নারী নির্যাতন কমাতে প্রতিরোধ বাড়ুক

সানজিদা সামরিন
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২১, ০৯: ৩০

১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট যে ঘটনাটি ঘটেছিল দিনাজপুরে, ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তার বিচার হয়েছিল। দিনটি এখন জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। অনেকেই মনে করতে পারবেন দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনের কথা। তিন পুলিশ সদস্য ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করেছিল। ঢাকায় কাজ করত ইয়াসমিন। ওই দিন সে ঢাকা থেকে ফিরছিল তার দিনাজপুরের বাড়িতে। পুলিশের একটি পিকআপ তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে উঠিয়ে নেয়। এরপর ঘটেছিল সেই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ঘটনাটির খবর প্রকাশ পেলে দিনাজপুরের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে প্রতিবাদ হতে থাকে এবং প্রতিরোধ আন্দোলন একটা মাত্রা পেয়ে যায়।

ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি বড় বিষয় বলে নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। নইলে একটা ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তারা বিপদে পড়বে।

ইয়াসমিনের বয়স ছিল ১৩। ২৩ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী বাসে উঠে বসেছিল কিশোরী ইয়াসমিন। বাসের কর্মচারীরা ভোররাতে ইয়াসমিনকে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে এক চায়ের দোকানদারের জিম্মায় রেখে বলে দেয়, তিনি যেন সকাল হলে ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী বাসে তুলে দেন। এর কিছুক্ষণ পর কোতোয়ালি পুলিশের একটি টহল পিকআপ এসে হাজির হয় সেই চায়ের দোকানের সামনে। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পিকআপে থাকা পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে জোর করে পিকআপে তুলে নেন। পথেই তাঁরা এই কিশোরীকে ধর্ষণ করেন এবং তারপর হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে মহাসড়কের গোবিন্দপুর কার্যালয়ের সামনে।

ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারিত হলে উত্তাল হয়ে ওঠে দিনাজপুর। চলতে থাকে আন্দোলন। পুলিশ সেই আন্দোলন দমনের নামে গুলি চালায় এবং তাতে নিহত হন ৭ আন্দোলনকারী। দুই শতাধিক মানুষ হন আহত। আন্দোলন তখন পরিণত হয়েছে জাতীয় আন্দোলনে।

মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, উত্তাল আন্দোলন হলে দিনাজপুরের পুলিশ বাহিনীকে লাইনে ক্লোজড করা হয়। ১৪৪ ধারা এবং কারফিউ জারি করা হয়। তখনকার বিডিআর নামানো হয়। কিন্তু তাতে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। পরে দিনাজপুরের বিশিষ্টজনরা এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে।

এরপর মামলা হয় এবং অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দিনাজপুরের তৎকালীন কোতোয়ালি থানার সহকারী উপপরিদর্শক মইনুল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার এবং পুলিশের পিকআপ চালক অমৃত লাল রায়ের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।

ইয়াসমিনের কথা এতটা বিশদে বলার কারণ হলো, সাধারণ মানুষ যদি কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তাহলে বিচার যে পাওয়া যায়, তার একটি ভালো দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘটনাটি। আমাদের দেশে নারী নির্যাতন বিষয়ে ধীরে ধীরে সচেতনতা আসছে। কিন্তু সেটা মোটেই উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী নির্যাতন নানা ভেক ধরে অব্যাহত আছে। মাঝেমধ্যেই নারী নির্যাতনবিষয়ক যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়, তাতে এ কথাই মনে হয় যে, এখনো নারী তার সত্যিকারের স্থান পাওয়ার জায়গা থেকে অনেক অনেক দূরে।

নারীর ব্যাপারে পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গি নারী নির্যাতনের একটা বড় কারণ। শিশু বয়স থেকে শুরু করে বড় হতে হতে নানা ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হয় নারী। একসময় অ্যাসিড-সন্ত্রাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। এখন একটু কমলেও নারী নির্যাতন কমেনি। পরিবারের মধ্যে যৌতুকের জন্য হত্যার শিকার হয়েছে নারী, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে নারী। এখনো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিচারহীনতার কারণে নারী নির্যাতন বাড়তে থাকে। নিপীড়ক যদি কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাধর হয়ে থাকে কিংবা অর্থকড়ির মালিক হয়ে থাকে, তাহলে নারীর পক্ষে বিচার পাওয়া খুব কঠিন। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত কয়েকটি খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নাটোর সদর উপজেলায় বিদেশে চাকরি দেওয়ার নাম করে এক কিশোরীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছেন দুই ব্যক্তি, বরিশালের আগৈলঝাড়ায় নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে, বরিশালের উজিরপুরে শিশু ধর্ষণের চেষ্টা, সুনামগঞ্জে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ, কসবায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণের শিকার, নোয়াখালীতে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়েছে এক নারীকে। এগুলো হলো আইসবার্গের ওপরের অংশ। তলে তলে আরও কত কিছু যে ঘটে যাচ্ছে, সেটা অনুভব করাও কঠিন।

বিভিন্ন সময়ে নারী নির্যাতনের শিকার কল্পনা চাকমা, সোহাগী জাহান তনু, মিতু, আফসানার নাম উচ্চারণ করলেই এ ধরনের ঘটনার একটা মানচিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন প্রতিরোধের নানামুখী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা কঠিন কিছু নয়।

কিন্তু নিজ বাসভূমে নারীকে নির্যাতনমুক্ত রাখতে হলে পুরুষের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা একান্ত প্রয়োজন। প্রচলিত কুসংস্কার ও নানা ধরনের দমননীতির কারণে নারী হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। দেশের সর্বোচ্চ মহলে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও দেশের বৃহৎ পরিসরে নারীর ওপর নির্যাতন একেবারেই কমছে না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই বিষয়টি বোঝা সহজ হবে। এখনকার দিনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীবিষয়ক কোনো স্ট্যাটাস দিলে সে স্ট্যাটাসের নিচে যে মন্তব্যগুলো করা হয়ে থাকে, সেগুলোর দিকে চোখ বোলালেই পরিষ্কার হবে, কেন আমাদের দেশে নারীর এই অবস্থান। 
বড় বড় বক্তৃতায় কিংবা সেমিনার- সিম্পোজিয়ামে নারীমুক্তির আহ্বান নারীর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটাবে না। নারীর প্রতি ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোটা জরুরি। আর এ পরিবর্তনের শুরুটা হওয়া প্রয়োজন একেবারে ঘর থেকেই। না বললেই নয়, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন বদলানো প্রয়োজন তেমনি এক নারীর প্রতি অপর নারীর দৃষ্টিভঙ্গিও বদলানো প্রয়োজন। 

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত