বিভুরঞ্জন সরকার
গত দুটি ঈদ উদ্যাপন হয়েছে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশে। করোনা নামক ভয়াবহ মরণব্যাধির কারণে মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এবার আমাদের দেশে করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। ফলে ঈদ উদ্যাপনের আয়োজনে এবার তোড়জোড় ব্যাপক। বিপুলসংখ্যক মানুষ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য ঢাকা ছেড়েছেন। আবার ঢাকায় এসেছেনও কেউ কেউ। লাখ লাখ মানুষের আসা-যাওয়ার কারণে যাত্রাপথ যতটা কষ্টকর হবে বলে মনে করা হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি। ব্যাপক যানজট সেভাবে হয়নি। মানুষের ক্রমক্ষমতা যে বেড়েছে, তা বাজারে-দোকানে-শপিংমলের কেনাকাটার বহর দেখেই বোঝা যায়। তাহলে কি সব মানুষ সমান আনন্দে ঈদ উদ্যাপন করছেন? না, তা অবশ্যই নয়। অভাবী মানুষও দেশে অনেক আছেন। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েও কারও কারও জীবনে ঈদ এসেছে। দেশে সম্পদ বেড়েছে। অভাব একেবারে দূর হয়নি। তবে ‘হররোজ রোজা’ রাখার মতো লোক কমলেও দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন লোকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।
আমাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাকিস্তানে। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি পাকিস্তানে। আর এটাও আমাদের সবার জানা যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল সাম্প্রদায়িক। দ্বিজাতি তত্ত্ব ছিল পাকিস্তানের ভিত্তি। হিন্দুর জন্য আলাদা রাষ্ট্র, মুসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র—এই চরম সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থাটি তখনকার রাজনীতির কারবারিরা মেনে নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন পরিণতি পেয়েছিল দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে। ভাবা হয়েছিল, এভাবে ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে শান্তি আসবে, স্বস্তি আসবে, আসবে দুই ধর্মবিশ্বাসী মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি। হিন্দুর জন্য ভারত, মুসলমানের জন্য পাকিস্তান। দেশ ভাগের পর দেখা গেল চিত্র ভিন্ন হয়েছে। পাকিস্তানে কিছু হিন্দু থাকল, ভারতে মুসলমান। দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, রক্ত, অশ্রু, বেদনা-বিচ্ছেদের সকরুণ অসংখ্য কাহিনি তৈরি করেও ভারতকে মুসলমানমুক্ত করা যায়নি, পাকিস্তানকেও হিন্দুমুক্ত। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো এবং দুই দেশের রাজনীতিতেই সাম্প্রদায়িকতা স্থায়ীভাবে জায়গা পেয়ে গেল। যদিও ভারত রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্ম নয়, ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করল আর পাকিস্তান থাকল ধর্ম নিয়েই। ধর্ম মানে ইসলাম ধর্ম।
হিন্দুরা পাকিস্তানে থাকল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। তাদের মর্যাদা এবং অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও নিরুপায় বিপুলসংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠী পাকিস্তানে থেকে যায়। যেমন আমরা ছিলাম। আমরা ছোটবেলায় কেমন দেখেছিলাম আমাদের মুসলমান প্রতিবেশী, এলাকাবাসী ও বন্ধুদের? বলতে দ্বিধা নেই, আমরা যে তখন খুব অনিরাপদ বোধ করেছি কিংবা কথায় কথায় আমাদের সম্মানহানির ঘটনা ঘটত, তা কিন্তু নয়। মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব নিয়েই আমরা থেকেছি, চলেছি। ‘মালাউন’ শব্দটি তখন খুব শুনেছি বলেও মনে পড়ে না। পূজার সময় মুসলমান বন্ধুদের যেমন পাশে পেয়েছি, ঈদেও আমরা তাদের সঙ্গে থেকেছি। নামাজ পড়তাম না; কিন্তু ঈদ জামাতের কাছে উপস্থিত থাকতাম। নামাজ শেষে কোলাকুলি করতাম। মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে তাদের বাসায় গিয়ে সেমাই-পোলাও খেতাম। মুসলিম বন্ধুরাও মন্দিরে গিয়ে পূজা-প্রার্থনায় অংশ না নিয়েও উপস্থিত থেকে আমাদের উৎসাহিত করত, প্রসাদ গ্রহণে দ্বিধা করত না। উৎসবগুলো মূলত ধর্মীয় হলেও তাতে সম্প্রীতির খুব ঘাটতি ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম হলেও মানুষে মানুষে সম্পর্কটা অকৃত্রিমই ছিল।
সব ধর্মের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সবার সম্মিলিত ত্যাগ, কষ্ট, অশ্রু, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল অসাম্প্রদায়িক পথে। ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রনীতি। যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অংশ নিয়েছিলেন, তারা ভেবেছিলেন যেহেতু পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, সেহেতু পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চিন্তাও পরাভূত হয়েছে। এই ভাবনাটি ছিল অতিসরলীকরণ দোষে দুষ্ট। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনোজগতের ব্যাপার। এর গড়ে ওঠা এবং বেড়ে ওঠা সব সময় দৃশ্যমানও হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ামাত্রই মানুষের মন থেকে পাকিস্তানি মানসিকতা দূর হয়ে গেছে বলে ভাবনাটির মধ্যেই চরম গলদ ছিল। তখন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে অত উচ্ছ্বাসপ্রবণ না হয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে প্রচার চালানো উচিত ছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এক পক্ষ যখন বাইরে গদগদ ভাব প্রকাশে ব্যস্ত, অন্য পক্ষ, মানে পরাজিত পক্ষ তখন এ নিয়ে বিরুদ্ধ-প্রচারে বাতাস বিষাক্ত করে চলছিল। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা নিজ নিজ এলাকা থেকে গা-ঢাকা দিয়ে অন্য এলাকায় গিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়ে প্রচার চালিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ধর্মহীনতা। কিছু কিছু বাস্তব কারণে সাধারণ মানুষ ওই প্রচারণায় বিভ্রান্তও হয়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপথ বদলে দেওয়া হয়। পেছনে হাঁটা শুরু হয়। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সামরিক ডিকটেটর এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে বাংলাদেশকে আবার কার্যত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
তার পর বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা নতুন মাত্রা পেতে থাকে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কেউ নিজেদের ‘ধর্মহীন’ প্রমাণ করতে চায় না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কেবলই বাড়ছে। আওয়ামী লীগও এখন আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে না। ধর্ম নিয়ে যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, যারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষক, তাদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ ‘কৌশলগত’ ঐক্য ও সমঝোতার পথেই চলছে। বাংলাদেশ আবার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে—এটা অনেকটা কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়।
এবার আসা যাক উৎসব প্রসঙ্গে। উৎসবের আভিধানিক অর্থ—আনন্দানুষ্ঠান, ধুমধাম। অর্থাৎ, যেসব আনন্দ আয়োজন ধুমধাম করে করা হয়, তাকে আমরা উৎসব বলতে পারি। উৎসবকে আনন্দ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করা হয়। কারও আবার উৎসব হলো ব্যক্তিগত কিংবা জাতিগত আইডেনটিটি বা পরিচয়চিহ্ন। উৎসব বিভিন্ন রকম হয় বা হতে পারে। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, ঐতিহ্যগত ইত্যাদি ধরনের উৎসবের সঙ্গে আমাদের মোটামুটি পরিচয় আছে। উৎসবের উৎপত্তি মূলত লোক বিশ্বাস এবং ধর্মবিশ্বাস থেকে। আমাদের দেশে ধর্মীয় বিশ্বাসজনিত উৎসবই ব্যাপকতা লাভ করেছে। ঈদ, পূজা, বড়দিন ইত্যাদি উৎসবের ভিত্তি হলো ধর্মাচার বা ধর্ম। আর পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনকে বলা যায় ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে বাঙালির ঐতিহ্যগত সামাজিক উৎসব। মেলা, খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, গান-নাচ, যাত্রা—এসব একই সঙ্গে উৎসব এবং সংস্কৃতি। উৎসব তো আসলে সংস্কৃতিরই অংশ। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে কিছু দিবস আছে, যেগুলোর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস—উৎসবমুখর পরিবেশে এগুলো পালনের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছার পথ রচনা করে উৎসব। উৎসবের উদ্দেশ্য হলো সবাইকে এক করা, ভাগ করা নয়। উৎসব সবসময় একটা মিলনের জায়গা তৈরি করে। একা একা উৎসব করা যায় না। উৎসব করতে হলে একত্রিত হতে হয়, মিলিত হতে হয়। উৎসবের সঙ্গে সাজসজ্জা, পোশাক, খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলো জড়িত। উৎসবস্থলকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো, নতুন পোশাক পরিধান করা এবং ভালো বা উন্নত মানের খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে কিসের উৎসব! ধর্মীয় কিংবা সামাজিক—সব উৎসবেই এগুলো দরকার। শুভেচ্ছা কার্ড ও উপহার বিনিময় করাও উৎসবের অনুষঙ্গ। যেকোনো উৎসব আয়োজনই মানুষে মানুষে নৈকট্য বাড়ায়। আর মানুষ যত কাছাকাছি আসে, তত তার মধ্যে শুভবোধের উন্মেষ হয়, মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটে। উৎসবের মূল কথা হলো—সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে, উদারতা দেখাতে হবে। উৎসবই প্রকৃতপক্ষে সম্প্রীতির পথ রচনা করে। আমরা কি উৎসবের এই মর্মবাণী উপলব্ধি করে উৎসবে শামিল হই?
সংখ্যা দিয়ে, ধর্ম দিয়ে যখন মানুষকে বিবেচনা করা হয়, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই মানবিকতাটা গৌণ হয়ে পড়ে। আধুনিক গণতন্ত্র সংখ্যাধিক্যের বিষয়টিকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে যে, সংখ্যায় একজন বেশি হলেই আধিপত্য করার সুযোগ তৈরি হয়। আজ সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু নিয়ে পৃথিবী জোড়া যে সংকট, তা কি গণতন্ত্রের একটি কুফল? ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও আজকাল বড় ধরনের লড়াই শুরু হয়েছে। ফলে ধর্ম এখন শান্তি ও মিলনের উৎস না হয়ে অশান্তি ও বিভেদের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যে দেশে যে ধর্মানুসারীরা সংখ্যায় বেশি, সে দেশে তারা সংখ্যালঘুদের পীড়ন করাকে এক রকম অধিকার হিসেবে দেখছে। এর সঙ্গে আবার আছে রাজনীতি, রাজনৈতিক কূটনীতি। মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখার কারণেই সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। অন্য দেশের কথা বাদ থাক, আমরা বাংলাদেশেই আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখি।
আমাদের দেশে কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিরাজ করছে? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি বা হয় না। রক্তাক্ত ভায়োলেন্স না হলেও এখানে এক প্রকার নীরব সন্ত্রাস সব সময় চলে আসছে। এখানে সংখ্যালঘুরা পলায়নপর মানসিকতার কারণে পাল্টা আক্রমণ করতে পারে না। সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার সংখ্যালঘুদের দিন দিনই সংকুচিত হয়ে আসছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নানা ধরনের জুলুম-অত্যাচার ঘটছে। কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের জমি-জমা, সম্পদ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি হামলার শিকার হচ্ছে, কখনো কখনো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। উপাসনালয়ে আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু নারীরা ধর্ষণের শিকার হলে ভয়ভীতি দেখিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়া থেকেও বিরত রাখা হয়। দেশে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে। অনিরাপদ জীবন ছেড়ে তারা অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছেন।
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি, একটি ঘটনা থেকেও তৈরি হয়নি। এর পটভূমি ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না—ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।’ আবার ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন: ‘হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যটা আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশি অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশি প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই।’
এ সব ধরা-ছোঁয়ার বিষয় এখন আর নেই। কিন্তু পূর্ব পুরুষের মুখে শোনা গল্প এখন নতুন করে বিশ্বাসের মূলে নাড়া দিচ্ছে না, কী করে অস্বীকার করি?
মুসলমানরা যে হিন্দুদের পাশাপাশি থেকেও ক্রমে পৃথক হয়ে গেল তার দায় কি তৎকালীন হিন্দু সমাজপতি ও রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চাপানো যায় না? পশ্চিমবঙ্গের গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখছেন: ‘আজও পশ্চিমবঙ্গে প্রচারের ধারাটা এমন যে, মুসলমানরা পাকিস্তান চাইল বলেই দেশ ভাগ হয়ে গেল। তাদের জানা থাকে না যে, পাকিস্তানের আগে মুসলমানরা চেয়েছিলেন মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে অধিকার স্বীকার করা হয়নি বলেই, ওঠে পাকিস্তানের দাবি।’
মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত না হলে মানুষ ‘আলাদা’বোধ করবেই। যেটা এখন বাংলাদেশের হিন্দুরা করছে।
এবারের ঈদ উৎসব কি আমাদের মধ্যে একতাবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে পারবে?
লেখক: আজকের পত্রিকার সহকারী সম্পাদক
গত দুটি ঈদ উদ্যাপন হয়েছে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশে। করোনা নামক ভয়াবহ মরণব্যাধির কারণে মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এবার আমাদের দেশে করোনা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। ফলে ঈদ উদ্যাপনের আয়োজনে এবার তোড়জোড় ব্যাপক। বিপুলসংখ্যক মানুষ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য ঢাকা ছেড়েছেন। আবার ঢাকায় এসেছেনও কেউ কেউ। লাখ লাখ মানুষের আসা-যাওয়ার কারণে যাত্রাপথ যতটা কষ্টকর হবে বলে মনে করা হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি। ব্যাপক যানজট সেভাবে হয়নি। মানুষের ক্রমক্ষমতা যে বেড়েছে, তা বাজারে-দোকানে-শপিংমলের কেনাকাটার বহর দেখেই বোঝা যায়। তাহলে কি সব মানুষ সমান আনন্দে ঈদ উদ্যাপন করছেন? না, তা অবশ্যই নয়। অভাবী মানুষও দেশে অনেক আছেন। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েও কারও কারও জীবনে ঈদ এসেছে। দেশে সম্পদ বেড়েছে। অভাব একেবারে দূর হয়নি। তবে ‘হররোজ রোজা’ রাখার মতো লোক কমলেও দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন লোকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।
আমাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাকিস্তানে। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি পাকিস্তানে। আর এটাও আমাদের সবার জানা যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল সাম্প্রদায়িক। দ্বিজাতি তত্ত্ব ছিল পাকিস্তানের ভিত্তি। হিন্দুর জন্য আলাদা রাষ্ট্র, মুসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র—এই চরম সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থাটি তখনকার রাজনীতির কারবারিরা মেনে নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলন পরিণতি পেয়েছিল দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে। ভাবা হয়েছিল, এভাবে ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে শান্তি আসবে, স্বস্তি আসবে, আসবে দুই ধর্মবিশ্বাসী মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি। হিন্দুর জন্য ভারত, মুসলমানের জন্য পাকিস্তান। দেশ ভাগের পর দেখা গেল চিত্র ভিন্ন হয়েছে। পাকিস্তানে কিছু হিন্দু থাকল, ভারতে মুসলমান। দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, রক্ত, অশ্রু, বেদনা-বিচ্ছেদের সকরুণ অসংখ্য কাহিনি তৈরি করেও ভারতকে মুসলমানমুক্ত করা যায়নি, পাকিস্তানকেও হিন্দুমুক্ত। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো এবং দুই দেশের রাজনীতিতেই সাম্প্রদায়িকতা স্থায়ীভাবে জায়গা পেয়ে গেল। যদিও ভারত রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্ম নয়, ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করল আর পাকিস্তান থাকল ধর্ম নিয়েই। ধর্ম মানে ইসলাম ধর্ম।
হিন্দুরা পাকিস্তানে থাকল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। তাদের মর্যাদা এবং অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও নিরুপায় বিপুলসংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠী পাকিস্তানে থেকে যায়। যেমন আমরা ছিলাম। আমরা ছোটবেলায় কেমন দেখেছিলাম আমাদের মুসলমান প্রতিবেশী, এলাকাবাসী ও বন্ধুদের? বলতে দ্বিধা নেই, আমরা যে তখন খুব অনিরাপদ বোধ করেছি কিংবা কথায় কথায় আমাদের সম্মানহানির ঘটনা ঘটত, তা কিন্তু নয়। মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব নিয়েই আমরা থেকেছি, চলেছি। ‘মালাউন’ শব্দটি তখন খুব শুনেছি বলেও মনে পড়ে না। পূজার সময় মুসলমান বন্ধুদের যেমন পাশে পেয়েছি, ঈদেও আমরা তাদের সঙ্গে থেকেছি। নামাজ পড়তাম না; কিন্তু ঈদ জামাতের কাছে উপস্থিত থাকতাম। নামাজ শেষে কোলাকুলি করতাম। মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে তাদের বাসায় গিয়ে সেমাই-পোলাও খেতাম। মুসলিম বন্ধুরাও মন্দিরে গিয়ে পূজা-প্রার্থনায় অংশ না নিয়েও উপস্থিত থেকে আমাদের উৎসাহিত করত, প্রসাদ গ্রহণে দ্বিধা করত না। উৎসবগুলো মূলত ধর্মীয় হলেও তাতে সম্প্রীতির খুব ঘাটতি ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম হলেও মানুষে মানুষে সম্পর্কটা অকৃত্রিমই ছিল।
সব ধর্মের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সবার সম্মিলিত ত্যাগ, কষ্ট, অশ্রু, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল অসাম্প্রদায়িক পথে। ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছিল অন্যতম রাষ্ট্রনীতি। যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অংশ নিয়েছিলেন, তারা ভেবেছিলেন যেহেতু পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, সেহেতু পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চিন্তাও পরাভূত হয়েছে। এই ভাবনাটি ছিল অতিসরলীকরণ দোষে দুষ্ট। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনোজগতের ব্যাপার। এর গড়ে ওঠা এবং বেড়ে ওঠা সব সময় দৃশ্যমানও হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ামাত্রই মানুষের মন থেকে পাকিস্তানি মানসিকতা দূর হয়ে গেছে বলে ভাবনাটির মধ্যেই চরম গলদ ছিল। তখন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে অত উচ্ছ্বাসপ্রবণ না হয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে প্রচার চালানো উচিত ছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এক পক্ষ যখন বাইরে গদগদ ভাব প্রকাশে ব্যস্ত, অন্য পক্ষ, মানে পরাজিত পক্ষ তখন এ নিয়ে বিরুদ্ধ-প্রচারে বাতাস বিষাক্ত করে চলছিল। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা নিজ নিজ এলাকা থেকে গা-ঢাকা দিয়ে অন্য এলাকায় গিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়ে প্রচার চালিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ধর্মহীনতা। কিছু কিছু বাস্তব কারণে সাধারণ মানুষ ওই প্রচারণায় বিভ্রান্তও হয়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপথ বদলে দেওয়া হয়। পেছনে হাঁটা শুরু হয়। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সামরিক ডিকটেটর এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে বাংলাদেশকে আবার কার্যত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
তার পর বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা নতুন মাত্রা পেতে থাকে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কেউ নিজেদের ‘ধর্মহীন’ প্রমাণ করতে চায় না। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কেবলই বাড়ছে। আওয়ামী লীগও এখন আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে না। ধর্ম নিয়ে যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, যারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষক, তাদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ ‘কৌশলগত’ ঐক্য ও সমঝোতার পথেই চলছে। বাংলাদেশ আবার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে—এটা অনেকটা কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়।
এবার আসা যাক উৎসব প্রসঙ্গে। উৎসবের আভিধানিক অর্থ—আনন্দানুষ্ঠান, ধুমধাম। অর্থাৎ, যেসব আনন্দ আয়োজন ধুমধাম করে করা হয়, তাকে আমরা উৎসব বলতে পারি। উৎসবকে আনন্দ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করা হয়। কারও আবার উৎসব হলো ব্যক্তিগত কিংবা জাতিগত আইডেনটিটি বা পরিচয়চিহ্ন। উৎসব বিভিন্ন রকম হয় বা হতে পারে। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, ঐতিহ্যগত ইত্যাদি ধরনের উৎসবের সঙ্গে আমাদের মোটামুটি পরিচয় আছে। উৎসবের উৎপত্তি মূলত লোক বিশ্বাস এবং ধর্মবিশ্বাস থেকে। আমাদের দেশে ধর্মীয় বিশ্বাসজনিত উৎসবই ব্যাপকতা লাভ করেছে। ঈদ, পূজা, বড়দিন ইত্যাদি উৎসবের ভিত্তি হলো ধর্মাচার বা ধর্ম। আর পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনকে বলা যায় ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে বাঙালির ঐতিহ্যগত সামাজিক উৎসব। মেলা, খেলাধুলা, নৌকা বাইচ, গান-নাচ, যাত্রা—এসব একই সঙ্গে উৎসব এবং সংস্কৃতি। উৎসব তো আসলে সংস্কৃতিরই অংশ। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে কিছু দিবস আছে, যেগুলোর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই। বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস—উৎসবমুখর পরিবেশে এগুলো পালনের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছার পথ রচনা করে উৎসব। উৎসবের উদ্দেশ্য হলো সবাইকে এক করা, ভাগ করা নয়। উৎসব সবসময় একটা মিলনের জায়গা তৈরি করে। একা একা উৎসব করা যায় না। উৎসব করতে হলে একত্রিত হতে হয়, মিলিত হতে হয়। উৎসবের সঙ্গে সাজসজ্জা, পোশাক, খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলো জড়িত। উৎসবস্থলকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো, নতুন পোশাক পরিধান করা এবং ভালো বা উন্নত মানের খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে কিসের উৎসব! ধর্মীয় কিংবা সামাজিক—সব উৎসবেই এগুলো দরকার। শুভেচ্ছা কার্ড ও উপহার বিনিময় করাও উৎসবের অনুষঙ্গ। যেকোনো উৎসব আয়োজনই মানুষে মানুষে নৈকট্য বাড়ায়। আর মানুষ যত কাছাকাছি আসে, তত তার মধ্যে শুভবোধের উন্মেষ হয়, মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটে। উৎসবের মূল কথা হলো—সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে, উদারতা দেখাতে হবে। উৎসবই প্রকৃতপক্ষে সম্প্রীতির পথ রচনা করে। আমরা কি উৎসবের এই মর্মবাণী উপলব্ধি করে উৎসবে শামিল হই?
সংখ্যা দিয়ে, ধর্ম দিয়ে যখন মানুষকে বিবেচনা করা হয়, তখন স্বাভাবিক নিয়মেই মানবিকতাটা গৌণ হয়ে পড়ে। আধুনিক গণতন্ত্র সংখ্যাধিক্যের বিষয়টিকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে যে, সংখ্যায় একজন বেশি হলেই আধিপত্য করার সুযোগ তৈরি হয়। আজ সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু নিয়ে পৃথিবী জোড়া যে সংকট, তা কি গণতন্ত্রের একটি কুফল? ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও আজকাল বড় ধরনের লড়াই শুরু হয়েছে। ফলে ধর্ম এখন শান্তি ও মিলনের উৎস না হয়ে অশান্তি ও বিভেদের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যে দেশে যে ধর্মানুসারীরা সংখ্যায় বেশি, সে দেশে তারা সংখ্যালঘুদের পীড়ন করাকে এক রকম অধিকার হিসেবে দেখছে। এর সঙ্গে আবার আছে রাজনীতি, রাজনৈতিক কূটনীতি। মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখার কারণেই সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। অন্য দেশের কথা বাদ থাক, আমরা বাংলাদেশেই আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখি।
আমাদের দেশে কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিরাজ করছে? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি বা হয় না। রক্তাক্ত ভায়োলেন্স না হলেও এখানে এক প্রকার নীরব সন্ত্রাস সব সময় চলে আসছে। এখানে সংখ্যালঘুরা পলায়নপর মানসিকতার কারণে পাল্টা আক্রমণ করতে পারে না। সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার সংখ্যালঘুদের দিন দিনই সংকুচিত হয়ে আসছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নানা ধরনের জুলুম-অত্যাচার ঘটছে। কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের জমি-জমা, সম্পদ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি হামলার শিকার হচ্ছে, কখনো কখনো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। উপাসনালয়ে আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু নারীরা ধর্ষণের শিকার হলে ভয়ভীতি দেখিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়া থেকেও বিরত রাখা হয়। দেশে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছে। অনিরাপদ জীবন ছেড়ে তারা অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছেন।
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি, একটি ঘটনা থেকেও তৈরি হয়নি। এর পটভূমি ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না—ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।’ আবার ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন: ‘হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যটা আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল পূর্বে স্বদেশি অভিযানের দিনে একজন হিন্দু স্বদেশি প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া তাঁহার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করেন নাই।’
এ সব ধরা-ছোঁয়ার বিষয় এখন আর নেই। কিন্তু পূর্ব পুরুষের মুখে শোনা গল্প এখন নতুন করে বিশ্বাসের মূলে নাড়া দিচ্ছে না, কী করে অস্বীকার করি?
মুসলমানরা যে হিন্দুদের পাশাপাশি থেকেও ক্রমে পৃথক হয়ে গেল তার দায় কি তৎকালীন হিন্দু সমাজপতি ও রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চাপানো যায় না? পশ্চিমবঙ্গের গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখছেন: ‘আজও পশ্চিমবঙ্গে প্রচারের ধারাটা এমন যে, মুসলমানরা পাকিস্তান চাইল বলেই দেশ ভাগ হয়ে গেল। তাদের জানা থাকে না যে, পাকিস্তানের আগে মুসলমানরা চেয়েছিলেন মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সে অধিকার স্বীকার করা হয়নি বলেই, ওঠে পাকিস্তানের দাবি।’
মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত না হলে মানুষ ‘আলাদা’বোধ করবেই। যেটা এখন বাংলাদেশের হিন্দুরা করছে।
এবারের ঈদ উৎসব কি আমাদের মধ্যে একতাবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে পারবে?
লেখক: আজকের পত্রিকার সহকারী সম্পাদক
৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংস্কারের আহ্বান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সব ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও এই সংস্কারের জোয়ার এসে লেগেছে। জোয়ারের আগে মূলধারার চলচ্চিত্রের লোকজন নানাভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। অভ্যুত্থান শুরুর পর তাঁদের মনে হয়েছে ভবিষ্যৎ বুঝি অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্
১৮ ঘণ্টা আগেইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি করেছে। ইরানের ওপর সাম্প্রতিক ইসরায়েলি বিমান হামলা ঝুঁকি বাড়ালেও তা পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধের পথে পা বাড়ানোর কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। ইসরায়েলের এখনকার লক্ষ্য তার সীমানা সুরক্ষিত করা। অন্যদিকে ইরানের দরকার বর্তমান শাসন-ক্ষমত
১৮ ঘণ্টা আগেবিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের এক হাটে কৃষকের আনাগোনা, শোরগোল। ভ্যানে তুলে বস্তা বোঝাই আলু এনে আশানুরূপ দাম না পেয়ে হতাশ তাঁরা। বলছিলেন, কৃষিকাজই বাদ দিয়ে দেবেন। তাঁরা যে আলু বিক্রি করেন কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকায়, সেই আলুই ভোক্তার হাতে যায় ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। মাঝের এই মূল্য বৃদ্ধির পথ প
১৯ ঘণ্টা আগেলিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়েই বাগিয়ে নিতে হয় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের পদগুলো। লিখিত পরীক্ষায় যাঁরা বাকিদের টেক্কা দিতে পারেন, পরবর্তী মওকা তাঁদের জন্য সুরক্ষিত। মৌখিক পরীক্ষায় উতরে গেলেই চাকরি নিজের। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ পায় কী করে কিছু পরীক্ষার্থী—বিষয়টি শুধু অ
১৯ ঘণ্টা আগে