ডিবির হেফাজতে থাকা কোটা আন্দোলনের ৬ সমন্বয়কের মুক্তির জন্য ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ১৬: ১৫
আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৪, ১৬: ৫৬

দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর চলমান নির্যাতন-গ্রেপ্তার রুখে দিতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের মুক্তিসহ ১১ দফা দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া ডিবির হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের মুক্তি দিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম ঘোষণা করেন তাঁরা।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ আয়োজিত ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি ও আহ্বান জানান নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সংবাদ সম্মেলনে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর ধরে অনেক অন্যায়-অনাচার মুখ বুজে সহ্য করেছি। এনাফ ইজ এনাফ—এ কথা বলার সময়ও অনেক আগে পার হয়ে গেছে। এখন আমাদের সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে আমাদেরই ট্যাক্সের পয়সায় কেনা গুলি দিয়ে। বাংলাদেশের যত অভিভাবক আছেন, আজকে তাঁদের রুখে দাঁড়ানোর দিন।’

মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক বলেন, ‘গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সমন্বয়কদের সরকারের পাঁচটি বাহিনীর লোকজন অপারেশন চালানোর মতো করে হাসপাতালের স্টাফদের জোর করে সরিয়ে ধরে নিয়ে যায়। পরে এসে জোর করে রিলিজ অর্ডার নেয়। শিক্ষার্থীদের যারা মারল, তারা বলছে, তারা নাকি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নিয়েছে। আজকে এই প্রোগ্রামে নাহিদ ইসলামের মা ও স্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু ডিবি থেকে তাঁদের এখানে আসতে মানা করা হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, ডিবি অফিসে আসলে কী হচ্ছে!’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে কীভাবে আমাদের ছাত্রদের মুখোমুখি হব, তা আমি জানি না। আমরা ওদের নিরাপত্তা দিতে পারি নাই। একটা সিস্টেম কতটা নষ্ট হলে, ২০২৪-এ এসে একজন শিক্ষার্থীকে ১৯৬৯ সালের একজন শিক্ষকের কথা মনে করতে হয়।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ সোহেল। ১৮ তারিখেও ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে—এ রকম অনেক ছবি-ভিডিও আছে। কিন্তু ওকে ঢাকার একটি স্থাপনায় হামলার মামলায় রিমান্ড দেওয়া হয়েছে। এ থেকে তো বোঝা যায়, সরকার কী করছে! সরকার বাংলাদেশের স্পিরিট ও সংবিধান, আইন সব নষ্ট করে ফেলেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্দোলনের ইতিহাস পুরাতন। কিন্তু এবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে প্রতিরোধ, তা অনবদ্য। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যে সাহস দেখিয়েছে, তা আমাদের সাহস দিয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আজকে দেশের তরুণদের বিরুদ্ধে কিছু গত হওয়া, ৭০-৮০ বছরের মন্ত্রীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। শুধু স্থাপনা ধ্বংসের কথা বলে, কেউ তো এখনো কাউকে কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার করল না। তার মানে, নিশ্চয়ই আপনি (প্রধানমন্ত্রী) খুনি, তাই এর বিচার করছেন না। পুলিশ বলছে, সাঈদের মৃত্যু নাকি ইটের আঘাতে হয়েছে। মশকরা করেন নাকি? আমরা দেখি নাই কী হয়েছে! এসব করে মানুষের ক্ষোভ আরও উসকে দিচ্ছেন আপনারা!’

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আপনার সৌভাগ্য, মানুষ এখনো আপনার পদত্যাগের দাবিতে গণ-আন্দোলন শুরু করেনি। কিন্তু মনে হয় না সেই সৌভাগ্য আপনার বেশি দিন থাকবে। আজকে যারা আন্দোলন করছে, বুকে গুলি খাচ্ছে, তারাই মুক্তিযোদ্ধা। আর যারা বুকে গুলি করল এবং তাদের যারা অনুমতি দিল, তারাই ২০২৪ সালের রাজাকার।’

সংবাদ সম্মেলন শেষে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকার ভুলে গেছে যে বাক্‌স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। ক্ষমতার ভিত্তি না থাকলে সরকার গণবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। এখানেও তাই হয়েছে। রাষ্ট্রকে একটি নজরদারিভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। আজকে কার কাছে বিচার চাইছি? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে? বাংলাদেশে এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকবল জড়িত না।’

এ সময় ডিবি হেফাজতে থাকা আন্দোলনের সমন্বয়কদের মুক্তি দিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম ঘোষণা দেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এমন বিপুলসংখ্যক হতাহতের নজির গত ১০০ বছরের ইতিহাসে আমাদের দেশে বা উপমহাদেশের অন্য কোথাও নেই। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিরস্ত্র আন্দোলনকারী, পানি বিতরণকারী কিশোর, পলায়নরত ছাত্র ও ছাদে খেলতে যাওয়া শিশুর মৃত্যুর যে হৃদয়বিদারক বর্ণনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার মাত্রা সব সীমা অতিক্রম করেছে এবং সাংবিধানিক ও আইনি সব সুরক্ষা লঙ্ঘিত হয়েছে। গুলি করার ক্ষেত্রে পুলিশের আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বেসামরিক নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনের জন্য জাতিসংঘের লোগোসংবলিত সাঁজোয়া যান রাস্তায় নামানো হয়েছিল, সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল, কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও অভিযোগমতে গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।’

এ সময় ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের মুক্তি; কারফিউ প্রত্যাহার ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ; নিহত সব মৃত্যুর সঠিক, স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের সর্বোচ্চ আইনানুগ শাস্তি; হতাহত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রের ব্যবহার ও বলপ্রয়োগের বিষয়ে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে তদন্ত; হতাহত নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ; নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও আহতদের সুচিকিৎসা এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া; ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পূর্ণমাত্রায় খুলে দেওয়াসহ ১১ দফা দাবি জানান রিজওয়ানা হাসান।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত