কেবল প্রতিশোধ, উচিত শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা থেকে আমাদের রাজনীতি মুক্ত হতে পারছে না। ভালো কাজ, ভালো উদ্যোগ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনের রাস্তায় আমাদের দেশে কেউই খুব একটা হাঁটতে চায় না। ফলে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্ধকারও কাটে না। অথচ বড় হওয়ার সর্বোত্তম রাস্তা নিজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি ইতিবাচক উদ্যোগ।
চিররঞ্জন সরকার
ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর এক অভাবনীয় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট আর ক্ষমতার দম্ভে অতিষ্ঠ মানুষ চেয়েছিল দেশ থেকে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট বন্ধ হবে। জিনিসপত্রের দাম সহনীয় থাকবে। সবাই খেয়ে-পরে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দায়িত্ব গ্রহণের পর নানা ধরনের স্বপ্ন দেখানো শুরু করলেন। সেই স্বপ্নের খেয়ায় দেশবাসীও ভেসে যেতে থাকল। তাঁরা বললেন যে, আগামীর বাংলাদেশ হবে একটা পরিবর্তিত দেশ, যেখানে পরিবর্তিত রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হবে, যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। সমাজজীবনের সবখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর হবে। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সহযোগী হবে, যারা ভালো কাজ করবে, তারাই নির্বাচিত হবে। মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতার ভিত্তিতে চাকরি ও পদোন্নতি হবে। তবে পিছিয়ে থাকা অংশকেও সামনে টেনে আনা হবে। কেউ কারও পদানত থাকবে না। সব ধরনের শ্রেণি-পেশা, মত ও ধর্মের মানুষকে নিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। আরও অনেক স্বপ্ন ও সংস্কারের কথা তাঁরা শুনিয়েছিলেন।
কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার এমন কোনো কিছু করে দেখাতে পারেনি, যাতে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারে। ভিন্নমত, ভিন্নধর্মীদের ওপর আক্রমণ ও সহিংসতা এখনো বন্ধ হয়নি। জিনিসপত্রের দাম কমেনি। বিগত সরকারের আমলে যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনেক বড় বড় কথা বলা হয়েছিল, সেই সিন্ডিকেট এখনো বহাল আছে। দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজেরা এখন ভিন্ন জার্সি পরে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দাপট ও ক্ষমতার দম্ভও বন্ধ হয়নি। একদলের পরিবর্তে আরেক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে মাত্র। কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা বাড়ছে। গ্যাসের অভাবে রান্নাবান্নাও ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুর ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এতে করে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। এদিকে পুলিশ বাহিনীতে অনেক ওলট-পালট করেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুন চলছে অপ্রতিহত গতিতে। বিআরটিএ, শিক্ষা অফিস, ভূমি অফিসসহ সবখানে ঘুষ-দুর্নীতি চলছে অবাধে। মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না। ব্যক্তিগত যোগাযোগ, দলীয় পরিচয় এখনো প্রশাসনের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির মূল বিষয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ছাড়া কূটনীতিতেও তেমন কোনো সাফল্য নেই। ভারতের সঙ্গে বৈরীভাব দিনে দিনে বাড়ছেই। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা না করে গোঁয়ার্তুমি ও জেদকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অনুপ্রবেশ এখনো চলছে। রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা-ফান্ড একটু একটু করে কমছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো সদ্ভাব নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গেও বিএনপির বিরোধ চলছে। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেই। আওয়ামী লীগ সিদ্ধ না নিষিদ্ধ, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রতি নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রতি যেমন আচরণ করা হয়, তেমনটাই করা হচ্ছে। এতে করে দলটির হাজার হাজার নেতা-কর্মী, যাঁরা কোনো রকম অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁরাও নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বারবার ঘোষণা দিয়েছেন, তারা যা কিছু করবেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে করবেন। কিন্তু তারা আসলে কী করছেন, কতটুকু করছেন, সেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বিএনপি প্রায়ই অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থন যদি না থাকে, তাহলে সরকার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে কাদের নিয়ে, কীভাবে?
মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র ভীষ্মদেব বলেছিলেন, ‘শাসক কখনো পরিস্থিতির ক্রীতদাস হবে না; বরং তার কর্মের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি বদলে দেবেন।’ কিন্তু আমরা যেন কেবলই পরিস্থিতির দাসে পরিণত হচ্ছি। রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার, তারা কেন স্বাধীনভাবে এবং শক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না? কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিচ্ছে? কিছুই স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। সরকার কীভাবে চলছে, মন্ত্রণালয় কী করছে, তা কেউ জানে না। প্রশাসনযন্ত্রকে জামভর্তা বানানো হয়েছে। অদক্ষদের হাতে দায়দায়িত্ব। দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগে যোগ্যদের ঢালাওভাবে সাইডলাইনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসন, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষার পরিবেশ—সবখানে বিশৃঙ্খলা। রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির কোনো সূচকেই ভালো কোনো লক্ষণ নেই। বড়লোকেরা টাকা বিনিয়োগ করছেন না। সবাই যেন রুদ্ধশ্বাসে কিসের অপেক্ষা করছেন। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম স্থবিরতা বিরাজ করছে। হ্যাঁ, এত কিছুর পরও দেশে কোটিপতির সংখ্যা, কোটিপতি ব্যাংক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বৈষম্য বেড়েছে অনেক বেশি। অনেকে মধ্যবিত্ত কৃষক থেকে গরিব কৃষকে পরিণত হয়েছেন। ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ছিন্নমূল, নদীভাঙা মানুষের শহরমুখী স্রোত কতটা বেড়েছে, আয়বঞ্চনা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে গরিব মানুষ খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারছে, সে খবর কে রাখে? এগুলোর কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানও হয়তো নেই। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের রোজগার কমেছে ভয়াবহ হারে। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে স্বল্প আয়ের মানুষ কিছুতেই আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে পারছে না। অর্থনীতির দুর্যোগ কাটছে না। রিজার্ভ কমছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় লেনদেন। অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ দূর হচ্ছে না। অপব্যয়, দুর্নীতি কমানোর কোনো কঠোর অঙ্গীকার নেই। সিন্ডিকেট আছে, কিন্তু ভাঙার কেউ নেই।
এটি পরিষ্কার যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে তেমন কোনো গতি নেই, স্পষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। সবচেয়ে বেশি অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে গণমাধ্যম। আপাতদৃষ্টিতে মুক্ত গণমাধ্যমের বাতাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রোপাগান্ডা মেশিন হয়ে কাজ করছে অনেক মিডিয়া হাউস। গুরুত্বপূর্ণ অনেক খবর চেপে যাওয়া অথবা পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচার স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদল ভুঁইফোড় সাংবাদিক চারদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বা ‘ফ্যাসিবাদের সমর্থক’ এই ট্যাগিং গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরেছে। গণমাধ্যমের মালিকেরা টিকে থাকার স্বার্থে কেউ কোনো ঝুঁকি নিচ্ছেন না। সদা সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি, মহলবিশেষের কোপানলে পড়ার ভয় সাংবাদিক সমাজকে নির্জীব বানিয়ে দিয়েছে। চাকরি টিকিয়ে রাখা এবং বেতন-ভাতা বন্ধ হওয়ার ভয়ে সবাই ‘কর্তা ভজা কীর্ত্তন’ গেয়ে চলেছেন। গণমাধ্যমগুলোর রাজনৈতিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু পরিবর্তন হয়েছে তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবন্দনা।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে যে এত বড় একটা রাজনৈতিক ঝড় বয়ে গেল, তার প্রভাব মাত্র ছয় মাসেই নিঃশেষ হতে চলেছে। কেবল শাসনযন্ত্রের পরিচালক বা নিয়ন্ত্রকদের পরিবর্তনটাই দৃশ্যমান। শাসনপ্রণালি, দল ও শাসকশ্রেণির চিন্তাভাবনায় তেমন কোনো পরিবর্তনের ছাপ নেই। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বদলে দেশের নিপীড়িত ও ক্ষমতাহীন শ্রেণির স্বার্থে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইন পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ ও অঙ্গীকার নেই। প্রকৃত সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য যে ধরনের শ্রেণি সমাবেশ দরকার, মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও আধিপত্য দরকার, দেশে তার কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ঘটছে না। যে সম্ভাবনা ও জাগরণের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু করেছিল, তা ধরে রাখা যায়নি। বৈষম্যের বিরুদ্ধে, পুরোনো শাসনব্যবস্থা, পুরোনো জমানা পরিবর্তনের পক্ষে যে জনমত সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে ভেস্তে যেতে বসেছে।
কেবল প্রতিশোধ, উচিত শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা থেকে আমাদের রাজনীতি মুক্ত হতে পারছে না। ভালো কাজ, ভালো উদ্যোগ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনের রাস্তায় আমাদের দেশে কেউই খুব একটা হাঁটতে চায় না। ফলে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্ধকারও কাটে না। অথচ বড় হওয়ার সর্বোত্তম রাস্তা নিজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি ইতিবাচক উদ্যোগ। কেবল অন্যকে ছোট করে, অন্যের সমালোচনা করে বড় হওয়ার চেষ্টা ভুল এবং বিপজ্জনক। আমাদের রাজনীতি এই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না। বরং দিনে দিনে সেটাই জনপ্রিয় হচ্ছে। সমালোচনা করলেই হেনস্তার চেষ্টা হচ্ছে। কম-বেশি সবখানেই এই প্রবণতা চলছে।
অথচ ইতিহাস অন্য কথা বলে। ইতিহাস শুধু কিছু অতীত ঘটনার সাক্ষীই নয়, শিক্ষাও দেয়। কী করা উচিত আর কোনটা এড়িয়ে চলা দরকার, ইতিহাস সেই শিক্ষাও দেয়। সেই শিক্ষাটা কেউ নেবে কি না, সেটা অবশ্য নিতান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর এক অভাবনীয় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট আর ক্ষমতার দম্ভে অতিষ্ঠ মানুষ চেয়েছিল দেশ থেকে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট বন্ধ হবে। জিনিসপত্রের দাম সহনীয় থাকবে। সবাই খেয়ে-পরে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দায়িত্ব গ্রহণের পর নানা ধরনের স্বপ্ন দেখানো শুরু করলেন। সেই স্বপ্নের খেয়ায় দেশবাসীও ভেসে যেতে থাকল। তাঁরা বললেন যে, আগামীর বাংলাদেশ হবে একটা পরিবর্তিত দেশ, যেখানে পরিবর্তিত রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হবে, যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। সমাজজীবনের সবখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর হবে। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সহযোগী হবে, যারা ভালো কাজ করবে, তারাই নির্বাচিত হবে। মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতার ভিত্তিতে চাকরি ও পদোন্নতি হবে। তবে পিছিয়ে থাকা অংশকেও সামনে টেনে আনা হবে। কেউ কারও পদানত থাকবে না। সব ধরনের শ্রেণি-পেশা, মত ও ধর্মের মানুষকে নিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। আরও অনেক স্বপ্ন ও সংস্কারের কথা তাঁরা শুনিয়েছিলেন।
কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার এমন কোনো কিছু করে দেখাতে পারেনি, যাতে দেশবাসী আশ্বস্ত হতে পারে। ভিন্নমত, ভিন্নধর্মীদের ওপর আক্রমণ ও সহিংসতা এখনো বন্ধ হয়নি। জিনিসপত্রের দাম কমেনি। বিগত সরকারের আমলে যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনেক বড় বড় কথা বলা হয়েছিল, সেই সিন্ডিকেট এখনো বহাল আছে। দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজেরা এখন ভিন্ন জার্সি পরে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দাপট ও ক্ষমতার দম্ভও বন্ধ হয়নি। একদলের পরিবর্তে আরেক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে মাত্র। কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা বাড়ছে। গ্যাসের অভাবে রান্নাবান্নাও ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুর ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এতে করে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। এদিকে পুলিশ বাহিনীতে অনেক ওলট-পালট করেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুন চলছে অপ্রতিহত গতিতে। বিআরটিএ, শিক্ষা অফিস, ভূমি অফিসসহ সবখানে ঘুষ-দুর্নীতি চলছে অবাধে। মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না। ব্যক্তিগত যোগাযোগ, দলীয় পরিচয় এখনো প্রশাসনের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির মূল বিষয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ছাড়া কূটনীতিতেও তেমন কোনো সাফল্য নেই। ভারতের সঙ্গে বৈরীভাব দিনে দিনে বাড়ছেই। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা না করে গোঁয়ার্তুমি ও জেদকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অনুপ্রবেশ এখনো চলছে। রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা-ফান্ড একটু একটু করে কমছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো সদ্ভাব নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গেও বিএনপির বিরোধ চলছে। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেই। আওয়ামী লীগ সিদ্ধ না নিষিদ্ধ, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রতি নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রতি যেমন আচরণ করা হয়, তেমনটাই করা হচ্ছে। এতে করে দলটির হাজার হাজার নেতা-কর্মী, যাঁরা কোনো রকম অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁরাও নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বারবার ঘোষণা দিয়েছেন, তারা যা কিছু করবেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে করবেন। কিন্তু তারা আসলে কী করছেন, কতটুকু করছেন, সেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বিএনপি প্রায়ই অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থন যদি না থাকে, তাহলে সরকার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে কাদের নিয়ে, কীভাবে?
মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র ভীষ্মদেব বলেছিলেন, ‘শাসক কখনো পরিস্থিতির ক্রীতদাস হবে না; বরং তার কর্মের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি বদলে দেবেন।’ কিন্তু আমরা যেন কেবলই পরিস্থিতির দাসে পরিণত হচ্ছি। রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার, তারা কেন স্বাধীনভাবে এবং শক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না? কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দিচ্ছে? কিছুই স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। সরকার কীভাবে চলছে, মন্ত্রণালয় কী করছে, তা কেউ জানে না। প্রশাসনযন্ত্রকে জামভর্তা বানানো হয়েছে। অদক্ষদের হাতে দায়দায়িত্ব। দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগে যোগ্যদের ঢালাওভাবে সাইডলাইনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসন, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষার পরিবেশ—সবখানে বিশৃঙ্খলা। রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির কোনো সূচকেই ভালো কোনো লক্ষণ নেই। বড়লোকেরা টাকা বিনিয়োগ করছেন না। সবাই যেন রুদ্ধশ্বাসে কিসের অপেক্ষা করছেন। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চরম স্থবিরতা বিরাজ করছে। হ্যাঁ, এত কিছুর পরও দেশে কোটিপতির সংখ্যা, কোটিপতি ব্যাংক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বৈষম্য বেড়েছে অনেক বেশি। অনেকে মধ্যবিত্ত কৃষক থেকে গরিব কৃষকে পরিণত হয়েছেন। ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ছিন্নমূল, নদীভাঙা মানুষের শহরমুখী স্রোত কতটা বেড়েছে, আয়বঞ্চনা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে গরিব মানুষ খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারছে, সে খবর কে রাখে? এগুলোর কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানও হয়তো নেই। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের রোজগার কমেছে ভয়াবহ হারে। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে স্বল্প আয়ের মানুষ কিছুতেই আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে পারছে না। অর্থনীতির দুর্যোগ কাটছে না। রিজার্ভ কমছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় লেনদেন। অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ দূর হচ্ছে না। অপব্যয়, দুর্নীতি কমানোর কোনো কঠোর অঙ্গীকার নেই। সিন্ডিকেট আছে, কিন্তু ভাঙার কেউ নেই।
এটি পরিষ্কার যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে তেমন কোনো গতি নেই, স্পষ্ট কোনো গন্তব্য নেই। সবচেয়ে বেশি অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে গণমাধ্যম। আপাতদৃষ্টিতে মুক্ত গণমাধ্যমের বাতাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রোপাগান্ডা মেশিন হয়ে কাজ করছে অনেক মিডিয়া হাউস। গুরুত্বপূর্ণ অনেক খবর চেপে যাওয়া অথবা পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচার স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদল ভুঁইফোড় সাংবাদিক চারদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বা ‘ফ্যাসিবাদের সমর্থক’ এই ট্যাগিং গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরেছে। গণমাধ্যমের মালিকেরা টিকে থাকার স্বার্থে কেউ কোনো ঝুঁকি নিচ্ছেন না। সদা সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি, মহলবিশেষের কোপানলে পড়ার ভয় সাংবাদিক সমাজকে নির্জীব বানিয়ে দিয়েছে। চাকরি টিকিয়ে রাখা এবং বেতন-ভাতা বন্ধ হওয়ার ভয়ে সবাই ‘কর্তা ভজা কীর্ত্তন’ গেয়ে চলেছেন। গণমাধ্যমগুলোর রাজনৈতিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু পরিবর্তন হয়েছে তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবন্দনা।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে যে এত বড় একটা রাজনৈতিক ঝড় বয়ে গেল, তার প্রভাব মাত্র ছয় মাসেই নিঃশেষ হতে চলেছে। কেবল শাসনযন্ত্রের পরিচালক বা নিয়ন্ত্রকদের পরিবর্তনটাই দৃশ্যমান। শাসনপ্রণালি, দল ও শাসকশ্রেণির চিন্তাভাবনায় তেমন কোনো পরিবর্তনের ছাপ নেই। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বদলে দেশের নিপীড়িত ও ক্ষমতাহীন শ্রেণির স্বার্থে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইন পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ ও অঙ্গীকার নেই। প্রকৃত সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য যে ধরনের শ্রেণি সমাবেশ দরকার, মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও আধিপত্য দরকার, দেশে তার কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ঘটছে না। যে সম্ভাবনা ও জাগরণের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু করেছিল, তা ধরে রাখা যায়নি। বৈষম্যের বিরুদ্ধে, পুরোনো শাসনব্যবস্থা, পুরোনো জমানা পরিবর্তনের পক্ষে যে জনমত সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা যথাযথ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে ভেস্তে যেতে বসেছে।
কেবল প্রতিশোধ, উচিত শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা থেকে আমাদের রাজনীতি মুক্ত হতে পারছে না। ভালো কাজ, ভালো উদ্যোগ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনের রাস্তায় আমাদের দেশে কেউই খুব একটা হাঁটতে চায় না। ফলে আমাদের জাতীয় জীবনের অন্ধকারও কাটে না। অথচ বড় হওয়ার সর্বোত্তম রাস্তা নিজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি ইতিবাচক উদ্যোগ। কেবল অন্যকে ছোট করে, অন্যের সমালোচনা করে বড় হওয়ার চেষ্টা ভুল এবং বিপজ্জনক। আমাদের রাজনীতি এই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না। বরং দিনে দিনে সেটাই জনপ্রিয় হচ্ছে। সমালোচনা করলেই হেনস্তার চেষ্টা হচ্ছে। কম-বেশি সবখানেই এই প্রবণতা চলছে।
অথচ ইতিহাস অন্য কথা বলে। ইতিহাস শুধু কিছু অতীত ঘটনার সাক্ষীই নয়, শিক্ষাও দেয়। কী করা উচিত আর কোনটা এড়িয়ে চলা দরকার, ইতিহাস সেই শিক্ষাও দেয়। সেই শিক্ষাটা কেউ নেবে কি না, সেটা অবশ্য নিতান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
‘ভালো মা’ বা একজন ‘খারাপ মা’ দেখতে কেমন, তা বোঝা যায় বাংলা সিনেমা কিংবা ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখলে। সাধারণত ভালো মা মানেই পর্দায় ভেসে ওঠে সাদাসিধে শাড়ি পরা একজন নারীর ছবি। সিনেমায় পদে পদে তার অসহায়ত্ব দেখতে পাবেন। চোখে পড়বে মুখ বুজে সব গঞ্জনা, অপবাদ সহ্য় করার ব্যাপারটি।
১৪ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নতুন নয়। এক পক্ষের তৃপ্তি এগুলো বাড়িয়ে বলায়, আরেক পক্ষের স্বস্তি অস্বীকারে। রোববার আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ‘পুলিশের অনুসন্ধান: সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-ভাঙচুরের ৯৮% রাজনৈতিক’।
১৪ ঘণ্টা আগেগত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দুই দিনের ব্যবধানে দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। গত ২২ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকায় একের পর এক ছিনতাই, চলাচলে ভয়’। এর আগে ২০ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘স্বস্তি ফিরছে না জনমনে
২ দিন আগেদল বা দেশ পরিচালনায়—এক ব্যক্তির, এক পরিবারের আধিপত্যের ঢং দেখানো গণতন্ত্র দেখেই অভ্যস্ত আমরা। সেটি যে শুধু গত ১৫ বছরেই দেখেছি—তা নয়, আগেও তা ছিল। যদি বলি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই, তাহলেও মিথ্যা বলা হবে না। অতি স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এই ঢং দেখানো গণতন্ত্রও ক্ষণে ক্ষণে হোঁচট খেয়েছে।
২ দিন আগে