মামুনুর রশীদ
গত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল আমাদের স্বপ্নের দশক। ওই দশকেই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন গভীরভাবে উপলব্ধ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনা, সোনার বাংলাকে শ্মশান করার ষড়যন্ত্র, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের শিল্প-সাহিত্যও সেভাবেই আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও রাজনীতিবিদ—সবাই একসঙ্গে অনুভব করেছিলেন বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্র প্রয়োজন।
আন্দোলনের জোয়ার তখন সারা দেশে। মুসলিম লীগ সরকার একের পর এক আন্দোলনের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। সামরিক শাসন ছাড়া তাদের দেশ রক্ষার আর কোনো উপায় ছিল না। এই সামরিক জান্তা পরবর্তীকালে ২৫ মার্চ রাতে স্বদেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের একজন বিচারপতি (সম্ভবত বিচারপতি কায়ানি) বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম প্রাউড অব মাই আর্মি হু হ্যাভ কনকোয়ার্ড দেয়ার মাদারল্যান্ড।’ সবকিছুর মূলে ছিল একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা, সচ্ছল জীবন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মিলেমিশে সুখে থাকা। কিন্তু একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেই জায়গা থেকে আমরা সরে এসেছি।
আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম, আমাদের সংকটটা আরও বেশি ছিল। যুদ্ধের প্রান্তরে সহযোদ্ধারা যেভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই সব কথা মনে হলে আমরা শিহরিত হই। গুলিবিদ্ধ এক যোদ্ধা কামানের সামনে টিকতে পারছেন না, অন্য যোদ্ধারা তাঁকে সরে আসতে বলছেন, কিন্তু তিনি গান গাইতে গাইতে মৃত্যুকে মেনে নিলেন। এমনই অনেক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে ঘটেছে। বাংকারে বসে অনেক যোদ্ধার স্বপ্নের কথা শুনেছি এবং সবটা মিলিয়ে যা মনে হয়েছে, তা হলো দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ হবে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। সংবিধানে সেই জন্যই ঠাঁই পেয়েছিল সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র—এইসব কথা। এরপর সেই সংবিধান নানাভাবে কর্তিত হয়ে অন্য একটা চেহারা নিয়েছে।
এবারে সংবিধান সংস্কারে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাটি বাদই পড়ে যাচ্ছে। সমাজতন্ত্র তো আগেই বাদ পড়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় প্রবল ত্রুটি দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বাজার নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা— সবটাতে এই প্রবল দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। আমলাতন্ত্র গণমানুষের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রমকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় নিয়ে গেছে। কোনো দেশপ্রেমিক দক্ষ বিশেষজ্ঞের সুদূরপ্রসারী কোনো ভাবনাকে রাষ্ট্রের কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তখনকার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের পরামর্শকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন। আমলারা কালক্রমে সেসব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। উপজেলা থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বস্তরে আমলারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। জনপ্রতিনিধিরা আমলাতন্ত্রের শক্তির কাছে নিতান্তই দুর্বল বলে তাঁরা আমলাদের সুপারিশ মতোই কাজ করে থাকেন। কিন্তু আবার তাঁদের অসৎ উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য একটা যোগসাজশের সৃষ্টি হয়। জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য কোনো সুব্যবস্থা জনপ্রতিনিধি ও আমলারা সৃষ্টি করেনি। যেহেতু দীর্ঘ দীর্ঘ সময় সংসদ অকার্যকর থেকেছে, তাই জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্য জাতির সামনে হাজির করতে পারেননি। যার ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মাঝে মাঝে বিঘ্নিত হয়েছে এবং নির্বাচনগুলোতে তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা গেছে।
যেকোনো দেশের মানুষের সর্বশেষ আশ্রয় বিচারব্যবস্থা। বিচারব্যবস্থাও নিরপেক্ষভাবে কখনোই কাজ করতে পারেনি। এটা একটা দুর্ভাগ্য। আইনজীবীরা বিভক্ত এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই তাঁদের প্রধান কাজ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নয়। এই সমস্যা নিম্ন আদালত থেকে একেবারে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিস্তৃত। যেকোনো দেশে নাগরিকদের একটা ক্ষমতা থাকে। সেই ক্ষমতার প্রতিফলন ঘটাবার কোনো সুযোগ এই রাষ্ট্রে নেই। যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আসেন না, তাই জনগণের প্রতি তাঁদের জবাবদিহির কোনো প্রয়োজনই মনে করেন না। নিজেদের স্বার্থেই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। সরকারি দায়িত্ব এবং ক্ষমতাকে নিজের কাজেই ব্যবহার করেন।
আমাদের দেশে পেশাদার রাজনীতিবিদদের সংখ্যাও বেশ কম। কমিউনিস্ট পার্টিতে এবং সমাজতান্ত্রিক দলগুলোতে সার্বক্ষণিক নেতা ও কর্মীরা কাজ করতেন। সেই জন্য পার্টি থেকে একটা ভাতাও পেতেন। পার্টির এই খরচ সংকুলান করতে গণচাঁদার ব্যবস্থা ছিল। যে চাঁদার পরিমাণ চার আনা থেকে এক টাকা। কিছু গণতান্ত্রিক দলেও এই রকম গণচাঁদার ব্যবস্থা অনেক দিন পর্যন্ত ছিল। এখন আর সেই চাঁদার ব্যবস্থা নেই বরং রাজনীতিবিদদের বিত্ত গড়ে তোলার জন্য লাখ-কোটি টাকার চাঁদার ব্যবস্থা হয়েছে। এই চাঁদা আবার রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার জন্য।
জীবনধারণের জন্য একদা যে চাঁদার প্রয়োজন ছিল, এখন সেই চাঁদার টাকা বিদেশে উড়ে যায়। সংসদ সদস্যদের জন্য শুল্কহীন গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতেই বোঝা যায়, একজন সংসদ সদস্যকে কোটি টাকার গাড়িতে চড়তে হবে। আর এসবের ব্যবস্থা হবে চাঁদাবাজির দ্বারা। অবশ্য সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। তাই তাঁদের টাকার প্রয়োজনটাও তীব্র। পদাধিকারবলেই তাঁদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ক্ষমতার পালাবদলের পর দেখা যায় তাঁরা বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর এই সম্পদ রাষ্ট্রের সম্পদ।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের দেশটাকে শোষণ করেছে সন্দেহ নেই। ওই সময়ে ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি, করাচি সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাহাত্তর সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে এবং যে পরিমাণ বিদেশি সাহায্য এসেছে ঋণ, অনুদান এবং এনজিওর মাধ্যমে, সেই টাকা দিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা অমূলক নয়।
ওপরে কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তারপরও আছে নাগরিক চেতনার বিষয়, এই চেতনা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আসার কথা। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন একটি সুদূরপ্রসারী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নানা কারণে সেগুলোর কার্যকারিতা বন্ধ করে নতুন শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। টেক্সট বুক বোর্ড যথার্থ দক্ষতার সঙ্গে কোনো উপযোগী ব্যবস্থার চেষ্টা করেনি। কারণ সেটিও আমলাতন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা। এমনি করে দেশের
৫৪টি বছর কেটে গেল। এই পথযাত্রায় যত অনিয়ম, যত ভ্রান্তি, যত অদক্ষতা, যত স্বজনপ্রীতি এবং সর্বক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্র—সবটা মিলিয়ে একটা ভ্রান্তির পথে এসে দাঁড়িয়েছে।
সবাই জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। কিন্তু তাকিয়ে থাকেন পশ্চিমা বিশ্বের দিকে। দেশের অর্থসম্পদও সেই সব দেশে পাঠিয়ে দেন। এই করে করে আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি বটে, কিন্তু আমাদের স্বপ্নের সেই কল্যাণ রাষ্ট্র ধনীদের জন্য অভয়ারণ্য হয়েছে আর মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীনদের জন্য জীবনধারণের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আমরা নানা মতবাদে বিভক্ত হয়ে রয়েছি। কিন্তু জনকল্যাণের রাষ্ট্রের স্বপ্নটি এখনো অধরাই রয়ে গেছে। আমাদের অবকাঠামো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আছে কিন্তু তার ব্যবহার নেই। কোথাও কোথাও দুষ্কৃতকারীরা সেগুলো দখল করে বসে আছে। এই যে দখল শব্দটি দিন দিন একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় ছিল জায়গাজমি দখল, বাড়িঘর দখল, দোকানপাট দখল। কিন্তু এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে নদী দখল, দেশের খাসজমি দখল, নদীর তলদেশের বালুমহাল দখল। এই দখল যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কল্পনাই করা যায় না।
প্রায়ই পদ দখলের জন্য প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখতে পাই। আমরা কষ্ট করে কিছু অর্জনের কথা ভাবি না। তার চেয়ে সহজ পথ দখলের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। এই পরিস্থিতির বিপরীতে একটি কথাই বলা চলে অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে, তা হলো—শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক:– নাট্যব্যক্তিত্ব
গত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল আমাদের স্বপ্নের দশক। ওই দশকেই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন গভীরভাবে উপলব্ধ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনা, সোনার বাংলাকে শ্মশান করার ষড়যন্ত্র, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের শিল্প-সাহিত্যও সেভাবেই আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও রাজনীতিবিদ—সবাই একসঙ্গে অনুভব করেছিলেন বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্র প্রয়োজন।
আন্দোলনের জোয়ার তখন সারা দেশে। মুসলিম লীগ সরকার একের পর এক আন্দোলনের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। সামরিক শাসন ছাড়া তাদের দেশ রক্ষার আর কোনো উপায় ছিল না। এই সামরিক জান্তা পরবর্তীকালে ২৫ মার্চ রাতে স্বদেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের একজন বিচারপতি (সম্ভবত বিচারপতি কায়ানি) বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম প্রাউড অব মাই আর্মি হু হ্যাভ কনকোয়ার্ড দেয়ার মাদারল্যান্ড।’ সবকিছুর মূলে ছিল একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা, সচ্ছল জীবন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মিলেমিশে সুখে থাকা। কিন্তু একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সেই জায়গা থেকে আমরা সরে এসেছি।
আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম, আমাদের সংকটটা আরও বেশি ছিল। যুদ্ধের প্রান্তরে সহযোদ্ধারা যেভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই সব কথা মনে হলে আমরা শিহরিত হই। গুলিবিদ্ধ এক যোদ্ধা কামানের সামনে টিকতে পারছেন না, অন্য যোদ্ধারা তাঁকে সরে আসতে বলছেন, কিন্তু তিনি গান গাইতে গাইতে মৃত্যুকে মেনে নিলেন। এমনই অনেক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে ঘটেছে। বাংকারে বসে অনেক যোদ্ধার স্বপ্নের কথা শুনেছি এবং সবটা মিলিয়ে যা মনে হয়েছে, তা হলো দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ হবে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। সংবিধানে সেই জন্যই ঠাঁই পেয়েছিল সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র—এইসব কথা। এরপর সেই সংবিধান নানাভাবে কর্তিত হয়ে অন্য একটা চেহারা নিয়েছে।
এবারে সংবিধান সংস্কারে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাটি বাদই পড়ে যাচ্ছে। সমাজতন্ত্র তো আগেই বাদ পড়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় প্রবল ত্রুটি দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বাজার নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা— সবটাতে এই প্রবল দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। আমলাতন্ত্র গণমানুষের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রমকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় নিয়ে গেছে। কোনো দেশপ্রেমিক দক্ষ বিশেষজ্ঞের সুদূরপ্রসারী কোনো ভাবনাকে রাষ্ট্রের কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তখনকার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের পরামর্শকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন। আমলারা কালক্রমে সেসব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। উপজেলা থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বস্তরে আমলারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। জনপ্রতিনিধিরা আমলাতন্ত্রের শক্তির কাছে নিতান্তই দুর্বল বলে তাঁরা আমলাদের সুপারিশ মতোই কাজ করে থাকেন। কিন্তু আবার তাঁদের অসৎ উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য একটা যোগসাজশের সৃষ্টি হয়। জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য কোনো সুব্যবস্থা জনপ্রতিনিধি ও আমলারা সৃষ্টি করেনি। যেহেতু দীর্ঘ দীর্ঘ সময় সংসদ অকার্যকর থেকেছে, তাই জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্য জাতির সামনে হাজির করতে পারেননি। যার ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মাঝে মাঝে বিঘ্নিত হয়েছে এবং নির্বাচনগুলোতে তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা গেছে।
যেকোনো দেশের মানুষের সর্বশেষ আশ্রয় বিচারব্যবস্থা। বিচারব্যবস্থাও নিরপেক্ষভাবে কখনোই কাজ করতে পারেনি। এটা একটা দুর্ভাগ্য। আইনজীবীরা বিভক্ত এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই তাঁদের প্রধান কাজ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নয়। এই সমস্যা নিম্ন আদালত থেকে একেবারে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিস্তৃত। যেকোনো দেশে নাগরিকদের একটা ক্ষমতা থাকে। সেই ক্ষমতার প্রতিফলন ঘটাবার কোনো সুযোগ এই রাষ্ট্রে নেই। যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আসেন না, তাই জনগণের প্রতি তাঁদের জবাবদিহির কোনো প্রয়োজনই মনে করেন না। নিজেদের স্বার্থেই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। সরকারি দায়িত্ব এবং ক্ষমতাকে নিজের কাজেই ব্যবহার করেন।
আমাদের দেশে পেশাদার রাজনীতিবিদদের সংখ্যাও বেশ কম। কমিউনিস্ট পার্টিতে এবং সমাজতান্ত্রিক দলগুলোতে সার্বক্ষণিক নেতা ও কর্মীরা কাজ করতেন। সেই জন্য পার্টি থেকে একটা ভাতাও পেতেন। পার্টির এই খরচ সংকুলান করতে গণচাঁদার ব্যবস্থা ছিল। যে চাঁদার পরিমাণ চার আনা থেকে এক টাকা। কিছু গণতান্ত্রিক দলেও এই রকম গণচাঁদার ব্যবস্থা অনেক দিন পর্যন্ত ছিল। এখন আর সেই চাঁদার ব্যবস্থা নেই বরং রাজনীতিবিদদের বিত্ত গড়ে তোলার জন্য লাখ-কোটি টাকার চাঁদার ব্যবস্থা হয়েছে। এই চাঁদা আবার রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার জন্য।
জীবনধারণের জন্য একদা যে চাঁদার প্রয়োজন ছিল, এখন সেই চাঁদার টাকা বিদেশে উড়ে যায়। সংসদ সদস্যদের জন্য শুল্কহীন গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতেই বোঝা যায়, একজন সংসদ সদস্যকে কোটি টাকার গাড়িতে চড়তে হবে। আর এসবের ব্যবস্থা হবে চাঁদাবাজির দ্বারা। অবশ্য সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। তাই তাঁদের টাকার প্রয়োজনটাও তীব্র। পদাধিকারবলেই তাঁদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ক্ষমতার পালাবদলের পর দেখা যায় তাঁরা বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর এই সম্পদ রাষ্ট্রের সম্পদ।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের দেশটাকে শোষণ করেছে সন্দেহ নেই। ওই সময়ে ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি, করাচি সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাহাত্তর সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে এবং যে পরিমাণ বিদেশি সাহায্য এসেছে ঋণ, অনুদান এবং এনজিওর মাধ্যমে, সেই টাকা দিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা অমূলক নয়।
ওপরে কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তারপরও আছে নাগরিক চেতনার বিষয়, এই চেতনা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আসার কথা। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন একটি সুদূরপ্রসারী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নানা কারণে সেগুলোর কার্যকারিতা বন্ধ করে নতুন শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। টেক্সট বুক বোর্ড যথার্থ দক্ষতার সঙ্গে কোনো উপযোগী ব্যবস্থার চেষ্টা করেনি। কারণ সেটিও আমলাতন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা। এমনি করে দেশের
৫৪টি বছর কেটে গেল। এই পথযাত্রায় যত অনিয়ম, যত ভ্রান্তি, যত অদক্ষতা, যত স্বজনপ্রীতি এবং সর্বক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্র—সবটা মিলিয়ে একটা ভ্রান্তির পথে এসে দাঁড়িয়েছে।
সবাই জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। কিন্তু তাকিয়ে থাকেন পশ্চিমা বিশ্বের দিকে। দেশের অর্থসম্পদও সেই সব দেশে পাঠিয়ে দেন। এই করে করে আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি বটে, কিন্তু আমাদের স্বপ্নের সেই কল্যাণ রাষ্ট্র ধনীদের জন্য অভয়ারণ্য হয়েছে আর মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীনদের জন্য জীবনধারণের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আমরা নানা মতবাদে বিভক্ত হয়ে রয়েছি। কিন্তু জনকল্যাণের রাষ্ট্রের স্বপ্নটি এখনো অধরাই রয়ে গেছে। আমাদের অবকাঠামো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আছে কিন্তু তার ব্যবহার নেই। কোথাও কোথাও দুষ্কৃতকারীরা সেগুলো দখল করে বসে আছে। এই যে দখল শব্দটি দিন দিন একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় ছিল জায়গাজমি দখল, বাড়িঘর দখল, দোকানপাট দখল। কিন্তু এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে নদী দখল, দেশের খাসজমি দখল, নদীর তলদেশের বালুমহাল দখল। এই দখল যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কল্পনাই করা যায় না।
প্রায়ই পদ দখলের জন্য প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখতে পাই। আমরা কষ্ট করে কিছু অর্জনের কথা ভাবি না। তার চেয়ে সহজ পথ দখলের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। এই পরিস্থিতির বিপরীতে একটি কথাই বলা চলে অত্যন্ত দুর্বল কণ্ঠে, তা হলো—শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক:– নাট্যব্যক্তিত্ব
জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা দখলের জন্য শ্রীলঙ্কায় দুইবার (১৯৭১ ও ১৯৮৭-৮৯) সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহে তাদের দলের মূল নেতা রোহানা উইজেভরাসহ ৪০ হাজার নেতা-কর্মীসহ প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এই হঠকারী রাজনীতির কারণে দেশটিতে তাদের প্রচণ্ড সম
২০ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ হলো চ্যালাচামুণ্ডা। আমাদের ভাষাভাষী সমাজে এ শব্দটির দেখা পাননি বা এর অর্থের বলয়ে ধরা দেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ শব্দটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু যত সহজে শব্দটি আমরা পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে প্র
২০ ঘণ্টা আগেশরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে গফুর তার গরু মহেশকে গোহাটায় বিক্রির কথা চিন্তাও করতে পারে না, তার দুচোখ ভরে যায় জলে। গফুরের মতো গৃহপালিত প্রাণীদের এমন প্রেমময় প্রভু বাস্তবে হয়তো কমই আছে। নইলে ভারত থেকে অবৈধভাবে গরু-মহিষ চোরাচালানের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটত না এই অঞ্চলে। অনেক সময় খবর প্রকাশ পায়—ওই পারের পাহাড় থেক
২০ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনাটি ঘটিয়েছে তরুণেরাই। অতীতে বড় বড় ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্র-জনতা ঐক্যের ভিত্তিতেই। যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনার পতনও তরুণদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটল। কিন্তু আসলে ঘটেছেটা কী? সেটার বিবেচনাও জ
২ দিন আগে