প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী: মুক্তিসংগ্রামের চেতনা বাস্তবায়নে উদীচী

Thumbnail image

আজ ২৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বিকেল ৫টায় আয়োজিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন উদ্বোধন করবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রণম্য চিত্রশিল্পী আবুল বারক আলভী। 

১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকা শহরের উত্তরে শান্তিবাগের এক মেসবাড়িতে গড়ে ওঠে গণসাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী। উদীচী ধ্রুবতারার প্রতিশব্দ। উত্তর আকাশের ধ্রুবতারা যেমন পথহারা-দিশাহারা নাবিককে সঠিক পথ দেখায়, উদীচী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল বাংলার সংস্কৃতিমান মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া। শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেন, সাংবাদিক-সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদ সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখের নেতৃত্বে পথে-প্রান্তরে গণসংগীতের সহজ বাণী ও মনোগ্রাহী সুরে পাকিস্তানি শোষণ ও মানুষের বঞ্চনার কথা মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত করতেন উদীচীর শিল্পীরা। 

২. 
১৯৬৮ সালের শেষের দিকে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘আলো আসছে’। উত্তাল উনসত্তরে যখন রাজপথ আসাদের রক্তে রঞ্জিত হয়, যখন বাংলার জনগণ প্রতিবাদে মুখর, যখন পঙ্‌ক্তির বিদ্রোহে লেখা হচ্ছে আসাদের শার্ট; তখনই পথনাটক ‘শপথ নিলাম’ পথে-পথে জনবহুল স্থানে পরিবেশন করে মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বিশ্বাসে পরিণত করেন উদীচীর শিল্পীরা। উনসত্তরের মার্চে জহির রায়হানের ‘পোস্টার’ গল্পের নাট্যরূপ দেন আকতার হুসেন। এটি মঞ্চস্থ হয়েছিল শহীদ মিনারের বেদিমূলে। আদমজী ও বাওয়ানি জুট মিলে গান গেয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করা হতো। কখনো কখনো ঢাকার আশপাশের গ্রামে গিয়েও অনুষ্ঠান করা হতো। সব পরিবেশনাই থাকত গণ-জাগরণের। শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেন, আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল লতিফ, শেখ লুৎফুর রহমান প্রমুখের কলমে রচিত হতে থাকে নতুন নতুন গণসংগীত। 

সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের পাশে সংগঠনের সবটুকু নিয়ে দাঁড়িয়েছিল উদীচী। শুধু তা-ই নয়, এ দুর্যোগ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা হিসেবে আকতার হুসেনের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় পথনাটক জীবন তরঙ্গ জনগণের মধ্যে পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। সত্তরের ডিসেম্বরের শেষদিক থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা গণসংগীত ও নাটক নিয়ে মাঠে থেকে মানুষকে উজ্জীবিত করেন। এ সময় আকতার হুসেন রচিত ‘সামনে লড়াই’ মঞ্চস্থ করে উদীচী। ১৯৭১ সালে উদীচী পরিবেশন করে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রিয়তমাসু’ অবলম্বনে নৃত্যনাট্য। পরবর্তী সময়ে উদীচীর বহু শিল্পী-কর্মী হারমোনিয়াম ছেড়ে হাতে রাইফেল, এলএমজি তুলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মাতৃভূমিকে মুক্ত করার শপথে। 

৩. 
উদীচীর গঠনতন্ত্রে এ সংগঠনের আদর্শ-উদ্দেশ্যের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সমতার সমাজে, আপন ঐতিহ্যের সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে আনন্দে জীবনযাপনের পরিবেশ সৃষ্টিই আমাদের চাওয়া। এই অসাম্প্রদায়িক ও সমতার সমাজ গঠনের ব্রত নিয়ে আজও উদীচী কাজ করে চলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের এই চার মূলনীতি সমুন্নত রাখতে উদীচী কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পঁচাত্তরের পর সামরিক অপশক্তি ও তাদের দোসরেরা বারবার নিজেদের হীন স্বার্থে বাহাত্তরের সংবিধানকে ব্যবচ্ছেদ করেছে। উদীচী আজও বাহাত্তরের সংবিধান রক্ষার আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং সে লক্ষ্যেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তাই তো উদীচী রাজনীতিসচেতন এক গণ-সাংস্কৃতিক সংগঠন। 

উদীচীর লক্ষ্য মেহনতি মানুষের শোষণ-বঞ্চনা, দুঃখ-দুর্দশা এবং অধিকার সম্পর্কে গণসংগীতের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা। উদীচী মূলত গণসংগীতের সংগঠন হিসেবেই পরিচিত। এসব গানে থাকে শোষণের স্বরূপ উদ্ঘাটন, শোষকের স্বরূপ ও শোষণমুক্তির আন্দোলনের প্রেরণা। কৃষকের প্রয়োজনীয় উপকরণ আর পণ্যের ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকের মজুরি, নিরন্ন মানুষের ভাতের দাবি সুরে-শব্দে উঠে এসেছে উদীচীর গানে, শিল্পীদের প্রতিবাদী কণ্ঠে। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিপীড়িতকে উজ্জীবিত ও সংঘবদ্ধ করেছে উদীচী তার গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এই গণসংগীতের বাণী যেন সাধারণ জনতার জন্য সহজবোধ্য হয়, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়ে থাকে। গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের গান তাঁদের প্রাণ স্পর্শ করতে পারলেই তা সার্থক হবে। 

৪. 
পঁচাত্তরের সেই নিকষ অন্ধকারে যখন নৃশংসভাবে সপরিবারের হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে, তখনও প্রতিরোধের দেয়াল তুলে দাঁড়িয়েছিল উদীচী। ১৫ আগস্টের মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ে জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। দেশে চলতে থাকে হত্যা, ক্যু আর নানা অরাজকতা। ডিসেম্বরে শিল্পকলায় উদীচী গেয়ে ওঠে অজি রায়ের সুরে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ‘এদেশ বিপন্ন আজ’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’, মুকুন্দ দাশের ‘ভয় কী মরণে রাখিতে সন্তানে’। এভাবেই অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হয়ে নির্ভীক উদীচীর কর্মীরা প্রতিবাদ করেন অরাজকতার। 

১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে উদীচীর শিল্পী নির্দেশক সেন্টু রায় ৬ ফুট উচ্চতায় খালি মাইক্রোফোন, ডায়াসে পাইপ ও কালো চশমা রেখে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন। এরপর রচিত হয় ‘ইতিহাস কথা কও’ গীতি-আলেখ্য, যেখানে ৭ মার্চের ভাষণ তুলে ধরা হয়। আজ পর্যন্ত সহস্রাধিকবার এ প্রযোজনা মঞ্চায়িত হয়েছে উদীচীর নানা জেলা শাখার সংগঠনে। 

ঘাতক-দালালদের নির্মূলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনে সহযোদ্ধা সারা দেশের উদীচীর কর্মীরা। পাঠ্যপুস্তকে ভুল, সাম্প্রদায়িকতা এবং বিশিষ্ট লেখকদের রচনা বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে মাঠে নামে উদীচী। যেসব রচনা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়ে বই ছাপিয়ে সারা দেশে পাঠ প্রতিযোগিতা করে শিশুদের এসব ঋদ্ধ রচনা পড়ার সুযোগ করে দেয় উদীচী। 

৫. 
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে উদীচী করে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সপ্তাহ। তারপরই ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন। প্রথম ক্ষণ থেকে আজ পর্যন্ত এই আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছে উদীচী। সে সময় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, উদীচী থেকে শিল্পী-কর্মীরা রুটিন করে ২৪ ঘণ্টা শাহবাগে থেকে স্লোগান, গান, আবৃত্তি, পথনাটকে মুখর রাখতেন প্রজন্ম চত্বর। এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে মৌলবাদীদের অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন উদীচীর বন্ধু আরিফ নূর। আমাদের অনেকের হত্যার হুমকি ও মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে। তবুও পিছপা হননি উদীচীর শিল্পী-কর্মী ভাইবোনেরা। 

তাই উদীচীর সংগ্রাম চলছে, চলবে। জয় বাংলা। জয় উদীচী। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত