আরও গতিশীল হোক নারী অধিকার আন্দোলন

শুধু কাজের সমতা নয়, অফিস কিংবা আবাসস্থলে জেন্ডারনির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পরিবহনব্যবস্থায় সবার নিরাপত্তাই সমান কাম্য, তবে সমাজের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এটা বিবেচনার দাবি রাখে যে কর্মক্ষেত্র থেকে যেকোনো নারী যেন নির্বিঘ্নে তাঁর বাড়ি পৌঁছাতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা গণপরিবহনগুলো যেন নারীবান্ধব হয়।

ড. মো. গোলাম রহমান
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮: ০০

সংবাদমাধ্যমে জেন্ডার সমতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সম্প্রতি হয়ে গেল এক সেমিনার। সেই সেমিনারে ‘সংবাদমাধ্যমে জেন্ডারবিষয়ক অঙ্গীকার সনদ’ উপস্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অংশীজন তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। বিভিন্ন পেশা এবং পারিবারিকভাবে দেশে নারীর অবস্থান, বৈষম্য এবং তাঁদের ওপর সহিংসতার বিষয়ে আলোচনা হয়। শিক্ষক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, উন্নয়নকর্মী, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, আইন বিশেষজ্ঞসহ অনেকেই এতে অংশগ্রহণ করেন।

সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যম আমাদের দেশে কয়েক দশক যাবৎ জেন্ডার বা লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। আমরা দেখছি সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এটিও সচেতন মানবগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপে আলোচনার বড় স্থান দখল করে আছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যায় নারী-পুরুষ প্রায় সমান সমান। নারী শতকরা ৫০.৫ এবং পুরুষ ৪৯.৫ ভাগ। কিন্তু অতিসম্প্রতি কোনো কোনো পরিসংখানে দেখা যাচ্ছে পুরুষ জনসংখ্যা নারীর তুলনায় অল্প বেশি। যাহোক, আমাদের দেশে পিছিয়ে থাকা নারী সমাজের সার্বিক চিত্র নিশ্চয়ই কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

দেশের বিভিন্ন অফিস বা প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মানবসম্পদের হিসাব করলে দেখা যাবে নারীর উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। শুধু সংখ্যায় কম নয়, কোনো প্রতিষ্ঠানে জনাকয়েক নারীকে পাওয়া গেলেও শীর্ষস্থানীয় পদে আসীন নারীর সংখ্যা অত্যন্ত কম বা নেই বললেই চলে। ঐতিহাসিক সত্য হলো, যুগ যুগ ধরে নারীরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন কিংবা পুরুষ কর্তৃক শোষিত হয়েছেন। এই ঐতিহাসিক সত্য যতই অপ্রিয় হোক না কেন তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলো পুরুষশাসিত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরির কোনো প্রচেষ্টা তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে হয়নি। যা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে শিক্ষা গ্রহণের ফলে এবং সমাজে অর্থনৈতিক চাপের কারণে কোনো পরিবারের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে, তখন এই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে ধারণা করি। সেই জন্য কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতার আবহ তৈরি করা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে স্কুল-কলেজে আমাদের দেশের মেয়েরা এগিয়েছে। একসময় পিছিয়ে থাকা মেয়েশিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য মিড-ডে মিল বা দুপুরে খাবার দেওয়া, উপবৃত্তি, স্কুল ফি মওকুফ—এসব প্রোগ্রাম যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ২০০৫ সাল থেকে হিসাবে দেখা যায়, প্রাইমারি স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বা ড্রপআউটের সংখ্যা ৪৭ ভাগ, ২০১০ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ৪০ ভাগে, ২০১৫-তে তা দাঁড়ায় প্রায় ২০ ভাগ, ২০২০-এ এসে তা দাঁড়ায় ১৭.২০ এবং সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায় ২০২২-এ প্রায় ১৪ ভাগ (Bangladesh Education Statistics 2022)। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রাইমারি স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের দেখভাল করতে পারলে এই উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হতে পারে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর আসনব্যবস্থা ও তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে নারী-পুরুষ সমতা আনা সহজ হতো।

আমাদের অফিসগুলোতে নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় সব জেন্ডারের অংশগ্রহণ সমানভাবে কার্যকর করতে পারলে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক ন্যায্যতাও প্রতিষ্ঠিত করা সহজ ও স্বাভাবিক হতো। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারী এবং প্রান্তিক জেন্ডারের বৈষম্য এই সমাজে প্রবল। সেইসব ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং যথাযথ ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান করা সহজ হতো। কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার-সংবেদনশীল আচরণবিধি তৈরি করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তা আলোচনার মাধ্যমে পালন করার পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই জেন্ডারবৈষম্য যুগ যুগ ধরে চলে আসা অভ্যাসের ফলে অসমতার গভীর শিকড় গেড়ে বসেছে। এই শিকড় উৎপাটন করতে হলে শুধু স্লোগাননির্ভর আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। অফিস থেকে হেঁশেল, আদালত থেকে ড্রয়িংরুম, শিক্ষালয় থেকে খেলার মাঠ—সব ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তাভাবনার জগৎকে নাড়া দিতে হবে। নাড়া দিতে হবে জীবন-জীবিকার প্রতিটি স্তরে নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা বিধান এবং সব ধরনের কাজে সবাইকে সমান সুযোগ করে দেওয়ার মন ও মানসিকতা তৈরি করা। বাড়ির আঙিনা থেকে অফিসের করিডর—সর্বত্রই এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হবে। বিদ্যালয়ের নিম্ন শ্রেণি থেকে উচ্চ শ্রেণি এবং সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে অংশগ্রহণ করলে সমাজে নারী-পুরুষের অবস্থান এবং তাঁদের সমান মর্যাদার বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

এই প্রচেষ্টায় জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ এবং স্থান-নির্বিশেষে সবার ‘মাইন্ডসেট’ লক্ষ করে একটি সাধারণীকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যাতে সব মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। এটা প্রত্যাশা করা সমীচীন হবে না যে দেশের সব মানুষই এই কাজে একসঙ্গে নিয়োজিত হবে, বরং পরিকল্পনা করতে হবে যেন সব পেশা ও শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব বিদ্যমান থাকে। একটি জলাশয়ে ঢিল ছুড়ে তার ঢেউয়ের স্তরকে কেন্দ্র থেকে পাড়ের দিকে ধাবমান হওয়ার লহরির দৃশ্যের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কেন্দ্রের প্রভাব শেষতক সবার কাছেই পৌঁছাবে। প্রতিনিধিত্ব বিজ্ঞানসম্মত হলে কার্যক্রমের ফলাফল ফলপ্রসূ হবে।

শুধু কাজের সমতা নয়, অফিস কিংবা আবাসস্থলে জেন্ডারনির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পরিবহনব্যবস্থায় সবার নিরাপত্তাই সমান কাম্য, তবে সমাজের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এটা বিবেচনার দাবি রাখে যে কর্মক্ষেত্র থেকে যেকোনো নারী যেন নির্বিঘ্নে তাঁর বাড়ি পৌঁছাতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা গণপরিবহনগুলো যেন নারীবান্ধব হয়। আমরা জানি, সব পরিবহনে নারীর জন্য আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান আছে, কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে প্রতিপালিত হয় না। নারী জনসংখ্যার অনুপাতে আসন সংরক্ষণের বিধিবিধান খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে না। যত দিন না নারীরা কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন, তত দিন পর্যন্ত আসন সংরক্ষণের এই অনুপাত নারীর ক্ষেত্রে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যখন কাজের সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের সমানুপাতিক হবে, তখন নারীরা নিজেরাই অনেক বেশি স্বনির্ভর হয়ে উঠবেন।

সমাজে, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বড় ধরনের একটি হুমকি। ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি প্রতিরোধকল্পে হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি সংস্থায় অভিযোগ প্রতিকার কমিটি গঠনের বিধান হয়েছে। এই কমিটি এসব বৈষম্যের অভিযোগ মীমাংসার ব্যবস্থা করবে। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধরনের উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করেছি। তবে প্রতিকারের প্রত্যাশায় না থেকে শুরুতেই কোনো ব্যক্তি এই ধরনের কাজে যেন লিপ্ত না হয়, সেই প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের ‘মাইন্ডসেট’ তৈরিতে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার সচেতনতা বৃদ্ধিতে আরও কৌশলী এবং নিবেদিতপ্রাণ হওয়া প্রয়োজন।

নারী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে সহিংসতা, সংঘর্ষ, প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগসহ যেকোনো বৈরী পরিবেশে বা যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও চাপ, ডিজিটাল হয়রানি, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা এবং আইনগত ঝুঁকি ও হয়রানিসহ সব ধরনের নিরাপত্তাহীনতা থেকে সব কর্মীর সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় লিখিত নীতি ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। নারী এবং প্রান্তিক জেন্ডারের সাংবাদিকদের নৈশকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।

বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় ‘মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই)’ জেন্ডারবিষয়ক অঙ্গীকার সনদ উপস্থাপন করে সমাজে নারীদের অধিকারের এই সামগ্রিক বিষয়টি পুনরায় তুলে ধরেছে। যুগ যুগ ধরে নারীবঞ্চনা এবং নারীর ক্ষমতায়নের যে আন্দোলন চালু আছে, তার একটি সংগঠিত পদক্ষেপই এই সেমিনারের মূল আলোচ্য বলে আমার মনে হয়েছে। গতানুগতিকভাবে এই আন্দোলন চলতে থাকলে সার্বিকভাবে নারীসমাজের খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারার সম্ভাবনা কম, অতএব এই আন্দোলনকে কাঙ্ক্ষিত রূপ দিতে হলে এ বিষয়ে গভীর তৎপরতা গ্রহণ করা ব্যতীত কোনো বিকল্প নেই।

ড. মো. গোলাম রহমান, সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত