলে সেই পানি গাছের মাটিতে দিতে হবে। এটি কোনো রাসায়নিক সার নয়। এটি গাছের খাদ্য গ্রহণের সক্ষমতা বাড়ায় এবং ফুল ফুটতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ফুল ও ফল ঝরা বন্ধ করে।
  • শক্তপোক্ত গাছের জন্য পটাশ খুব দরকার। এ জন্য কলার খোসা শুকিয়ে তা গাছের মাটিতে দেওয়া যায়। আবার কলার খোসা ভিজিয়ে সেই পানি গাছের গোড়ায় দিলে পটাশের অভাব দূর হবে।
  • প্রতি ১৫ দিনে একবার সরিষার খৈল পচা পানি গাছে দিলে তাদের বৃদ্ধি ভালো হবে। তবে বৃষ্টির সময় এটি দেওয়া যাবে না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত