আনোয়ারুল হক
অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামনে প্রকৃত অর্থেই এক নবযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল এক নতুন ভোরের সূর্যোদয়। কিন্তু ছয় মাস না পেরোতেই আশা ফিকে হয়ে আসছে। ঈষান কোণের কালো মেঘ তার বিস্তার ঘটাচ্ছে। সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে অস্থিরতা, বিভাজন, বিদ্বেষ বিরাজ করছে। প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার সম্পন্ন করার কাজকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণকে অহেতুক বিলম্বিত করার একটা প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সুন্দরভাবে ও ধীরস্থিরভাবে গুছিয়ে বলা তাঁর কথা মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু তাঁর ‘নিয়োগকর্তারা’ যা বলছেন, যা করছেন, তার মধ্যে তো দেশবাসী পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখতে পাওয়ার আশঙ্কা করছে। তাঁদের সব দাবি বা আবদারের সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বয়ানের সঙ্গে যারা একমত হবে না, তাদের পতিত স্বৈরাচারকে পুনর্বাসিত করার প্রচেষ্টাকারী হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ণ করা। আর গণতান্ত্রিক সমাজ হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা ছাত্রসংগঠন, নাগরিক কমিটি ইত্যাদি গড়ে তুলছেন বুকের ছাতি ফুলিয়ে, তাঁরা হুমকি-ধমকিও দিচ্ছেন। কারা বাংলাদেশে থাকতে পারবেন আর কারা পারবেন না—এ ধরনের প্রতিক্রিয়াও তাঁদের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।
অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পরে তাঁদের মনে হলো জুলাই ‘বিপ্লব’-এর ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে হবে। অথচ ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাই তো ঘোষণা। এখন আবার ‘ঘোষণা ঘোষণা’ করে মাতামাতিকে চালাকি মনে হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ৮ আগস্টেই বলেছেন ’৭১ নিয়েই তো ’২৪। এই সেদিনও সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা।’ এখন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ২০২৪-এর ঘটনাবলি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার এক কৌশলী প্রয়াস ‘জুলাই ঘোষণা’ নিয়ে নানা নাটক ও দরবার চলছে। তাঁদের খসড়া ঘোষণায় ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বলা হচ্ছে, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার ধারায় প্রণীত সংবিধান হয়েছিল ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার জন্য। এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেটাকেই আবার বলা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।
এ কথা ঠিক, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে বা স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী সংবিধানের ওপর কাঁচি চালিয়ে সংবিধানের গণতান্ত্রিক ধারাসমূহে যে বিকৃতি ঘটিয়েছে, তা অবশ্যই মেরামত বা সংস্কারের দাবি রাখে। কিন্তু সংস্কারের নামে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের মর্মবস্তুই পাল্টে ফেলার ম্যান্ডেট তাঁদের কে দিল?
আশির দশকের এক ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’, মার্কিন অধ্যাপক তো এক বিরাট বিশেষ দায়িত্ব পেয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে দেশে এসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে কি এক ‘জন গণ মন (!) বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছেন। এমন দাবি তো এ দেশে কখনো উচ্চারিত হয়নি। এমনকি তিনি ‘বাঙালি’ জাতির অস্তিত্বকে সাংবিধানিকভাবে মুছে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতি ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকবে অথচ বাঙালি জাতি বা জাতীয়তাবাদ থাকবে না? নাগরিকত্বের পরিচয়ে একটা জাতির অস্তিত্বকে মুছে ফেলা হবে!
যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে দেশে পাহাড় ও সমতলে যে যে ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রয়েছে, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে, সব ধর্মের মানুষের সম-অধিকারের নিমিত্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি। অথচ এই স্বীকৃতি দাবি করলে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তাদের রক্তাক্ত করা হবে এবং হামলাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে না, এটা তো দ্বিচারিতা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে বিতর্ক, সংস্কারের পরিবর্তে নতুন করে বৃহৎ আকারে বিভাজন তৈরি করে ফেলছে। এক বর্ণচোরা গোষ্ঠী তাদের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে আড়াল করতে ৭১-কে ডিলিট করে ২৪-কে প্রতিস্থাপনের মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ১৯৪৭, মাঝখানে ভারতীয় ষড়যন্ত্রে ১৯৭১ এক দুর্ঘটনা এবং এর পরে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী জবরদস্তিমূলক শাসনের বিরুদ্ধে এক মাসের রক্তক্ষয়ী এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন স্বাধীনতা! কিন্তু ইতিহাস কি তাই বলে? ‘নতুন স্বাধীনতা’?
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে-বিদেশে তাঁর বক্তব্যে বলেন এবারের সংগ্রামে ছাত্র-ছাত্রীদের আঁকা গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রেই জাতির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। কী আছে সে গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রে? (ছবি দেখুন)
এই কয়েকটি গ্রাফিতিই কি যথেষ্ট নয় এটা বোঝার জন্য যে ২০২৪-এর ছাত্র-তরুণেরা কোন বাংলাদেশের ছবি এঁকেছিলেন। তাঁরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ফিরে গেছেন। ফিরে যাননি তাঁরা, যাঁরা নতুন রাজনৈতিক শক্তি বা দল গঠন করতে চাইছেন। নতুন এক পরিস্থিতিতে নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ হতেই পারে। কিন্তু দল গঠন প্রক্রিয়ায় যাঁরা আছেন তাঁদেরকে অবশ্যই ২০২৪-এর এই সাধারণ ছাত্র-তরুণদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে হবে। তাঁদের এটা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, এক মাসের সংগ্রামেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়নি। এক দশকের বেশি সময়ের হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন, ফ্যাসিস্টিক কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন, নিপীড়ন, বিরোধী দলবিহীন কারচুপির নির্বাচন, আর্থিক খাতে সীমাহীন লুণ্ঠন ও অর্থ পাচার সরকারকে কার্যত জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। একটা গণ-অভ্যুত্থানের জন্য উর্বর জমিন পতিত সরকারই সৃষ্টি করে রেখেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর যখন নির্বিচার হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, তখন শিক্ষক, অভিভাবক, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর নির্বিশেষে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ সরকার পতনের আন্দোলনে শামিল হয়ে বিজয়কে নিশ্চিত করেন। এইসব অংশীজনের পচ্ছন্দমতো ভোট প্রদান ও সরকার গঠনের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি।
মনে রাখা প্রয়োজন, ভোটের রায় কার্যকর না করায় বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। শেখ হাসিনা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ায় তাঁকে করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হলো। তাই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠনে অহেতুক বিলম্ব দেশকে নতুন করে আবার এক অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিতে পারে। দেশের শিকড় মুক্তিযুদ্ধকে পরাভূত করতে চাইলে ২০২৪-এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও শিশু-কিশোর-তরুণসহ হাজারো মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা-ভালোবাসা কিন্তু সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের দিকে যাবে। রাজনীতি একটি নির্মম ক্ষেত্রও বটে। সন্দেহ-অবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কেউ আবার এসে বলতে পারে, ‘রিসেট বাটন পুশড, এভরিথিং গন!’
লেখক: সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামনে প্রকৃত অর্থেই এক নবযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল এক নতুন ভোরের সূর্যোদয়। কিন্তু ছয় মাস না পেরোতেই আশা ফিকে হয়ে আসছে। ঈষান কোণের কালো মেঘ তার বিস্তার ঘটাচ্ছে। সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে অস্থিরতা, বিভাজন, বিদ্বেষ বিরাজ করছে। প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার সম্পন্ন করার কাজকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণকে অহেতুক বিলম্বিত করার একটা প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সুন্দরভাবে ও ধীরস্থিরভাবে গুছিয়ে বলা তাঁর কথা মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু তাঁর ‘নিয়োগকর্তারা’ যা বলছেন, যা করছেন, তার মধ্যে তো দেশবাসী পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখতে পাওয়ার আশঙ্কা করছে। তাঁদের সব দাবি বা আবদারের সঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বয়ানের সঙ্গে যারা একমত হবে না, তাদের পতিত স্বৈরাচারকে পুনর্বাসিত করার প্রচেষ্টাকারী হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ণ করা। আর গণতান্ত্রিক সমাজ হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা ছাত্রসংগঠন, নাগরিক কমিটি ইত্যাদি গড়ে তুলছেন বুকের ছাতি ফুলিয়ে, তাঁরা হুমকি-ধমকিও দিচ্ছেন। কারা বাংলাদেশে থাকতে পারবেন আর কারা পারবেন না—এ ধরনের প্রতিক্রিয়াও তাঁদের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে।
অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পরে তাঁদের মনে হলো জুলাই ‘বিপ্লব’-এর ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে হবে। অথচ ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাই তো ঘোষণা। এখন আবার ‘ঘোষণা ঘোষণা’ করে মাতামাতিকে চালাকি মনে হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ৮ আগস্টেই বলেছেন ’৭১ নিয়েই তো ’২৪। এই সেদিনও সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা।’ এখন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ২০২৪-এর ঘটনাবলি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার এক কৌশলী প্রয়াস ‘জুলাই ঘোষণা’ নিয়ে নানা নাটক ও দরবার চলছে। তাঁদের খসড়া ঘোষণায় ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বলা হচ্ছে, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার ধারায় প্রণীত সংবিধান হয়েছিল ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার জন্য। এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেটাকেই আবার বলা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য।
এ কথা ঠিক, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে বা স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের সামরিক-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠী সংবিধানের ওপর কাঁচি চালিয়ে সংবিধানের গণতান্ত্রিক ধারাসমূহে যে বিকৃতি ঘটিয়েছে, তা অবশ্যই মেরামত বা সংস্কারের দাবি রাখে। কিন্তু সংস্কারের নামে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের মর্মবস্তুই পাল্টে ফেলার ম্যান্ডেট তাঁদের কে দিল?
আশির দশকের এক ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’, মার্কিন অধ্যাপক তো এক বিরাট বিশেষ দায়িত্ব পেয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে দেশে এসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে কি এক ‘জন গণ মন (!) বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছেন। এমন দাবি তো এ দেশে কখনো উচ্চারিত হয়নি। এমনকি তিনি ‘বাঙালি’ জাতির অস্তিত্বকে সাংবিধানিকভাবে মুছে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ জাতি ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকবে অথচ বাঙালি জাতি বা জাতীয়তাবাদ থাকবে না? নাগরিকত্বের পরিচয়ে একটা জাতির অস্তিত্বকে মুছে ফেলা হবে!
যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে দেশে পাহাড় ও সমতলে যে যে ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রয়েছে, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে, সব ধর্মের মানুষের সম-অধিকারের নিমিত্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি। অথচ এই স্বীকৃতি দাবি করলে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তাদের রক্তাক্ত করা হবে এবং হামলাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে না, এটা তো দ্বিচারিতা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে বিতর্ক, সংস্কারের পরিবর্তে নতুন করে বৃহৎ আকারে বিভাজন তৈরি করে ফেলছে। এক বর্ণচোরা গোষ্ঠী তাদের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে আড়াল করতে ৭১-কে ডিলিট করে ২৪-কে প্রতিস্থাপনের মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ১৯৪৭, মাঝখানে ভারতীয় ষড়যন্ত্রে ১৯৭১ এক দুর্ঘটনা এবং এর পরে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী জবরদস্তিমূলক শাসনের বিরুদ্ধে এক মাসের রক্তক্ষয়ী এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন স্বাধীনতা! কিন্তু ইতিহাস কি তাই বলে? ‘নতুন স্বাধীনতা’?
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে-বিদেশে তাঁর বক্তব্যে বলেন এবারের সংগ্রামে ছাত্র-ছাত্রীদের আঁকা গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রেই জাতির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। কী আছে সে গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রে? (ছবি দেখুন)
এই কয়েকটি গ্রাফিতিই কি যথেষ্ট নয় এটা বোঝার জন্য যে ২০২৪-এর ছাত্র-তরুণেরা কোন বাংলাদেশের ছবি এঁকেছিলেন। তাঁরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ফিরে গেছেন। ফিরে যাননি তাঁরা, যাঁরা নতুন রাজনৈতিক শক্তি বা দল গঠন করতে চাইছেন। নতুন এক পরিস্থিতিতে নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ হতেই পারে। কিন্তু দল গঠন প্রক্রিয়ায় যাঁরা আছেন তাঁদেরকে অবশ্যই ২০২৪-এর এই সাধারণ ছাত্র-তরুণদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে হবে। তাঁদের এটা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, এক মাসের সংগ্রামেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়নি। এক দশকের বেশি সময়ের হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন, ফ্যাসিস্টিক কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন, নিপীড়ন, বিরোধী দলবিহীন কারচুপির নির্বাচন, আর্থিক খাতে সীমাহীন লুণ্ঠন ও অর্থ পাচার সরকারকে কার্যত জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। একটা গণ-অভ্যুত্থানের জন্য উর্বর জমিন পতিত সরকারই সৃষ্টি করে রেখেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর যখন নির্বিচার হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, তখন শিক্ষক, অভিভাবক, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর নির্বিশেষে এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ সরকার পতনের আন্দোলনে শামিল হয়ে বিজয়কে নিশ্চিত করেন। এইসব অংশীজনের পচ্ছন্দমতো ভোট প্রদান ও সরকার গঠনের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি।
মনে রাখা প্রয়োজন, ভোটের রায় কার্যকর না করায় বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। শেখ হাসিনা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ায় তাঁকে করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হলো। তাই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠনে অহেতুক বিলম্ব দেশকে নতুন করে আবার এক অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিতে পারে। দেশের শিকড় মুক্তিযুদ্ধকে পরাভূত করতে চাইলে ২০২৪-এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও শিশু-কিশোর-তরুণসহ হাজারো মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা-ভালোবাসা কিন্তু সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের দিকে যাবে। রাজনীতি একটি নির্মম ক্ষেত্রও বটে। সন্দেহ-অবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কেউ আবার এসে বলতে পারে, ‘রিসেট বাটন পুশড, এভরিথিং গন!’
লেখক: সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
বাংলাদেশ যখন সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী তখন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশে তার ভূমিকা কার্যত পরিত্যাগ করে সে ক্ষেত্রে ঢাকা চীনের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠতে পারে এবং তাহলে বেইজিং নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশকে আরও বেশি অর্থায়ন ও ঋণ দেবে।
৮ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের জাতীয় জনসংখ্যা দিবস প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। এই দিবসটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা এবং টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালন করা হয়। ২০২৫ সালে এই দিবসটি আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কারণ, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত
১২ ঘণ্টা আগেযোদ্ধা ও ভিক্ষুকের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং চরিত্র নিয়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি অসাধারণ লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটি নানা কারণেই একটা বড় চিন্তার বিষয় হয়ে পড়েছে। যদিও এসব কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এমন তুলনামূলক বিশ্লেষণ কখনোই সেভাবে আসেনি।
১ দিন আগেঘুণে ধরা সমাজ বা কাঁচা বাশে ঘুণে ধরার কথা দৈনন্দিন জীবনে আমরা কে না শুনেছি? আবার ঘুণাক্ষরে টের না পাওয়ার বিষয়টিও আমরা কমবেশি শুনেছি। নেতিবাচক অর্থে এই ঘুণে ধরার বিষয়টি আমাদের সমাজব্যবস্থায় যেন পাকাপোক্ত স্থান করে নিয়েছে।
১ দিন আগে