Ajker Patrika

জাতীয় বিষয়ে বিতর্ক অনভিপ্রেত

মযহারুল ইসলাম বাবলা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের যেমন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বলে দাবি করত তা যে কত অসাড় ছিল, সেটা আমরা ১৫ বছরের শাসনামলে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বারবার হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে ব্যাপক রদবদল ঘটিয়ে অসাম্প্রদায়িক রচনা বাতিল করেছিল। বাতিল করেছিল পাঠ্যসূচি থেকে জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী ডারউইনের রচনা। অথচ মাদ্রাসা শিক্ষায় সরকারের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ দেখা যায় না। একইভাবে দেখা যায় না ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাক্রমেও। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হেফাজতসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং তৎকালীন সরকার মাধ্যমিকের সিলেবাস, পাঠ্যসূচিতে ক্রমাগত হস্তক্ষেপ চালিয়ে আমাদের মূলধারার শিক্ষাক্রমকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। কোন অধিকারে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হেফাজতে ইসলাম মূলধারার শিক্ষাক্রমে হস্তক্ষেপ করে, তা আমাদের জানা নেই। সরকারও রাজনৈতিক সমঝোতা করে মাধ্যমিকে ব্যাপক পরিবর্তন করেছিল। সরকার এবং হেফাজত মুখোমুখি অবস্থান থেকে পরস্পর সখ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনমাত্র তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শামিল হয়ে ভাস্কর্য ভাঙা থেকে শুরু করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে দ্রুত যুক্ত হয়ে পড়ে। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের নাম পরিবর্তনে শহিদী চত্বর নামকরণের তৎপরতা চালালেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধে শাপলা চত্বরের নাম পরিবর্তন করতে পারেনি।

আমাদের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জাতীয় নির্ধারিত বিষয় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করা নতুন নয়। পঁচাত্তরে পটপরিবর্তনে একটি মহল দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার তৎপরতা চালিয়ে ছিল। তৎকালীন বিমানবাহিনীর প্রধান তোয়াব তো পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের উদ্যোগ পর্যন্ত নিয়েছিলেন। যেমনটি নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক, কুমিল্লার সংসদ সদস্য জহুরুল কাইয়ূমসহ কতিপয় ব্যক্তি। অস্থায়ী সরকারপ্রধান তাজউদ্দীন আহমদ বিষয়টি জানামাত্র খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের উদ্যোগকে রুখে দিয়েছিলেন।

বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতির ওপর পাকিস্তানি আমলের দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারা পঁচাত্তর-পরবর্তী সেই যে শুরু হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। তারই অংশ হিসেবে জাতীয় সংগীত, পতাকা, শহীদ মিনার, স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য ভাঙা, সূর্যসেন হলের নাম বদলে ফয়সল হল, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বি. বাড়িয়া, বিক্রমপুরকে মুন্সিগঞ্জ ইত্যাদি সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রক্রিয়া চলেছিল। কিন্তু কোনোটি সফল হতে পারেনি। কেননা তখন প্রগতিশীল ছাত্র, যুব এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো শক্তিমত্তায় বলবান ছিল। বর্তমানের মতো ক্ষয়িষ্ণু ছিল না বলেই প্রতিরোধ গড়ে তুলে অনাচার রোখা সম্ভব হয়েছিল।

সাম্প্রতিক চাকরিতে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা অনিবার্য রূপে অরাজনৈতিক এবং নিরীহ আন্দোলন ছিল। কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা এই আন্দোলনে যুক্ত ছিল না। আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নামকরণ করা হয়। তবে সে বৈষম্য ৫৬ শতাংশ কোটা বৈষম্য হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছিল। সামাজিক বৈষম্য নিরসনের কোনো দাবি আন্দোলনকারীরা তোলেননি। আন্দোলন চলাকালীন যেসব গান আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল, সেগুলো দেশাত্মবোধক ডি এল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্প ভরা’সহ মোহিনী চৌধুরী, সলিল চৌধুরী, সুকান্ত, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী গান। এবং স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত গানও। কোনো ইসলামি গান তাঁরা কণ্ঠে তোলেননি। নিয়মিত তাঁদের কণ্ঠে শোনা গিয়েছে জাতীয় সংগীত। আন্দোলনকারীদের মাথায় বাধা ছিল জাতীয় পতাকা। যার সঙ্গে আন্দোলন-পরবর্তী ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত হিসেবে জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা জাতি মেনে নেবে না।

আন্দোলনকারীরা সংবিধান সংস্কারের দাবি করেছেন; সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে। কিন্তু সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি তোলেননি। অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছে। এখন এই সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান পুনর্লিখনে কিন্তু এই সরকারের অস্তিত্ব থাকে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারও তাদের দায়িত্বের সীমা বা পরিসর সম্পর্কে সচেতন থাকবে বলেই ভরসা করতে চাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনাসহ দণ্ডিতদের বক্তব্য প্রচার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার

৭ কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে নীতিগত সিদ্ধান্ত, অধ্যাদেশ চূড়ান্তের অপেক্ষা

হঠাৎ বেশ কটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট ডাউন, যা জানা গেল

এনবিআর সদস্য বদিউল আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

২২ বছরের অপেক্ষা শেষে ভারতকে হারাল বাংলাদেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব ও শ্রমিকের করুণ আর্তি

চিররঞ্জন সরকার
যাঁদের হাতের ছোঁয়ায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক বিদেশের বাজারে জায়গা করে নেয়, আজ সেই হাতগুলোই অব্যবহৃত, সেই মুখগুলোই ক্ষুধার্ত। ছবি: সংগৃহীত
যাঁদের হাতের ছোঁয়ায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক বিদেশের বাজারে জায়গা করে নেয়, আজ সেই হাতগুলোই অব্যবহৃত, সেই মুখগুলোই ক্ষুধার্ত। ছবি: সংগৃহীত

দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের জীবন ও জীবিকা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আওয়াজ তুললেও জনমনে সংশয় দূর হচ্ছে না। বরং ফেব্রুয়ারি যতই এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক বিরোধ, অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা ততই বাড়ছে। এর ফলে দেশের শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ ২০২৪ সালের আগস্টে দেশে ‘বৈষম্য থাকবে না, কোটা থাকবে না, চাকরি হবে, কর্মসংস্থান হবে, শিল্প হবে’–এমন অনেক প্রতিশ্রুতির সুরে নতুন আশার আলো দেখেছিলেন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু আজ সেই আশার প্রতিধ্বনি যেন এক নিষ্ঠুর প্রহসনে পরিণত হয়েছে। যে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রতি অঙ্গীকার করেছিল বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের, বাস্তবে তা যেন উল্টো পথে হাঁটছে। বিশেষত, যাঁরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেই শ্রমিক শ্রেণি আজ কাজ হারিয়ে বেকারত্বের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছেন।

যে শ্রমিকেরা দিনের পর দিন কারখানার ধোঁয়া ও ঘামের গন্ধে নিজেদের জীবনকে নিঃশেষ করেছেন, সেই শ্রমিকদেরই এখন অন্নসংস্থানের অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে। তাঁরা যাদের জন্য অর্থনীতি সচল, যাঁদের হাতের ছোঁয়ায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক বিদেশের বাজারে জায়গা করে নেয়, আজ সেই হাতগুলোই অব্যবহৃত, সেই মুখগুলোই ক্ষুধার্ত।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প দীর্ঘদিন ধরে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান ভিত্তি। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি এই খাতে কাজ করেন এবং আরও ২ কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গত ১৪ মাসের চিত্র যেন এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দলিল। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন। এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়—এগুলো লক্ষাধিক পরিবারের চোখের পানি, অসহায়তার নীরব চিৎকার।

সবচেয়ে বড় আঘাত লেগেছে সাভারে, যেখানে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১২২টি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। বড় কারখানাগুলোর মধ্যে যেমন ছেইন অ্যাপারেলস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন বা সাফওয়ান আউটারওয়্যার—সবই আজ অতীতের নাম। এরপরের অবস্থান গাজীপুরে, যেখানে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৭৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মহীন। বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া মানে শুধুই অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং হাজার হাজার পরিবারের জীবনে অনিশ্চয়তার অন্ধকার নেমে আসা। অবশ্য বেক্সিমকোর কারখানাগুলো আগামী মাসে চালু হচ্ছে। এতে ২৫ হাজার শ্রমিক আবার তাঁদের কাজ ফিরে পাবেন।

কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই ঢেউয়ের পেছনে আছে একাধিক কারণ—আন্তর্জাতিক বাজারের মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বায়ারদের অনিশ্চয়তা এবং স্থানীয় আর্থিক সংকট। বিদেশি ক্রেতারা নির্বাচিত সরকারের স্থিতিশীলতা না দেখে অর্ডার দিতে ভয় পাচ্ছেন, ফলে

ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো টিকতে পারছে না। একদিকে অর্ডারের ঘাটতি, অন্যদিকে শ্রম আইন সংশোধনের মতো বিষয়গুলো মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের ওপর নতুন চাপ তৈরি করেছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমাচ্ছে বা বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু এসবের সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। তাঁরা হারাচ্ছেন চাকরি, হারাচ্ছেন আয়, হারাচ্ছেন মর্যাদা—সবচেয়ে বেশি হারাচ্ছেন জীবনের নিশ্চয়তা।

পোশাকশিল্পের এই সংকটে আরেকটি দুঃখজনক বিষয় একের পর এক রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড। গত ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) অবস্থিত অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেড বা আল হামিদ টেক্সটাইলসে ভয়াবহ আগুনে ৯ তলা ভবনের ৫, ৬ ও ৭ তলা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ১৭ ঘণ্টা ধরে চলা এই আগুনে পুড়ে গেছে বিপুল কাপড় ও কাঁচামাল। শত শত শ্রমিক হঠাৎ কাজ হারিয়েছেন।

যদিও কর্তৃপক্ষ ৪৫ দিনের লে-অফ ঘোষণা দিয়ে বেতন চালু রাখার আশ্বাস দিয়েছে, বাস্তবে তা অনেক সময়ই ভেস্তে যায়। একটি কারখানার আগুন মানে শুধু ভবন পোড়া নয়, এটি শত শত স্বপ্নের মৃত্যু।

এর পরপরই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনে ৫১৬টি কারখানার প্রায় ১০০ কোটি টাকার স্যাম্পল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর প্রভাব সরাসরি পড়ে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থার ওপর। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো যখন বাংলাদেশের উৎপাদনকাঠামোকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তখন নতুন অর্ডার স্থগিত বা বাতিল হয়, যার ফল ভোগ করেন শ্রমিকেরাই। বড় কারখানাগুলো হয়তো কোনোভাবে ধাক্কা সামলে নিতে পারে, কিন্তু ছোট কারখানাগুলোর জন্য এটি একরকম মৃত্যুঘণ্টা।

বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের (বিএলএফ) এক জরিপে দেখা গেছে, তৈরি পোশাক খাতে ৩২ শতাংশ শ্রমিক ন্যূনতম মজুরিরও কম আয় করেন। এর চেয়ে ভয়াবহ তথ্য; ৭৮ শতাংশ শ্রমিক তাঁদের পরিবারকে পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না। অভাবের তাড়নায় প্রতি আটজনের মধ্যে একজন শ্রমিক ঋণের জালে আটকা পড়েছেন। এই পরিসংখ্যান কেবল অর্থনৈতিক নয়—এটি মানবিক ট্র্যাজেডি। যে মানুষটি ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে সারা দিন মেশিনের শব্দের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, রাতে ঘরে ফিরে সন্তানের মুখে খাবার দিতে না পারার কষ্টে চোখের পানি চেপে রাখেন, তিনি কেবল শ্রমিক নন, তিনি এই জাতির মেরুদণ্ড। অথচ সেই মেরুদণ্ড আজ ভেঙে পড়ছে।

বাংলাদেশের কারখানাগুলোর বাস্তবতা আরও কঠিন। সাব-কন্ট্রাক্টেড ও মিশ্র ধরনের অনেক ফ্যাক্টরিতে ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি শিফট কাজ করা সাধারণ ঘটনা। আইনে যতই আট ঘণ্টা নির্ধারণ থাকুক, বাস্তবে তা প্রায়ই মানা হয় না। তদুপরি, শিশুশ্রম এখনো এই খাত থেকে নির্মূল হয়নি। শিশুশ্রমিকদের প্রায় ৮০ শতাংশই অনিয়ন্ত্রিত সাব-কন্ট্রাক্টেড কারখানায় কাজ করে। তাদের ৯৯ শতাংশ সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টার বেশি কাজ করে এবং অনেকেরই বয়সসংক্রান্ত নথি জাল করা হয়। এই নির্মম বাস্তবতা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়—আমরা কীভাবে উন্নয়নের দাবিদার হতে পারি, যখন শিশুদের শৈশব পোশাকের কারখানার তাপে পুড়ে যায়?

যে শ্রমিকেরা বৈষম্য নিরসনের দাবিতে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, এবার পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই আন্দোলনের পরও তাঁদের জীবনে কোনো আলো জ্বলেনি। বরং বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও ঋণের চাপে তাঁদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়েছে। তাঁদের এই হতাশা কেবল আর্থিক নয়, এটি মানসিকও। যখন একজন শ্রমিক তাঁর সন্তানের স্কুলের ফি দিতে পারেন না, যখন অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি শুধু একজন বেকার মানুষ নন, তিনি হয়ে ওঠেন সমাজের এক অদৃশ্য আর্তনাদ।

বেকারত্ব শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি সমাজের স্থিতি ও শান্তির প্রশ্ন। যখন লাখো শ্রমিক কাজ হারান, তখন শুধু তাঁদের পরিবার নয়, সমাজও অস্থির হয়। অভাব জন্ম দেয় সামাজিক অপরাধ, মানসিক ভাঙন ও প্রজন্মের হতাশা। আজ বাংলাদেশের তরুণসমাজও একই বাস্তবতায় আক্রান্ত। উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা কাজ খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা, অন্যদিকে অভিজ্ঞ শ্রমিকেরা কাজ হারিয়ে নিঃস্ব। একদিকে দক্ষ জনশক্তি দেশ ছাড়ছে, অন্যদিকে দেশীয় শ্রমবাজার সংকুচিত হচ্ছে। এই দ্বৈত সংকট ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ বার্তা।

এই সংকটের সমাধান কেবল অর্থনীতির ভাষায় সম্ভব নয়; দরকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিটি বেকার শ্রমিক একটি পরিবারের গল্প, প্রতিটি বন্ধ কারখানা একটি সমাজের ব্যর্থতার প্রতীক। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত এই সংকটকে কেবল পরিসংখ্যান নয়, একটি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা। সরকারের পাশাপাশি শিল্পমালিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। শ্রমিককে কেবল উৎপাদনের হাতিয়ার নয়, মানুষ হিসেবে সম্মান করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, পুনর্বাসন এবং ন্যূনতম জীবিকা নিশ্চিতে সরকার ও মালিকপক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। আন্তর্জাতিক বায়ার ও উন্নয়ন-সহযোগীদেরও এখানে ভূমিকা আছে। তারা শুধু ‘কম দামে বেশি উৎপাদন’ নয়, বরং ‘মানবিক উৎপাদন’কে অগ্রাধিকার দিলে তবেই এই শিল্প টিকে থাকবে।

বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কেবল অর্থনীতির চালক নন; তাঁরা জাতীয় আত্মমর্যাদার প্রতীক। কিন্তু আজ সেই প্রতীকের ওপরই আঘাত লেগেছে। যদি আমরা এই সংকটকে উপেক্ষা করি, তাহলে শুধু শ্রমিক নয়, রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেকারত্বের অভিশাপ কেবল অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়—এটি এক মানবিক বিপর্যয়। তাই এখনই সময় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার, শ্রমিকের কণ্ঠ শোনার, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর। অর্থনীতির পরিসংখ্যান হয়তো কিছু সময় পর পাল্টে যাবে, কিন্তু এক শ্রমিকের কান্না যদি সমাজের বিবেকে না পৌঁছায়, তবে উন্নয়নের সব দাবি অর্থহীন হয়ে পড়বে। শ্রমিকের অশ্রু মুছে ফেলার দায়িত্ব আমাদের সবার। মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রথমে মানবিক চোখে শ্রমিককে দেখতে শিখতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনাসহ দণ্ডিতদের বক্তব্য প্রচার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার

৭ কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে নীতিগত সিদ্ধান্ত, অধ্যাদেশ চূড়ান্তের অপেক্ষা

হঠাৎ বেশ কটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট ডাউন, যা জানা গেল

এনবিআর সদস্য বদিউল আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

২২ বছরের অপেক্ষা শেষে ভারতকে হারাল বাংলাদেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শিল্প-সংস্কৃতি হোক সবার জন্য

নুসরাত রুষা
শিল্প শুধু বিলাসিতা নয়, মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। ছবি: সংগৃহীত
শিল্প শুধু বিলাসিতা নয়, মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের দেশে শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি উপভোগ করা দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা ও মঞ্চনাটক দেখা, বই কেনা আর চিত্রকলা ও ফটোগ্রাফির প্রদর্শন ও চর্চা যেন এক সীমিত জনগোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সিনেমা দেখা একসময় সাধারণ পরিবারের সদস্যদের কাছে আনন্দ ও বিনোদনের জায়গা ছিল, আজ তা বিলুপ্তির পথে। জেলা ও উপজেলা শহরের মানুষ এখন আর মাসে একবার পরিবারের সঙ্গে সিনেমা দেখার সুযোগ পায় না। ঢাকায় যে কয়েকটি সিনেমা হল আছে, সেখানে টিকিটের দাম এত বেশি যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ সেসব জায়গায় গিয়ে সিনেমা দেখার সামর্থ্য রাখে না। ৫০০ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত টিকিটের দাম দিয়ে সিনেমা দেখা মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতার মতো। অথচ একসময় হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা বা ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র দেখার সময় পুরো হল হাসিতে ফেটে যেত বা কাঁদত—শিল্পের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ছিল। আজ সেই সংযোগ নেই। ফলে সিনেমা দেখার আনন্দ কেবল শহুরে, ধনী, শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।

সিনেমা হলের ধ্বংস শুধু বিনোদনের স্থান হারানো নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন ও সমাজের সমান সুযোগের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

শুধু সিনেমা নয়, কনসার্ট, লাইভ মিউজিক বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও একই অবস্থা। ঢাকায় কোনো বড় কনসার্টের টিকিট সাধারণত এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত, যা একজন সাধারণ ছাত্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে বহনযোগ্য নয়। ফলে সংগীত, নাটক বা সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীও বিলাসিতা হয়ে যাচ্ছে, যেখানে অংশগ্রহণ করতে পারছে শুধু শহুরে ধনিক শ্রেণি।

বইয়ের দোকানও আজ বিলুপ্তির পথে। এখন আর স্কুল-কলেজে বই পড়ার প্রতি উৎসাহ দেখানো হয় না। এলাকার বইয়ের দোকানগুলোতে শুধু একাডেমিক বা চাকরির বই পাওয়া যায়। গল্প, কবিতা, ছোটগল্পের বই সেখানে দুর্লভ বস্তু। একসময় শিশু-কিশোররা টিফিনের টাকা দিয়ে ‘তিন গোয়েন্দা’ কিনে পড়ার আনন্দে ভেসে যেত। আজ সেই দৃশ্য আর সেভাবে চোখে পড়ে না। ঢাকার বইয়ের দোকানগুলো মূলত শহুরে এলিটদের জন্য। বাতিঘর, পাঠক সমাবেশ, বেঙ্গল বুকসে গিয়ে সবাই বই কেনার সামর্থ্য রাখেন না। আজিজ সুপার মার্কেট, কনকর্ড টাওয়ার ও নিউমার্কেটে আগের মতো বইয়ের দোকানের জৌলুশ নেই।

সাত-আট বছর আগে নীলক্ষেত দিয়ে হেঁটে গেলে অসংখ্য গল্পের বইয়ের দোকান চোখে পড়ত। এখন সেসব দোকান আর নেই। সব চাকরির বই দিয়ে ভরা। আবার বিভিন্ন কারণে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। সে জায়গা দখল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

শিল্পকলায় মঞ্চনাটক দেখা, ফটোগ্রাফি ও চিত্রকলার প্রদর্শনী—সবই এখন মূলত ধনী, শহুরে শ্রেণির জন্য। টিকিটের দাম এত বেশি যে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভব নয়। শহুরে ধনিক শ্রেণি ছাড়া অন্যরা এ ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি কি কেবল একটি শ্রেণির জন্য? আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—এ ধরনের ব্যয়বহুল সাংস্কৃতিক আয়োজন কি সত্যিই শিল্পের বিস্তার ঘটাতে পারে? মানুষ শিল্প ও সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কারণ সেখানে টাকার খেলা প্রাধান্য পাচ্ছে।

শিল্পের সঙ্গে সংযোগ থাকলেও যদি তা ব্যয়বহুল, সীমিত বা বিলাসিতার মতো মনে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায় না। সংস্কৃতি কেবল শহুরে ধনীর খেলা হয়ে গেলে সমাজের বৃহত্তর অংশ তা থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তও শিল্প-সাহিত্যকে দেখতে চায়, পড়তে চায়, অনুভব করতে চায়। কিন্তু টাকার কাছে বাধা, সুযোগের অভাব এবং অযাচিত সীমাবদ্ধতা তাদের থেকে শিল্পকে দূরে রাখছে।

শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসার কেবল শ্রেণির অভিজ্ঞতা নয়, এটি সমাজের মানসিক ও নৈতিক বিকাশের অংশ। তাই আমাদের এই সংকট কাটানো উচিত। সিনেমা, বই, নাটক, প্রদর্শনী—সবকিছু যেন সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছাতে পারে, সেই প্রচেষ্টা থাকা দরকার। শিল্প শুধু বিলাসিতা নয়, মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ।

আমরা যদি শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে একটি শ্রেণির বা ধনীর খেলা বানাই, তাহলে আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাধারণ মানুষকে এই সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত না করা উচিত। সবকিছুতে টাকার খেলা কমিয়ে, সাংস্কৃতিক বিস্তার সবার জন্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনাসহ দণ্ডিতদের বক্তব্য প্রচার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার

৭ কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে নীতিগত সিদ্ধান্ত, অধ্যাদেশ চূড়ান্তের অপেক্ষা

হঠাৎ বেশ কটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট ডাউন, যা জানা গেল

এনবিআর সদস্য বদিউল আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

২২ বছরের অপেক্ষা শেষে ভারতকে হারাল বাংলাদেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়

সম্পাদকীয়
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শুধু শেখ হাসিনা নন, এই মামলার আরেক আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও একই সাজা দেওয়া হয়েছে। আবার একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেও রাজসাক্ষী হওয়ায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই রায় ঘোষণা সারা দেশের মানুষ সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে। এই রায় শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক আদর্শের পরিণতি নয়, এটি পুরো দেশের জন্য এক বার্তাও বটে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ বড় অপরাধ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড বহু সময় চাপা পড়ে গেছে রাজনৈতিক প্রভাবে। বহু পরিবার বিচারহীনতার কষ্ট বয়ে বেড়িয়েছে। এই রায় তাদের কাছে একটি উদাহরণ যে রাষ্ট্র আর অপরাধকে ছায়া দেবে না। রাষ্ট্র অপরাধীকে নাম, পদ, ক্ষমতা দিয়ে রক্ষা করবে না। এই দৃষ্টান্ত নিশ্চয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আশার বার্তা দেবে।

রায়ে যাঁরা সন্তুষ্ট তাঁদের কথা, এটি একটি প্রতিশ্রুতি। অবিচার ও অত্যাচারের কড়া জবাব আছে রায়ে। আর যাঁরা উল্টো দিকে, তাঁরা বলছেন, এটা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রতিশোধের শুরু। পরিস্থিতি যা-ই হোক, এখন সরকারের এবং বিচারব্যবস্থার প্রধান দায়বোধ হওয়া উচিত, জনগণের শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির দিকে নজর দেওয়া। দেশের জন্য নতুন একটি রাজনৈতিক অধ্যায় গড়তে চাইলে ন্যায্যতা, আইনি স্বচ্ছতা এবং সংলাপ অপরিহার্য। দেশের জনগণকে মনে রাখতে হবে, বিচার শেষ হলে প্রকৃত কাজ শুরু হবে, যেখানে রাজনৈতিক বিরোধিতা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেও দেখা।

রাজনীতিতে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো গুরুতর অভিযোগ কখনোই রাজনৈতিক মতাদর্শের সীমানায় আটকে থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত—একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিচার। এ রায় রাষ্ট্রকে বার্তা দেয় যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কারও জন্যই চিরস্থায়ী রক্ষাকবচ হতে পারে না। আবার একই সঙ্গে এটি ভয়ও তৈরি করে। রায়ের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে স্নায়ুচাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা বলে দেয়—এটি রাজনীতির পরবর্তী পথরেখা তৈরির অন্যতম নিয়ামক।

রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা কখনো অন্যায়কে ধামাচাপা দিয়ে আসতে পারে না; বরং অন্যায়ের বিচার হলেই কেবল অতীতের ক্ষত শুকানো, বিভাজন কমানো এবং রাষ্ট্রকে নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই রায় হয়তো সেই পথই তৈরি করে দেবে। রায় নিয়ে অবশ্যই উত্তেজনা, বিতর্ক থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারই শেষ পর্যন্ত স্থিরতা এনে দেয়।

এই রায় নিয়ে দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে নিঃসন্দেহে; কিন্তু এরপরে কী হবে, তা মূলত নির্ভর করবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ওপর। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ এখন কোন পথে হাঁটবে, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের সবার—রাষ্ট্রের, রাজনীতির এবং নাগরিকের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনাসহ দণ্ডিতদের বক্তব্য প্রচার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার

৭ কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে নীতিগত সিদ্ধান্ত, অধ্যাদেশ চূড়ান্তের অপেক্ষা

হঠাৎ বেশ কটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট ডাউন, যা জানা গেল

এনবিআর সদস্য বদিউল আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

২২ বছরের অপেক্ষা শেষে ভারতকে হারাল বাংলাদেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়...

সম্পাদকীয়
কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়...

সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার ‘কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় ভাই রে’ গানটি অনেকের মনে থাকার কথা। গানটির মর্মার্থ হলো, জীবনে নানা ধরনের অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যা দেখে অবাক হতে হয়, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। আজকের পত্রিকায় ১৩ নভেম্বর ‘উপজেলা প্রকৌশলী নিজেই ঠিকাদার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে আলোচ্য গানের একটা মিল আছে।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে উপজেলা পরিষদের বরাদ্দের ছয়টি প্রকল্পের প্রায় ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল কাদের মুজাহিদের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজেই ‘ঠিকাদার’ হয়ে কাজ সম্পন্ন করে পরবর্তী সময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করে বিল উত্তোলন করেছেন। এ ‘রঙ্গ’ নয় তো কী!

ঘটনাটি ২০২৪-২৫ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরের। আমাদের কাছে সময়ের ব্যাপ্তিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দেশে নতুন ধরনের একটি সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এ সময়ে অতীতের মতো কিছু ঘটবে না। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা যে ভেঙে গেছে, এ ঘটনা তার উদাহরণ হতে পারে।

পেছনে শক্তিশালী কেউ না থাকলে যেকোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অপরাধ করতে পারেন না বলে আমরা ধরে নিতে পারি। আমাদের দেশে অহরহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অপরাধ করার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তাঁদের সেভাবে কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হয় না।

অনিয়ম করে সরকারি টাকা এভাবে আত্মসাৎ করা যায় না। কিন্তু এ দেশে এ রকম অপরাধ করে ছাড় পাওয়ার নজির দেখা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অপরাধ করার পর বিভাগীয় আইনে শাস্তি পাওয়ার কথা অপরাধীর। আমাদের দেশে যখন কোনো প্রতিষ্ঠানে কারও বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ ওঠে, তখন ঢাকঢোল পিটিয়ে তদন্ত শুরু হলেও পরে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। ফলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া বড় কর্মকর্তাদের আর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় না। এসব ঘটনায় শাস্তি না পাওয়ার কারণ হলো ‘ছাড় দেওয়ার প্রবণতা’।

রাষ্ট্রের কাজ যাঁদের সুষ্ঠুভাবে দেখভাল করার দায়িত্ব, তাঁরাই যখন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন, তখন সিস্টেম বলে কিছু থাকে না। এই প্রকৌশলী দুটি অপরাধ করেছেন। প্রথমত, তিনি দরপত্রের মাধ্যমে কাজটি করেননি। দ্বিতীয়ত, ঠিকাদারকে বঞ্চিত করেছেন। কারণ, সরকারি কাজ দরপত্রের মাধ্যমে, ঠিকাদারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু তিনি অনিয়ম করেছেন এবং একই সঙ্গে ঠিকাদার বনে গেছেন!

বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের অবক্ষয় সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের দেশে ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। যদি বড় অপরাধে কঠিনতম শাস্তি দেওয়া হতো, তাহলে এ রকম অপরাধ করার সাহস কেউ পেত না।

দেশে আইন ও বিচারব্যবস্থা বলে কিছু আছে। এখনো সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। এ ধরনের অনিয়ম এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনাসহ দণ্ডিতদের বক্তব্য প্রচার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার

৭ কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে নীতিগত সিদ্ধান্ত, অধ্যাদেশ চূড়ান্তের অপেক্ষা

হঠাৎ বেশ কটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট ডাউন, যা জানা গেল

এনবিআর সদস্য বদিউল আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

২২ বছরের অপেক্ষা শেষে ভারতকে হারাল বাংলাদেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত