স্বপ্না রেজা
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয় অর্জিত হয় লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, লাখো নারীর সম্ভ্রমহানি ও বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পরাধীনতার শিকলে নিষ্পেষিত করার পাঁয়তারা ছিল তৎকালীন পশ্চিমা পাকিস্তানিদের। রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে—এমন চিন্তা-চেতনাকে মেনে নিতে পারেনি পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং স্বাধিকারের জন্য ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নিরস্ত্র বাঙালি পাকিস্তিনি সেনাদের মোকাবিলা করে পূর্ব বাংলাকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন করে, যার নামকরণ হয় বাংলাদেশ। লাল-সবুজের পতাকার জন্ম হয়।
এটা না বললেই নয়, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছিল, বিজয়ের ৫৩ বছর পর আজও তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণটা কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দৃশ্যমান হয়ে রয়েছে। আর সেটি হলো, বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে রাজনৈতিক দল যখনই ক্ষমতায় বসেছে বা ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখনই যেন তাদের হীন স্বার্থের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে ক্রমেই। তারা প্রকৃতার্থে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থের কথা ভাবেনি, ভাবতে পারেনি যতটা না ভেবেছে বা ভাবতে স্বতঃস্ফূর্ত থেকেছে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কথা। ফলে অভাগা থেকে গেছে সাধারণ জনগণ তথা সাধারণ নাগরিক। আর বিপর্যস্ত হয়েছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং আমাদের পবিত্র সংবিধান।
সাধারণত দেখা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সাফল্য বয়ান ও গীত গাইতে যতটা তৎপর ও সক্রিয় থাকে এবং এ বিষয়ে যতটা ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায়, তা যেন নিমেষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং সেটা দেখা যায় তাদের ক্ষমতা অবসানের পরবর্তী পর্যায়ে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই। যার কারণে মানচিত্রে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় সুস্পষ্ট হলেও বিজয়ের ৫৩ বছর পরও বিজয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এটাই চরম হতাশার, দুঃখজনক তো বটেই।
বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবিটা কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকেই বাঙালির মনেপ্রাণে জাগরিত ছিল। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন চালিয়েছে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। বঞ্চনা রোধে বাঙালি ছাত্র-জনতা পিছপা হয়নি, উপরন্তু মুক্তি ও স্বাধিকারের তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজকের যে বাংলাদেশ ও তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বিশ্ব মানচিত্রে, তা এমনি এমনিই হয়নি, অর্জন করতে হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। তবে না বললেই নয় যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় মিললেও বৈষম্য বিষয়টি দূর হয়নি পুরোপুরিভাবে। বরং রয়ে গেছে, রয়ে যাচ্ছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কারণেই।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই শ্রেণি-গোষ্ঠী কোনোভাবেই কখনোই দেশপ্রেমিক ছিল না। দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারেনি, হয়ে উঠবেও না সম্ভবত। এই শ্রেণি ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র পরিচালনার সব প্রক্রিয়াকে বা সিস্টেমকে নিজেদের স্বার্থ-উপযোগী করে তোলে এবং সেই অবস্থাকে জিইয়ে রাখে যেন ক্ষমতায় তারা সুরক্ষিত থাকে বছরের পর বছর। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা যে এ দেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের জন্য চরম হুমকি, এমন সত্য যুগ যুগ ধরে বারবার উদ্ঘাটিত হলেও মেনে নিতে পারেনি ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বিভোর থেকেছে দলীয় ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থে। এই হীনস্বার্থপরতায় ‘দুর্নীতি’র মতো ভয়ংকর ব্যাধি বাসা বাঁধতে সুযোগ পেয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রসহ সব প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ায়। ফলে বৈষম্য থেকে গেছে, প্রসারিত হয়েছে।
৫৩ বছর পর কি যাবতীয় বৈষম্য দূর করা সম্ভব—এমন প্রশ্ন কমবেশি সবার। যে বৈষম্যপ্রক্রিয়া ‘দুর্নীতি’র মতো মহাব্যাধিতে রাষ্ট্রকে আক্রান্ত করেছে, দেশ ও জাতিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সেই প্রক্রিয়াকে আগে ঠিক করা দরকার। প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের শুধু সরিয়ে ফেললেই সমস্যার সমাধান হবে না, সেই সঙ্গে প্রক্রিয়াকে সংবিধান সমর্থিত, আইনসিদ্ধ ও জনকল্যাণমুখী করা জরুরি। পাশাপাশি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আনুগত্য প্রকাশের জন্য ও তার অনুকূলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির জন্য আইন প্রয়োগ যথাযথভাবে হওয়া দরকার। দরকার ব্যাপক প্রচার, প্রচারণা। নৈতিকতা ও সততার সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ, পরিস্থিতি নিশ্চিত করা। সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, দেশের প্রতি দায়বোধ, দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্য, নৈতিকতাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা ও তার চর্চা এবং বাস্তবায়ন। এটা বলাবাহুল্য যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এ দেশে চোখে পড়লেও উপযুক্ত ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং এ নিয়ে অনেক অভিযোগ ও সুপারিশ উত্থাপিত হয়েছে বারবার।
সামাজিক অবক্ষয় ও নীতিবহির্ভূত কার্যকলাপের জন্য অনেকেই অনুপযুক্ত ও অনুন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকে। এটা দৃশ্যমান সত্য যে, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখন সেই দলটি তার মতো করেই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তৎপর থেকেছে, সাজিয়েছে। এই জায়গাটি আর নির্দলীয় হতে পারেনি। সর্বজনীন হতে পারেনি। রাজনীতিকরণ ও অদক্ষ, অযোগ্য ব্যক্তি দ্বারা এই সেক্টর পরিচালনার বিষয়টিও দুঃখজনক পরিস্থিতি এবং তার ফলাফলের সম্মুখীন করেছে গোটা জাতি ও তার ভবিষ্যৎকে। এর ফলে শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তক পর্যন্ত সর্বত্র দলীয় রাজনীতির মরণ ছোবল পড়েছে এবং সংশ্লিষ্টরা ক্রমেই স্বার্থবাদীতে পরিণত হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
বিভাজন ও দোষারোপের রাজনীতি ‘বৈষম্য’কে ত্বরান্বিত, প্রসারিত ও স্থায়ীকরণে যথেষ্ট সহায়তা করে আসছে। আর স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ ও দলীয়করণ বিষয়গুলো বৈষম্যমূলক আচরণ ও ব্যবস্থারই ফলাফল। এতে যোগ্য, দক্ষ ও জ্ঞানীদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। তারা থেকে যায় আড়ালে, বঞ্চনায়। যেহেতু তারা রাজনৈতিকভাবে কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় না, অনাগ্রহী থাকে, সেহেতু তাদের জ্ঞান ও মেধাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টার চিন্তা কারোর মাথায় থাকে না, থাকতে দেখা যায় না। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিসত্তার স্থান এ দেশে খুবই নাজুক ও দুর্বল। আবার যারা নিজেদের দাবি করে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের দেখা যায় বিশেষ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে তারা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষতার বেশ ধারণ করে চলেছে। বস্তুত তারা নির্দলীয় কিংবা নিরপেক্ষ নয়। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার মতো নেতিবাচক আচরণে তাদের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণেও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মেলে, যা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, দেশের জন্য একতাবোধ জন্মাতে বড় প্রতিবন্ধকতার ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভেদাভেদ থাকলেও দেশের স্বার্থে সবার মধ্যে একতাবোধ তাই দেখা যায় না। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশ ও তার জনগণের জন্য বড় বেশি দুর্ভাগ্যের।
লেখক: স্বপ্না রেজা
কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। এই বিজয় অর্জিত হয় লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, লাখো নারীর সম্ভ্রমহানি ও বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পরাধীনতার শিকলে নিষ্পেষিত করার পাঁয়তারা ছিল তৎকালীন পশ্চিমা পাকিস্তানিদের। রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে—এমন চিন্তা-চেতনাকে মেনে নিতে পারেনি পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং স্বাধিকারের জন্য ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নিরস্ত্র বাঙালি পাকিস্তিনি সেনাদের মোকাবিলা করে পূর্ব বাংলাকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন করে, যার নামকরণ হয় বাংলাদেশ। লাল-সবুজের পতাকার জন্ম হয়।
এটা না বললেই নয়, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছিল, বিজয়ের ৫৩ বছর পর আজও তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণটা কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দৃশ্যমান হয়ে রয়েছে। আর সেটি হলো, বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যে রাজনৈতিক দল যখনই ক্ষমতায় বসেছে বা ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখনই যেন তাদের হীন স্বার্থের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে ক্রমেই। তারা প্রকৃতার্থে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থের কথা ভাবেনি, ভাবতে পারেনি যতটা না ভেবেছে বা ভাবতে স্বতঃস্ফূর্ত থেকেছে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কথা। ফলে অভাগা থেকে গেছে সাধারণ জনগণ তথা সাধারণ নাগরিক। আর বিপর্যস্ত হয়েছে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং আমাদের পবিত্র সংবিধান।
সাধারণত দেখা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সাফল্য বয়ান ও গীত গাইতে যতটা তৎপর ও সক্রিয় থাকে এবং এ বিষয়ে যতটা ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায়, তা যেন নিমেষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং সেটা দেখা যায় তাদের ক্ষমতা অবসানের পরবর্তী পর্যায়ে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই। যার কারণে মানচিত্রে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় সুস্পষ্ট হলেও বিজয়ের ৫৩ বছর পরও বিজয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এটাই চরম হতাশার, দুঃখজনক তো বটেই।
বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবিটা কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকেই বাঙালির মনেপ্রাণে জাগরিত ছিল। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন চালিয়েছে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। বঞ্চনা রোধে বাঙালি ছাত্র-জনতা পিছপা হয়নি, উপরন্তু মুক্তি ও স্বাধিকারের তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজকের যে বাংলাদেশ ও তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বিশ্ব মানচিত্রে, তা এমনি এমনিই হয়নি, অর্জন করতে হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। তবে না বললেই নয় যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় মিললেও বৈষম্য বিষয়টি দূর হয়নি পুরোপুরিভাবে। বরং রয়ে গেছে, রয়ে যাচ্ছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কারণেই।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই শ্রেণি-গোষ্ঠী কোনোভাবেই কখনোই দেশপ্রেমিক ছিল না। দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারেনি, হয়ে উঠবেও না সম্ভবত। এই শ্রেণি ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র পরিচালনার সব প্রক্রিয়াকে বা সিস্টেমকে নিজেদের স্বার্থ-উপযোগী করে তোলে এবং সেই অবস্থাকে জিইয়ে রাখে যেন ক্ষমতায় তারা সুরক্ষিত থাকে বছরের পর বছর। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা যে এ দেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের জন্য চরম হুমকি, এমন সত্য যুগ যুগ ধরে বারবার উদ্ঘাটিত হলেও মেনে নিতে পারেনি ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বিভোর থেকেছে দলীয় ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থে। এই হীনস্বার্থপরতায় ‘দুর্নীতি’র মতো ভয়ংকর ব্যাধি বাসা বাঁধতে সুযোগ পেয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রসহ সব প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ায়। ফলে বৈষম্য থেকে গেছে, প্রসারিত হয়েছে।
৫৩ বছর পর কি যাবতীয় বৈষম্য দূর করা সম্ভব—এমন প্রশ্ন কমবেশি সবার। যে বৈষম্যপ্রক্রিয়া ‘দুর্নীতি’র মতো মহাব্যাধিতে রাষ্ট্রকে আক্রান্ত করেছে, দেশ ও জাতিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সেই প্রক্রিয়াকে আগে ঠিক করা দরকার। প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের শুধু সরিয়ে ফেললেই সমস্যার সমাধান হবে না, সেই সঙ্গে প্রক্রিয়াকে সংবিধান সমর্থিত, আইনসিদ্ধ ও জনকল্যাণমুখী করা জরুরি। পাশাপাশি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আনুগত্য প্রকাশের জন্য ও তার অনুকূলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির জন্য আইন প্রয়োগ যথাযথভাবে হওয়া দরকার। দরকার ব্যাপক প্রচার, প্রচারণা। নৈতিকতা ও সততার সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ, পরিস্থিতি নিশ্চিত করা। সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, দেশের প্রতি দায়বোধ, দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্য, নৈতিকতাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা ও তার চর্চা এবং বাস্তবায়ন। এটা বলাবাহুল্য যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এ দেশে চোখে পড়লেও উপযুক্ত ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং এ নিয়ে অনেক অভিযোগ ও সুপারিশ উত্থাপিত হয়েছে বারবার।
সামাজিক অবক্ষয় ও নীতিবহির্ভূত কার্যকলাপের জন্য অনেকেই অনুপযুক্ত ও অনুন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকে। এটা দৃশ্যমান সত্য যে, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখন সেই দলটি তার মতো করেই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তৎপর থেকেছে, সাজিয়েছে। এই জায়গাটি আর নির্দলীয় হতে পারেনি। সর্বজনীন হতে পারেনি। রাজনীতিকরণ ও অদক্ষ, অযোগ্য ব্যক্তি দ্বারা এই সেক্টর পরিচালনার বিষয়টিও দুঃখজনক পরিস্থিতি এবং তার ফলাফলের সম্মুখীন করেছে গোটা জাতি ও তার ভবিষ্যৎকে। এর ফলে শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তক পর্যন্ত সর্বত্র দলীয় রাজনীতির মরণ ছোবল পড়েছে এবং সংশ্লিষ্টরা ক্রমেই স্বার্থবাদীতে পরিণত হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
বিভাজন ও দোষারোপের রাজনীতি ‘বৈষম্য’কে ত্বরান্বিত, প্রসারিত ও স্থায়ীকরণে যথেষ্ট সহায়তা করে আসছে। আর স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ ও দলীয়করণ বিষয়গুলো বৈষম্যমূলক আচরণ ও ব্যবস্থারই ফলাফল। এতে যোগ্য, দক্ষ ও জ্ঞানীদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। তারা থেকে যায় আড়ালে, বঞ্চনায়। যেহেতু তারা রাজনৈতিকভাবে কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় না, অনাগ্রহী থাকে, সেহেতু তাদের জ্ঞান ও মেধাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টার চিন্তা কারোর মাথায় থাকে না, থাকতে দেখা যায় না। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিসত্তার স্থান এ দেশে খুবই নাজুক ও দুর্বল। আবার যারা নিজেদের দাবি করে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের দেখা যায় বিশেষ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে তারা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষতার বেশ ধারণ করে চলেছে। বস্তুত তারা নির্দলীয় কিংবা নিরপেক্ষ নয়। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার মতো নেতিবাচক আচরণে তাদের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণেও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মেলে, যা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, দেশের জন্য একতাবোধ জন্মাতে বড় প্রতিবন্ধকতার ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভেদাভেদ থাকলেও দেশের স্বার্থে সবার মধ্যে একতাবোধ তাই দেখা যায় না। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশ ও তার জনগণের জন্য বড় বেশি দুর্ভাগ্যের।
লেখক: স্বপ্না রেজা
কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
জাতীয় স্বার্থ, মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং শাসনকাঠামোর পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি আগামী দিনে ঠিক কোন অবয়ব লাভ করবে, তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনীতিতে যে রূপ বদলের আঁচ লেগেছে, তা বলা যেতেই পারে।
১৮ ঘণ্টা আগেগত সপ্তাহে প্যালেস্টেনিয়ান অথরিটি (পিএ) বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে নিষিদ্ধ করেছে, যা কিনা সংবাদভিত্তিক কয়েকটি আন্তর্জাতিক আউটলেটের মধ্যে একটি এবং যারা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী দখলদারত্ব, গাজায় চলমান গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূল অভিযানের খবর ধারাবাহিকভাবে প্রচার ক
১৮ ঘণ্টা আগেএ খবর নতুন নয় যে গত বছর ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ও আওয়ামী শাসনের অবসানের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মামলা হচ্ছে ব্যক্তিগত বিরোধ বা আক্রোশ থেকেও—এমন নয় যে তাঁরা সবাই রাজনৈতিক পদধারী কেউ কিংবা কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ আছে। এ নিয়ে স
১৮ ঘণ্টা আগেগত ডিসেম্বরের কথা। সকালের সূর্য সবে পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে। ছুটলাম কৃষকের মাঠের দিকে। আমি একা নই। সঙ্গে ২০ খুদে শিক্ষার্থী। তারা নতুন কিছু করবে ভেবে উত্তেজনায় উৎফুল্ল। যেতে যেতে আমরা কথা বলছিলাম বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক নিয়ে। নানা রকমের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা তাদের।
২ দিন আগে