রাজীব কুমার সাহা
বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ হলো চ্যালাচামুণ্ডা। আমাদের ভাষাভাষী সমাজে এ শব্দটির দেখা পাননি বা এর অর্থের বলয়ে ধরা দেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ শব্দটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু যত সহজে শব্দটি আমরা পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে প্রয়োগ করি, তত সহজে আমরা শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত বিষয়টি খেয়াল করি না। বাংলা ভাষায় এই শব্দটি কীভাবে প্রবেশ করল এবং কীভাবে নেতিবাচক অর্থে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, আজ জানব এর আদ্যোপান্ত।
ফারসি চ্যালা এবং বাংলা চামুণ্ডা শব্দ সহযোগে গঠিত হয়েছে চ্যালাচামুণ্ডা শব্দটি। চামুণ্ডা শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে সংস্কৃত শব্দ চণ্ডমুণ্ড থেকে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা অভিধান ঘাঁটলে প্রায় চার ধরনের চ্যালা ভুক্তির সম্মুখীন হই। প্রথম চ্যালা ভুক্তিটি হলো ফারসি থেকে আগত। ফারসি চ্যালা শব্দের অর্থ হলো শাগরেদ, অনুচর, সহচর, সহকারী, ছাত্র প্রমুখ। এটি বিশেষ্য পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিবিধ রচনায় উপরিউক্ত অর্থে ‘চেলা’ বানানে শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। দ্বিতীয় চ্যালা ভুক্তিটি বাংলা শব্দ। এর অর্থ হলো স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বিচরণ করে এমন বহু খণ্ডে বিভক্ত খয়েরি রঙের চ্যাপটা লম্বাটে দেহবিশিষ্ট দ্রুতগামী স্থলজ সন্ধিপদী (প্রতি খণ্ডে একজোড়া পা থাকে এমন) আর্থ্রোপোডা পর্বের আলোকবিমুখী প্রাণিবিশেষ। যেটি আমরা সচরাচর ঘরের কোনাকাঞ্চি বা ব্যবহৃত পানি বের হওয়ার ছিদ্রপথে দেখতে পাই। এটি বিশেষ্য পদ। তৃতীয় চ্যালাটি জ্বালানি কাঠকে নির্দেশ করে। এটি দেশি শব্দ এবং বিশেষ্য পদ। সাধারণত ফালি করে চেরাই করা কাঠকে আমরা চ্যালা বলি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কবির কৈফিয়ত’ প্রবন্ধ এবং ‘যোগাযোগ’ নাটকে চ্যালা বানানে শব্দটি ‘চেরাই করা কাঠ’ অর্থে ব্যবহার করেছেন। আর চতুর্থ চ্যালাটিও দেশি শব্দ এবং বিশেষ্য পদ। এর অর্থ হলো লম্বা ও চ্যাপটা দেহবিশিষ্ট ছোট আঁশযুক্ত সবুজাভ রুপালি মিঠাপানির ছোট মাছবিশেষ। গ্রামাঞ্চলে এটিকে বলা হয় চ্যালা মাছ।
এবার ফিরি চামুণ্ডার গল্পে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি চামুণ্ডা শব্দটি গঠিত হয়েছে সংস্কৃত চণ্ড ও মুণ্ড শব্দ সহযোগে। কিন্তু এই চণ্ড ও মুণ্ড আসলে কারা? এ দুটি শব্দ থেকে কীভাবে এল চামুণ্ডা শব্দটি? হিন্দুপুরাণ অনুসারে চণ্ড হলো একজন প্রসিদ্ধ দৈত্য। দৈত্যরাজ শুম্ভের প্রধান অনুচর ছিলেন চণ্ড। চণ্ডের ছোট ভাইয়ের নাম হলো মুণ্ড। এরা প্রায়ই দুইজন একসঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করত। দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধের সময় শুম্ভের আদেশে ধূম্রলোচনের (দানবরাজ শুম্ভের সেনাপতি) মৃত্যুর পর এরা দুই ভাই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন এবং দেবীর হাতে নিহত হন (দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রথমে চণ্ডকে বিনাশ করা হয় বলে দেবী ভগবতীর আরেক নাম চণ্ডী বা চণ্ডীকা)। এই দুই দৈত্যকে বধ করে চামুণ্ডা দেবী দুর্গার কাছে এদের মুণ্ড দান করেন। সেই থেকে এই দেবীর নাম হয় ‘চামুণ্ডা’। মূলত চামুণ্ডা দেবী দুর্গার কপাল থেকে উদ্ভূত হন। এ তো গেল চামুণ্ডার আক্ষরিক অর্থ। আলংকারিক অর্থেও আমরা চামুণ্ডা শব্দটি প্রয়োগ করি। আলংকারিক অর্থে সাধারণত উগ্র স্বভাববিশিষ্ট রমণীকে চামুণ্ডা বলা হয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় ‘উগ্রস্বভাবা’ অর্থে চামুণ্ডা শব্দটির দেখা পাই ‘চামুণ্ডা রণরঙ্গিণী ভাবী সাহেবা’ প্রয়োগবাক্যে, যা স্পষ্টতই চামুণ্ডা শব্দের আলংকারিক প্রয়োগ।
চ্যালাচামুণ্ডা শব্দটি তৈরি হয়েছে ফারসি চ্যালা এবং বাংলা চামুণ্ডা শব্দ সহযোগে। চামুণ্ডা শব্দটির স্বতন্ত্র অর্থ থাকলেও যাপিত জীবনে আমরা চ্যালা শব্দের সহযোগী হিসেবেই এটিকে দেখতে পাই। চ্যালাচামুণ্ডা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো শাগরেদ ও তার অনুচরবৃন্দ; ভক্তবৃন্দ প্রমুখ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চ্যালাচামুণ্ডা শব্দটি স্পষ্টতই নেতিবাচক অর্থ পরিগ্রহ করেছে। অর্থাৎ চ্যালাচামুণ্ডা অর্থে বর্তমানে আমরা তোষামোদকারী, দুষ্ট এবং উগ্র স্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বুঝিয়ে থাকি। যদিও চামুণ্ডা শব্দটির ব্যুৎপত্তির সঙ্গে উল্লিখিত আচরণাদির সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।
লেখক:– আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ হলো চ্যালাচামুণ্ডা। আমাদের ভাষাভাষী সমাজে এ শব্দটির দেখা পাননি বা এর অর্থের বলয়ে ধরা দেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ শব্দটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু যত সহজে শব্দটি আমরা পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অনুসারে প্রয়োগ করি, তত সহজে আমরা শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত বিষয়টি খেয়াল করি না। বাংলা ভাষায় এই শব্দটি কীভাবে প্রবেশ করল এবং কীভাবে নেতিবাচক অর্থে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে, আজ জানব এর আদ্যোপান্ত।
ফারসি চ্যালা এবং বাংলা চামুণ্ডা শব্দ সহযোগে গঠিত হয়েছে চ্যালাচামুণ্ডা শব্দটি। চামুণ্ডা শব্দটি বাংলা ভাষায় এসেছে সংস্কৃত শব্দ চণ্ডমুণ্ড থেকে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা অভিধান ঘাঁটলে প্রায় চার ধরনের চ্যালা ভুক্তির সম্মুখীন হই। প্রথম চ্যালা ভুক্তিটি হলো ফারসি থেকে আগত। ফারসি চ্যালা শব্দের অর্থ হলো শাগরেদ, অনুচর, সহচর, সহকারী, ছাত্র প্রমুখ। এটি বিশেষ্য পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিবিধ রচনায় উপরিউক্ত অর্থে ‘চেলা’ বানানে শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। দ্বিতীয় চ্যালা ভুক্তিটি বাংলা শব্দ। এর অর্থ হলো স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বিচরণ করে এমন বহু খণ্ডে বিভক্ত খয়েরি রঙের চ্যাপটা লম্বাটে দেহবিশিষ্ট দ্রুতগামী স্থলজ সন্ধিপদী (প্রতি খণ্ডে একজোড়া পা থাকে এমন) আর্থ্রোপোডা পর্বের আলোকবিমুখী প্রাণিবিশেষ। যেটি আমরা সচরাচর ঘরের কোনাকাঞ্চি বা ব্যবহৃত পানি বের হওয়ার ছিদ্রপথে দেখতে পাই। এটি বিশেষ্য পদ। তৃতীয় চ্যালাটি জ্বালানি কাঠকে নির্দেশ করে। এটি দেশি শব্দ এবং বিশেষ্য পদ। সাধারণত ফালি করে চেরাই করা কাঠকে আমরা চ্যালা বলি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কবির কৈফিয়ত’ প্রবন্ধ এবং ‘যোগাযোগ’ নাটকে চ্যালা বানানে শব্দটি ‘চেরাই করা কাঠ’ অর্থে ব্যবহার করেছেন। আর চতুর্থ চ্যালাটিও দেশি শব্দ এবং বিশেষ্য পদ। এর অর্থ হলো লম্বা ও চ্যাপটা দেহবিশিষ্ট ছোট আঁশযুক্ত সবুজাভ রুপালি মিঠাপানির ছোট মাছবিশেষ। গ্রামাঞ্চলে এটিকে বলা হয় চ্যালা মাছ।
এবার ফিরি চামুণ্ডার গল্পে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি চামুণ্ডা শব্দটি গঠিত হয়েছে সংস্কৃত চণ্ড ও মুণ্ড শব্দ সহযোগে। কিন্তু এই চণ্ড ও মুণ্ড আসলে কারা? এ দুটি শব্দ থেকে কীভাবে এল চামুণ্ডা শব্দটি? হিন্দুপুরাণ অনুসারে চণ্ড হলো একজন প্রসিদ্ধ দৈত্য। দৈত্যরাজ শুম্ভের প্রধান অনুচর ছিলেন চণ্ড। চণ্ডের ছোট ভাইয়ের নাম হলো মুণ্ড। এরা প্রায়ই দুইজন একসঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করত। দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধের সময় শুম্ভের আদেশে ধূম্রলোচনের (দানবরাজ শুম্ভের সেনাপতি) মৃত্যুর পর এরা দুই ভাই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন এবং দেবীর হাতে নিহত হন (দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রথমে চণ্ডকে বিনাশ করা হয় বলে দেবী ভগবতীর আরেক নাম চণ্ডী বা চণ্ডীকা)। এই দুই দৈত্যকে বধ করে চামুণ্ডা দেবী দুর্গার কাছে এদের মুণ্ড দান করেন। সেই থেকে এই দেবীর নাম হয় ‘চামুণ্ডা’। মূলত চামুণ্ডা দেবী দুর্গার কপাল থেকে উদ্ভূত হন। এ তো গেল চামুণ্ডার আক্ষরিক অর্থ। আলংকারিক অর্থেও আমরা চামুণ্ডা শব্দটি প্রয়োগ করি। আলংকারিক অর্থে সাধারণত উগ্র স্বভাববিশিষ্ট রমণীকে চামুণ্ডা বলা হয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় ‘উগ্রস্বভাবা’ অর্থে চামুণ্ডা শব্দটির দেখা পাই ‘চামুণ্ডা রণরঙ্গিণী ভাবী সাহেবা’ প্রয়োগবাক্যে, যা স্পষ্টতই চামুণ্ডা শব্দের আলংকারিক প্রয়োগ।
চ্যালাচামুণ্ডা শব্দটি তৈরি হয়েছে ফারসি চ্যালা এবং বাংলা চামুণ্ডা শব্দ সহযোগে। চামুণ্ডা শব্দটির স্বতন্ত্র অর্থ থাকলেও যাপিত জীবনে আমরা চ্যালা শব্দের সহযোগী হিসেবেই এটিকে দেখতে পাই। চ্যালাচামুণ্ডা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো শাগরেদ ও তার অনুচরবৃন্দ; ভক্তবৃন্দ প্রমুখ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চ্যালাচামুণ্ডা শব্দটি স্পষ্টতই নেতিবাচক অর্থ পরিগ্রহ করেছে। অর্থাৎ চ্যালাচামুণ্ডা অর্থে বর্তমানে আমরা তোষামোদকারী, দুষ্ট এবং উগ্র স্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বুঝিয়ে থাকি। যদিও চামুণ্ডা শব্দটির ব্যুৎপত্তির সঙ্গে উল্লিখিত আচরণাদির সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।
লেখক:– আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
গত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল আমাদের স্বপ্নের দশক। ওই দশকেই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন গভীরভাবে উপলব্ধ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনা, সোনার বাংলাকে শ্মশান করার ষড়যন্ত্র, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এব
১৯ ঘণ্টা আগেজনতা বিমুক্তি পেরামুনা (পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা দখলের জন্য শ্রীলঙ্কায় দুইবার (১৯৭১ ও ১৯৮৭-৮৯) সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহে তাদের দলের মূল নেতা রোহানা উইজেভরাসহ ৪০ হাজার নেতা-কর্মীসহ প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এই হঠকারী রাজনীতির কারণে দেশটিতে তাদের প্রচণ্ড সম
১৯ ঘণ্টা আগেশরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে গফুর তার গরু মহেশকে গোহাটায় বিক্রির কথা চিন্তাও করতে পারে না, তার দুচোখ ভরে যায় জলে। গফুরের মতো গৃহপালিত প্রাণীদের এমন প্রেমময় প্রভু বাস্তবে হয়তো কমই আছে। নইলে ভারত থেকে অবৈধভাবে গরু-মহিষ চোরাচালানের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটত না এই অঞ্চলে। অনেক সময় খবর প্রকাশ পায়—ওই পারের পাহাড় থেক
২০ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনাটি ঘটিয়েছে তরুণেরাই। অতীতে বড় বড় ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্র-জনতা ঐক্যের ভিত্তিতেই। যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদবিরোধী নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনার পতনও তরুণদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঘটল। কিন্তু আসলে ঘটেছেটা কী? সেটার বিবেচনাও জ
২ দিন আগে