অনুভূতি, আহা রে অনুভূতি

অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ৪৭
Thumbnail image
প্রতীকী ছবি

বিশ্বের সেরা এবং সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলো দেখা বা ছোঁয়া যায় না। এগুলো অবশ্যই হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নিতে হয়। এর নাম অনুভূতি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির একটি হচ্ছে অনুভূতি। এটি না থাকলে আপনি যে বেঁচে আছেন, তার প্রমাণ থাকে না। অনুভূতি আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের জাগরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

অনুভূতিপ্রবণ বাঙালির একসময় অনুভূতি ছিল সর্বজনীন। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আমরা যে অনুভূতি দেখেছি, তার নাম দেশপ্রেম। সেই অনুভূতি না থাকলে দেশ স্বাধীন হতো না। পরে অনুভূতি আরেক ধরনের হয়ে গেল। পঁচাত্তরের পর আমরা অনুভূতি প্রকাশে সাবধান হয়ে গেলাম। কারণ সব অনুভূতি যে সমান না, সেটা শেখানো হলো আমাদের।

আবেগ হলো মনের একটি বিশেষ অবস্থা, যার দ্বারা আমরা আমাদের কান্না, হাসি, রাগ ও দুঃখ অনুভব করি আর প্রকাশ করি। অধিকাংশ মানুষের আচরণ তাদের আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়। এককথায় বলতে গেলে, আবেগ হলো মনের সেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশমান অবস্থা, যা এক ব্যক্তিকে দৈহিক এবং মানসিক দিক থেকে বিচলিত করে। কোনো মানুষের খুশিতে উচ্ছল হওয়া, ভয় পাওয়া, বিস্ময়ে অবাক হওয়া, রাগে উত্তেজিত হওয়া—সবই আবেগের অনুভূতি আর তার দৈহিক প্রকাশ নিবিড়ভাবে জড়িত।

তার মানে অনুভূতি সবার। আচ্ছা, এখন কি আসলেই সবাই পারে অনুভূতি প্রকাশ করতে? যেমন ধরুন, একসময়ের রাজনীতি ও তার শাসকের জন্য আপনার কোনো ভালো অনুভূতি থেকে থাকলে তা কি এখন বলা সম্ভব? আবার যারা দলকানা বা অন্ধ, তারা জুলাই মাসে নিহত-আহতদের বেলায় কি শোক ও বেদনার অনুভূতি প্রকাশ করবেন? দুটোর উত্তরই হবে, ‘না’। তাহলে অনুভূতি সর্বজনীন হলো কীভাবে?

আজকাল আমরা মাঝে মাঝে অনুভূতিকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। মিডিয়ার ছবিতে এমন অনুভূতি কী প্রমাণ করে? বলে দেয়, আর যাই করো হে বাপু, সব অনুভূতি প্রকাশ কোরো না।

সৌভাগ্য হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী ফাহমিদা খাতুনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার। আড্ডা দেওয়ার। সিডনিভিত্তিক বাংলা টিভি ‘বাংলার মুখ’ তখন বেশ জনপ্রিয়। তাদের হয়ে কথা বলতে গিয়ে জেনেছিলাম ফাহমিদা খাতুনের অনুভূতি। আপনি-আমি হয়তো ভাবছি, কপালে টিপ পরা নারীদের দেখলে এখন যে বিরূপ অনুভূতি, তা সাম্প্রতিক সময়ের কিছু। জি না। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাহমিদা খাতুনকে পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা খুঁজে ফিরেছিল। তাদের ভাষায়, ‘টিপ পরা হিন্দু নারীটি কোথায়? যে কালীর গান গায়?’ মা কালীর গান বলতে তারা কোনটা মনে করত জানেন? রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’—এটা নাকি কালীর গান! এই যে ভিন্ন অনুভূতি, তার বেলায় আমরা কী বলব?

জাতি ও রুচিভেদে মানুষের অনুভূতি ভিন্ন। আজকাল সংবেদনশীল মানুষ যেকোনো কিছুতেই তেতে ওঠে, আমাদের দেশে ও সমাজে এখন যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অনুভূতি হয়ে গেছে একতরফা। আপনি বা আপনারা যা খুশি বলতে পারবেন, করতে পারবেন, ভিন্নমতের দলকে অপমান করতে পারবেন, এমনকি পেটাতেও পারবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে ন্যায্য কথা বললেও অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। কিছু বলা যাবে না। তার মানে একদল বলবে, আরেক দল মুখ বুজে সহ্য করবে। এই অপমান বা অনাচারের মূল জায়গা করে দিচ্ছে বিশ্বাস। আচার-আচরণ বা সংস্কৃতি অনুভূতির বড় শিকার। কারও অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের গায়ে লাগে এমন গান গাওয়া বা আচরণ করা যাদের সঠিক অনুভূতি, তারা নিজেদের বেলায় তা মানে? আপনার অনুষ্ঠানে অন্য কাউকে কি বলতে দেবেন? গাইতে দেবেন, না কিছু করতে দেবেন?

অনুভূতির বেলায় বাঙালি এখন একমুখী। যে যখন ক্ষমতা পায়, অনুভূতি তখন তার বা তাদের দাস। তারা যেভাবে যা প্রকাশ করে, তা-ই হচ্ছে সফল ও সঠিক। বাকিরা আধো ভয়ে, আধো লাজে আর আধো সংকোচে বলতে গিয়ে বলে না, করতে গিয়ে করতে পারে না। আর ‘হ্যাঁ’ মতে না বললে বা কথা না শুনলে মার দেওয়াটাও কিন্তু অনুভূতি! এর ভেতরে কারও ব্যথা বা আঘাত লাগলে সে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে কি না, সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু সংখ্যায় যারা বেশি, যাদের পেশির জোর আছে, তারা যেন মারতে পারার অনুভূতির লাইসেন্স পেয়ে গেছে।

আমাদের সমাজে বা দেশে বা জাতিতে অনুভূতির প্রাবল্য এত বেশি যে, তা আর সবকিছুকে ছাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এত অনুভূতি আর কারও নেই। এই যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আমি দেখেছি যে রাশান বা ইউক্রেনীয়দের চেয়েও এ বিষয়ে আমাদের অনুভূতি বেশি! তরুণ-তরুণী এমনকি বয়স্কদের মধ্যেও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যে আবেগ-অনুভূতি, তার ছিটেফোঁটাও নেই আরবদের মধ্যে। এর কারণ কী? আমরা বোদ্ধা জাতি? আমাদের ইন্দ্রিয় বেশি সচল? নাকি আমরা বেশি বুঝি? নাকি আমাদের আর কোনো কাজ নেই? এর যেটা বা যেগুলোই সত্য হোক না কেন, অনুভূতির বেলায় আমরা এখন কিছু মানতে নারাজ।

এভাবে চললে অতি অল্প সময়ের মধ্যে জাতি অনুভূতিশূন্য হতে বাধ্য। কারণ, তখন তার সব অনুভূতি এক জায়গায় জড়ো হয়ে এমন উগ্র করে তুলবে যে, তাকে দেখলেই অন্যরা সরে দাঁড়াবে। ভয়ে পালাবে। এমন অনুভূতির কি দরকার আছে? সমাজবিজ্ঞানীরা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কথিত দেশহিতৈষীরা আছেন অন্তরালে। সমুখে শান্তি পারাবার দেখানোর কেউ নেই। তবু আশ্চর্যজনকভাবে অনুভূতি মরে না!

কাশবন দেখলে, ভোরের শিউলি দেখলে, ঢাকের আওয়াজ শুনলে, আজানের মধুর ধ্বনি কানে গেলে বাঙালির অনুভূতি জাগে। জেগে ওঠে। বারবার তাকে বিপদে পড়তে হলেও সে অনুভূতি বিসর্জন দিতে পারে না। কারণ তার ইতিহাস-ঐতিহ্য আর অতীতের সঙ্গে অনুভূতির যোগ নিবিড়।

‘আমাদের অনুভূতিগুলো আমাদের শক্তির উৎস, যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়।’ এই বাক্য আমার খুব প্রিয়। শক্তি ও অনুভূতি এক না হলে কোনো জাতি এগোতে পারে না। যারা অনুভূতির নামে অনাচার আর অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার নামে দেশজুড়ে অশান্তি করে, তাদের মনে করিয়ে দিই—অনুভূতি শুদ্ধ ছিল বলেই যুগে যুগে বাঙালি সংগ্রাম ও বিজয়ে এক হতে পেরেছিল। উত্তেজনাহীন অনুভূতির জয় হোক।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত