ড. মইনুল ইসলাম
ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের ডলারের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সুযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা বিনিময় ও অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আইএমএফের সিস্টেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে এক আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে এই ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার ক্রাইসিস বা গোল্ড ক্রাইসিস’-এর সময় সিস্টেমটা ভেঙে পড়ে।
স্বর্ণের দাম ওই সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে ১ আউন্স ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে, যার ফলে আইএমএফের ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’, যেখানে স্বর্ণের দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ আউন্স স্বর্ণের দাম ২৬০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে)। গত ৫২ বছরে এই ‘কারেন্সি কেনাবেচার বাজারে’ মুদ্রা লেনদেন প্রতিদিন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে এক বছরে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (এফডিআই) হয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। চলমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমেই। বিশ্ব মুদ্রাবাজারের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ১৯৭২ সাল থেকে ৫২ বছর ধরে বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল, তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ১৯৪৫-৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে প্রায় সব দেশ ৭৯ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতার’ জটাজালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের বিশ্ব আধিপত্য (হেজিমনি) এখনো বহাল রয়েছে।
মার্কিনদের রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রতিবছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ এ রকম ঘাটতিতে পড়লে ওই দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান অংশ, তাই কোনো দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক। উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই ‘আনচ্যালেঞ্জড হেজিমনি’র কারণে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলার-প্রতি অফিশিয়ালি ৪.৭৬ টাকা হলেও আনঅফিশিয়ালি ছিল ১৫ টাকা। এখন ১ ডলারের বাজার দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত বাজারে ১২০ টাকা, আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২৩ টাকায়।
গত তিন বছরে ডলারের তুলনায় টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশের বেশি অবচয়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছে। অথচ আমরা এখনো ‘ফ্রিলি-ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করিনি, ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে টাকা এখনো অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হয়নি। আমরা ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করছি ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবু এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ক্রমে আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে প্রায় সব দেশ। (পাকিস্তানে ১ ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ এজেন্ট আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমেই ডলারের দাম দেশীয় মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে সব তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আইএমএফের এই দাবি মার্কিন ডলারকে মদদ দেওয়ার জন্য। ব্রিকস সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। এবারের কাজান সম্মেলনে আরও ১৩টি দেশকে ব্রিকসের ‘পার্টনার কান্ট্রি’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী এক দশকে ডলারের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুঁজি পাচার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের সব দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসনের স্বর্গরাজ্য বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার চারটি প্রধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলোরও প্রধান গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি প্রক্রিয়া হলো: ১) আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং, ২) রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং, ৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং ৪) হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দেশের পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে সহজেই অর্থ পাচার সম্পন্ন করা।
সাবেক হাসিনা সরকারের আমলে এই হুন্ডি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল এবং প্রথমোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ার তুলনায় ওই সময় হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ পাচার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছিল। গত ২ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন যে গত ১০ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিগত সরকারের শেষের দিকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর মানে, পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন ডলার-সাম্রাজ্যবাদের অনেক বড় শিকারে পরিণত হয়েছে, যেটাকে সাবেক সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে লাই দিয়েছে। ডলারের এহেন দ্বৈত বাজার এ দেশের অর্থনীতিতে ব্ল্যাক-ইকোনমির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে ফেলেছে। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী হলেও সফল হয়নি। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু মার্কিনপন্থী সরকার, তাই এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের ব্যাপারে হয়তো কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তবে এটুকু বলতেই হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘মাল্টি-পোলার ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।
ব্রিকস হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ইংরেজি আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত সংস্থার নাম। সম্প্রতি রাশিয়ার কাজানে ব্রিকসের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। ব্রিকসের ১০ সদস্যদেশসহ মোট ৩৫টি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য অনেকখানি খর্ব করবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির মালিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হলো মার্কিন ডলার। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের ডলারের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার সুযোগ নেই। ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) মাধ্যমে এই হাতিয়ারের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বিশ্বের যাবতীয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মুদ্রা বিনিময় ও অর্থ লেনদেনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আইএমএফের সিস্টেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক গ্যারান্টির ভিত্তিতে ৩৫ ডলারে এক আউন্স সোনার দাম নির্ধারণ ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে এই ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু হয়েছিল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম কাজ করলেও বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে ‘ডলার ক্রাইসিস বা গোল্ড ক্রাইসিস’-এর সময় সিস্টেমটা ভেঙে পড়ে।
স্বর্ণের দাম ওই সময় হু হু করে বাড়তে বাড়তে ১ আউন্স ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে, যার ফলে আইএমএফের ‘ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ ভেস্তে যায়। এর পরিবর্তে চালু করা হয় ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’, যেখানে স্বর্ণের দাম এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক দাম নির্ধারণ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ আউন্স স্বর্ণের দাম ২৬০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে)। গত ৫২ বছরে এই ‘কারেন্সি কেনাবেচার বাজারে’ মুদ্রা লেনদেন প্রতিদিন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে এক বছরে ‘ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (এফডিআই) হয় ৮০০ বিলিয়ন ডলারের মতো। চলমান তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের দক্ষতা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ছে ক্রমেই। বিশ্ব মুদ্রাবাজারের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ১৯৭২ সাল থেকে ৫২ বছর ধরে বহাল রেখেছে মার্কিন ডলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের জনগণ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণহানিসহ যে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়েছিল, তার ফলে ঔপনিবেশিক কাঠামো পরিত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রূপ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে, সাম্রাজ্যবাদ এখনো বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ১৯৪৫-৭৫ পর্বে সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার এক অবিচ্ছেদ্য জালে প্রায় সব দেশ ৭৯ বছর ধরে আটকা রয়েছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতার’ জটাজালে সবচেয়ে ক্ষমতাধর অধিপতির ভূমিকা পালন করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাদের বিশ্ব আধিপত্য (হেজিমনি) এখনো বহাল রয়েছে।
মার্কিনদের রপ্তানি আয় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রতিবছর অনেক কম হওয়ায় তাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে নিয়মিতভাবে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ এ রকম ঘাটতিতে পড়লে ওই দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মানে ধস নামত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। তাদের মুদ্রা ডলার যেহেতু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রধান অংশ, তাই কোনো দেশই চায় না ডলারের বৈদেশিক মানে ধস নামুক। উদাহরণ হিসেবে চীনের ব্যাপারটা উল্লেখ করা যেতে পারে: চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্কে বহাল রাখতে চায়। নয়তো একদিকে তাদের কাছে ডলারের যে বিশাল মজুত রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তাদের রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষুণ্ন হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হচ্ছে মার্কিন ডলারের এই ‘আনচ্যালেঞ্জড হেজিমনি’র কারণে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান ডলার-প্রতি অফিশিয়ালি ৪.৭৬ টাকা হলেও আনঅফিশিয়ালি ছিল ১৫ টাকা। এখন ১ ডলারের বাজার দাম বাংলাদেশ ব্যাংক-নির্ধারিত বাজারে ১২০ টাকা, আর কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১২৩ টাকায়।
গত তিন বছরে ডলারের তুলনায় টাকার বৈদেশিক মান ৪২ শতাংশের বেশি অবচয়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড়সড় ধস নেমেছে। অথচ আমরা এখনো ‘ফ্রিলি-ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম’ চালু করিনি, ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে টাকা এখনো অবাধে বিনিময়যোগ্য করা হয়নি। আমরা ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসরণ করছি ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবু এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ক্রমে আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। ডলারের দামকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সব দেশের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়াস জারি রাখা সত্ত্বেও দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে থামাতে অসমর্থ হচ্ছে প্রায় সব দেশ। (পাকিস্তানে ১ ডলারের দাম এখন ২৮০ রুপির আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে)।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ এজেন্ট আইএমএফ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক চাপ অব্যাহত রেখে চলেছে ক্রমেই ডলারের দাম দেশীয় মুদ্রায় বাড়ানোর ব্যাপারে। তাদের মতে সব তৃতীয় বিশ্বের দেশে ডলারের তুলনায় মুদ্রাগুলো ‘অতিমূল্যায়িত’ রয়ে যাচ্ছে, তাই মুদ্রার অবচয়ন (ডেপ্রিসিয়েশন) আইএমএফের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে সব সময় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আইএমএফের এই দাবি মার্কিন ডলারকে মদদ দেওয়ার জন্য। ব্রিকস সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে। ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি এখন বিশ্বের মোট জিডিপির ৪৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং এই অনুপাত ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ব্রিকসের সদস্যদেশগুলোর অধিবাসী। এবারের কাজান সম্মেলনে আরও ১৩টি দেশকে ব্রিকসের ‘পার্টনার কান্ট্রি’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মনে হচ্ছে, আগামী এক দশকে ডলারের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব হয়ে যাবে।
আমরা অনেকেই খেয়াল করি না যে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পুঁজি পাচার হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের সব দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অভিবাসনের স্বর্গরাজ্য বিবেচিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলার চারটি প্রধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলোরও প্রধান গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই চারটি প্রক্রিয়া হলো: ১) আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং, ২) রপ্তানিতে আন্ডারইনভয়েসিং, ৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং ৪) হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দেশের পুঁজি পাচারকারীরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছে সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে সহজেই অর্থ পাচার সম্পন্ন করা।
সাবেক হাসিনা সরকারের আমলে এই হুন্ডি প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ব্যাংকের ঋণ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল এবং প্রথমোক্ত তিনটি প্রক্রিয়ার তুলনায় ওই সময় হুন্ডি পদ্ধতিতে অর্থ পাচার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছিল। গত ২ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন যে গত ১০ বছরের প্রত্যেক বছর বিভিন্ন পন্থায় বিদেশে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিগত সরকারের শেষের দিকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। এর মানে, পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন ডলার-সাম্রাজ্যবাদের অনেক বড় শিকারে পরিণত হয়েছে, যেটাকে সাবেক সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে লাই দিয়েছে। ডলারের এহেন দ্বৈত বাজার এ দেশের অর্থনীতিতে ব্ল্যাক-ইকোনমির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে ফেলেছে। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী হলেও সফল হয়নি। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু মার্কিনপন্থী সরকার, তাই এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের ব্যাপারে হয়তো কোনো আগ্রহ দেখাবে না। তবে এটুকু বলতেই হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব আধিপত্য খর্ব করে ভবিষ্যতে যদি ব্রিকস একটি ‘মাল্টি-পোলার ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ‘ডলার সাম্রাজ্যবাদের’ একটি বিকল্প খুঁজে পাবে।
প্রতিটি নতুন বছরের আগমনে প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণে আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি। বাস্তবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ আর হয় না, অধরাই থেকে যায়। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে নিক্ষিপ্ত হয়। এবারও যে তার ব্যতিক্রম ঘটবে না, সেটাও সার্বিক বিবেচনায় অনায়াসে বলা যায়। দেশের সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে তা স্বীকার করতেই হবে।
৫ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের ঘটনাগুলোর দিকে ফিরে তাকালে আমরা বলতে পারি যে এটি বড় ধরনের রূপান্তর, ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক স্থায়িত্বের ওপর সংজ্ঞায়িত একটি বছর ছিল। বছরটি বিজয় ও চ্যালেঞ্জের। বছরটি আমাদের বিশ্বের আন্তসংযোগ ও মানবতার মাপকাঠির ওঠানামার কথা মনে করিয়ে দেয়।
৫ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে অতিপরিচিত একটি শব্দ হলো চালশে। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা প্রায় সবাই শব্দটি প্রয়োগ করতে শুনেছি। কিন্তু এই চালশে আসলে কী? এটি কি কোনো রোগ? চল্লিশ বছর বয়সের সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে?
৫ ঘণ্টা আগেসদ্যই আমরা ২০২৪ সালকে বিদায় জানিয়েছি। আজ নতুন বছর, ২০২৫ সালকে স্বাগত জানানোর পালা। সময়ের গতিতে এক বছর শেষ হয়ে নতুন আরেকটি বছরের সূচনা হয়েছে। নতুন বছরের আগমন মানুষের মনে সব সময়ই নিয়ে আসে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই নতুন বছর কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা কম হচ্ছে না চারদিকে। তবে আশাবা
৬ ঘণ্টা আগে