Ajker Patrika

প্রাণিসম্পদের ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে লুটের মচ্ছব

সাইফুল মাসুম, ঢাকা
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২: ৪১
প্রাণিসম্পদের ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে লুটের মচ্ছব

প্রকল্পের নাম ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)’। ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, পশু-পাখির উৎপাদনশীলতা ও সর্বোপরি খামারিদের ভাগ্যোন্নয়ন। কিন্তু প্রকল্পের টাকা যেভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হচ্ছে, তাতে প্রকৃত খামারিদের ভাগ্যোন্নয়ন না হলেও অসাধু কর্মকর্তা ও তাঁদের কমিশন দিয়ে সুবিধা নেওয়া কিছু মানুষের পকেট ভারী হচ্ছে ঠিকই।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, প্রকৃত খামারিরা এই প্রকল্পের কোনো সুফল পাচ্ছেন না। অনেক প্রতারক খামারি সেজে প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন। তাঁদের সহযোগিতা করছেন প্রকল্পের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। বিনিময়ে তাঁরা পাচ্ছেন টাকার ভাগ। 

জানা যায়, এলডিডিপি প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে ম্যাচিং গ্র‍্যান্ট (অনুদান) বাবদ। তবে শর্ত রয়েছে—অফেরতযোগ্য এই অর্থ প্রতিষ্ঠান আধুনিকায়নে ব্যয় করবেন খামারিরা। ছোট খামারিরা ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকা ও নিজস্ব অর্থায়নে মিষ্টি তৈরির মেশিন, দই ইনকিউবেটর, মিক্সচার মেশিন, দুধ ঠান্ডাকরণ যন্ত্র, প্যাকিং মেশিন, লাবাং মেশিন, পাস্তুরাইজার মেশিন, এসএস চুলা কেনার শর্তে অনুদান পাবেন।

সারা দেশে এলডিডিপি প্রকল্প থেকে সুবিধা নেওয়া কিছু খামারির ওপর সম্প্রতি অনুসন্ধান চালিয়েছে আজকের পত্রিকা। এতে উঠে এসেছে প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের ভয়াবহ চিত্র। প্রকল্প থেকে অনুদান পাওয়া কয়েকজনের তালিকা ধরে সরেজমিনে দেখা গেছে, অনুদান পাওয়া এসব ব্যক্তির খামার বা দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠান কোনোটিই নেই। তাঁরা প্রতারণার মাধ্যমে অনুদানের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। একই পরিবার প্রকল্পের শর্ত ভেঙে একাধিকবার অনুদানের টাকা নিয়েছেন—এমন ঘটনাও আছে। আবার এমন অনেক খামারিও আছেন, যাঁরা প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের কমিশন না দেওয়ায় অনুদানের টাকা পাননি। 

ছোট খামারি হিসেবে ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকা পেয়েছেন সিরাজগঞ্জ সদরের স্ট্যান্ডার্ড সুইটসের মালিক নজরুল ইসলাম। আজকের পত্রিকার প্রতিনিধি সরেজমিনে স্ট্যান্ডার্ড সুইটস নামে কোনো দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাননি। পরে মালিককে কল দিলে তিনি ছোট একটি কক্ষে নিয়ে যান, যেখানে ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকায় কেনা যন্ত্রপাতিগুলো প্যাকেটবন্দী করে রাখা হয়েছে। তবে মালিক নজরুল ইসলামের দাবি, প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো জায়গা না পাওয়ায় তাঁরা যন্ত্রগুলো কাজে লাগাতে পারেননি।

অনুদানের টাকায় কেনা যন্ত্রাংশ অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মিলন হোসেন। ‘আলভি এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি খামারের অনুকূলে অনুদান নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে কোনো দুগ্ধ খামারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মিলন আসলে খামারিই নন, তিনি এলাকায় ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে জড়িত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দৌলতপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মিলনের বাড়িতে লোক পাঠিয়েছি। তারা সরকারের সহায়তায় কেনা মেশিন দেখতে পায়নি। আমি এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করব, যেন তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।’

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় এলডিডিপির অনুদান পাওয়া জুহি লাবিব ডেইরিতে গিয়ে সেখানে অনুদানের টাকায় কেনা যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়নি। স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, যন্ত্রগুলো অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের মালিক জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেছেন, রাজনৈতিক হামলার কারণে তিনি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণের মাহবুব ডেইরিতেও অনুদানের টাকায় কেনা যন্ত্রের অস্তিত্ব মেলেনি। ওই খামারের মালিক মাহবুব আজকের পত্রিকাকে জানান, কুমিল্লা শহরে ‘দই চিড়া’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রগুলো রাখা আছে।

প্রকল্পের শর্ত ভেঙে একই পরিবারকে বারবার ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকা দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে। ২০২৩ সালে এলডিডিপি প্রকল্প থেকে অনুদান হিসেবে ১২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা পেয়েছেন কুমিল্লা সদর দক্ষিণের বালুরচর এলাকার আফরোজা আক্তার। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আব্দুল্লাহ ডেইরি’। এবার আফরোজা আক্তারের পরিবারের আরও পাঁচজনকে দেওয়া হচ্ছে অনুদানের টাকা। আজকের পত্রিকার হাতে আসা এ বছর প্রকল্পের অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায় দেখা গেছে, আব্দুল্লাহ ডেইরিতে ব্যবহার করা মোবাইল নম্বর হ্যাপি মিট অ্যান্ড ডেইরি, মিঠাই মেলা ও আমেনা ডেইরির মোবাইল নম্বরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এ ছাড়া চলিম ডেইরি ফার্ম ও এএমডি অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক আফরোজার আত্মীয় বলে জানা গেছে। আব্দুল্লাহ ডেইরির দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল দিলে কথা হয় আফরোজার স্বামী তোফায়েল হোসেনের সঙ্গে। তিনি আজকের পত্রিকাকে জানান, আব্দুল্লাহ ডেইরি দেখাশোনা করেন তাঁর স্ত্রী এবং আমেনা ডেইরি তাঁর নিজের। তবে অন্য ডেইরির মালিকদের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার কথা স্বীকার করেননি এই খামারি।

জানা গেছে, এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় বড় দুগ্ধ খামারিদের ডেইরি হাব প্রতিষ্ঠায় ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা, মাঝারি খামারিদের ৮৩ লাখ টাকা, ছোট খামারিদের ২৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা দেওয়ার কর্মসূচি রয়েছে; যা খামারিদের অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী, স্থানীয় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিট ব্যবসার পরিকল্পনা অনুযায়ী উদ্যোক্তার নিজস্ব অর্থ ও প্রকল্পের ম্যাচিং গ্র্যান্টের মাধ্যমে সরঞ্জামাদির ক্রয় কার্যক্রম মনিটর করবেন। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিট সরেজমিনে পরিদর্শন ও যন্ত্রাংশ ক্রয়ের ভাউচার যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হওয়ার পর ম্যাচিং গ্রান্টের টাকা দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে এলডিডিপি প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠান আধুনিকায়নে কেনা যন্ত্রাংশের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রকল্প থেকে ম্যাচিং গ্র্যান্ট দেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের প্রসঙ্গ তুললে তিনি পরে কথা বলবেন জানিয়ে তা এড়িয়ে যান।

পরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, অনিয়ম হলে সেটা দেখা হবে। তদন্ত করবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্তের ওপর আছি।

সরকারি কর্মকর্তারা নিজের চাকরি সেভ করে চলে। তদন্ত করলে কিছুই পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া সরকারের মন্ত্রী-এমপি থাকে। তাদের কথা শুনতে হয়।’

ভুয়া খামারিরা কর্মকর্তাদের কমিশন দিয়ে অনুদানের টাকা তুলে নিলেও প্রকৃত খামারিরা আছেন বিড়ম্বনায়। ২০২৩ সালে বড় খামারি হিসেবে অনুদানের টাকার জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছিল জামালপুরের স্বদেশ অ্যাগ্রোর মালিক হামিদ সরকারের নাম। তখন ঘুষের টাকার জন্য তাঁর নাম অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল। বিষয়টি আলোচিত হলে পরে তাঁর নাম চূড়ান্ত করা হয়। সম্প্রতি কোনো টাকা না দিয়েই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে হামিদের নাম।

হামিদ সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডেইরি হাব করার জন্য আমার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে আমি ৪০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতিও কিনেছি। আমার কাছে টাকা চেয়েছিল, না দেওয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে।’ 

চলতি বছর দুই ধাপে তিনজন করে মোট ছয়জনকে ডেইরি হাবের অনুদান দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। জানা গেছে, তাঁদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করতে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। আর তিন ধাপে প্রতিবার বিল ওঠানোর সময় এক লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার শর্ত দিয়েছেন অসাধু কর্মকর্তারা। তাঁদের চূড়ান্ত করার তালিকা আজকের পত্রিকার প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। এই ছয়জনের একজনকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে হঠাৎ করে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই খামারি বলেন, তাঁর শ্বশুরের রাজনৈতিক পরিচয় জানার পর এলডিডিপির লোকজন তাঁকে বাদ দেয়। এখন সরকার পতনের পর তাঁর নাম যুক্ত করা নিয়ে গড়িমসি করছে।

প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১১৯ জনকে ম্যাচিং গ্র্যান্টের ৩৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে অনুদানের টাকার চূড়ান্ত হওয়া অনেক খামারিকে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকা পেয়েছেন এমন একাধিক খামারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, টাকা পাওয়ার জন্য প্রতিটি ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয়েছে। টাকা দিতে দেরি হলে ফাইল আটকে দিতেন। এই ঘুষের টাকা নেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুর রহিম, উপপ্রকল্প পরিচালক ডা. হিরণ্ময় বিশ্বাস ও সিনিয়র ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট সরকার মো. খায়রুল আলম। 

এলডিডিপি প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। 

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আজকের পত্রিকার দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি, কাপাসিয়া (গাজীপুর) প্রতিনিধি ও সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি]

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নয়াদিল্লিতে নতুন হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহ, ৩ মাস সময় নিল ভারত

খেজুরে অতি মুনাফা, হতাশ ক্রেতা

চাপে পড়ে ৫টি বাস রিকুইজিশন দিয়েছেন পিরোজপুরের ডিসি, সরকারের হস্তক্ষেপ নেই: প্রেস সচিব

কলাবাগানে সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের মরদেহ উদ্ধার

রাতে স্বামীর জন্মদিন উদ্‌যাপন, সকালে নদীতে মিলল নববধূর লাশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত