Ajker Patrika

সব ভাষার অধিকার নিয়েই ছিল আন্দোলন

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২: ১১
সব ভাষার অধিকার নিয়েই ছিল আন্দোলন

আজকের পত্রিকা: ভাষাসংগ্রামের চেতনা কি ব্যর্থ হয়েছে? 
আহমদ রফিক: আমরা ব্যর্থ হয়েছি, সে কথা বলব না। আজ যদি আমাকে কেউ প্রশ্ন করে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আপনাদের প্রাপ্তি কী? তাহলে আমি বলব, প্রাপ্তি তো আছেই। রাষ্ট্রভাষা বাংলা এটা একটা প্রাপ্তি। তেমনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো, সেটাও একটা প্রাপ্তি। তেমনি অপ্রাপ্তিও কম নয়। যেমন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। আমাদের তো স্লোগানই ছিল সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষা চালু করার জন্য। স্লোগানগুলো ছিল এ রকম: প্রথম স্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, দ্বিতীয় স্লোগান ছিল ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’। তারপরেই ছিল ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।’ সর্বস্তরে বাংলা তো চালু হয়নি। উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালতে বাংলা চালু হয়নি। এটা তো একটা বিরাট ব্যর্থতা। এখন এত দিন পর আমার মনে হয়, ভাষা আন্দোলনের সময় এত আবেগ, সে আবেগ এখন কোথায় গেল? সে আবেগ কি ক্ষমতার কাছে মার খেয়ে গেল? আমাদের আন্দোলন তো ক্ষমতার জন্য ছিল না। ক্ষমতার প্রশ্ন ছিল না। প্রশ্ন ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সর্বস্তরে বাংলা, যেগুলো একটি জাতিরাষ্ট্রের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। সেই জাতিরাষ্ট্রটা যখন প্রতিষ্ঠিত হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, তখন আমাদের প্রত্যাশা ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা। শেখ সাহেবও তা বলেছিলেন। কিন্তু সেটা চালু হলো না। তাঁর আমলেও হলো না, পরেও হলো না। যেটুকু হয়েছে, তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। 

আজকের পত্রিকা: ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অর্জন কতটা? 
আহমদ রফিক: একুশের প্রভাব সবচেয়ে বেশি সাহিত্য আর সংস্কৃতিতে। একুশের পরে যে সাহিত্য সম্মেলনগুলো হলো, কুমিল্লায়, ঢাকার কার্জন হলে, কাগমারীতে, এই সম্মেলনগুলো আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে কুমিল্লা শহরে তিন দিনব্যাপী সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে ছিল ভাষা এবং সাহিত্য-বিষয়ক আলোচনা। নাটক ছিল, নৃত্যানুষ্ঠান ছিল। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং ইকবালের গান ছিল। কবিয়াল রমেশ শীল ও ফণি বড়ুয়ার কবিগান হয়েছিল সেখানে। লোকসংগীত হয়েছিল। সেই সম্মেলনে যে চেতনার প্রকাশ ঘটেছিল, কোনো সন্দেহ নাই, সেটা ছিল প্রতিবাদী, প্রগতিবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক। এ সময় থেকেই রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তকে নিয়ে একের পর এক অনুষ্ঠান হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে হয়েছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি উৎসব। এখানে শ্রোতারা উপচে পড়েছিল। শিল্পীদের পরিবেশনার পাশাপাশি এখানে আলোচনায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উপস্থিতি, জননেতা মওলানা ভাসানী ও ফজলুল হকের বক্তৃতার কথাও উল্লেখ করতে হয়।

অনেকেরই নিশ্চয় মনে পড়ে যাবে, একুশের সংকলন প্রকাশ শুরু হয়েছিল তখন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ও মোহাম্মদ সুলতান কর্তৃক প্রকাশিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আমাদের সংস্কৃতির প্রতিবাদী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চরিত্রটি তুলে ধরেছে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এ সময়ে রচিত কবিতায় পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম প্রতীক উঠে এসেছে। মুনীর চৌধুরী লিখেছেন ‘কবর’-এর মতো নাটক। সংস্কৃতি অঙ্গনে যা কিছু অর্জন, তার জন্য একুশের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে বাংলার মানুষ। 
 
আজকের পত্রিকা: ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী কি ভাষা আন্দোলনের সুফল পেয়েছে? 
আহমদ রফিক: আবার বলি, একুশ জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গানসহ সংস্কৃতির নানা শাখায় সৃষ্টিশীল কাজ অনেক হয়েছে। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা ও সমাজ পরিবর্তনের একটা লক্ষ্য ছিল। মুসলমান মধ্যবিত্তের একটা বৃহত্তর অংশকে সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করেছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।

আমি তো প্রায়ই বলি, যদিও আমাদের দেশটা জাতিরাষ্ট্র, তবু এই দেশে বহু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অবস্থান, তাদের ভাষাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া, তাদের সহযোগিতা করা দরকার। কারণ, শুধু বাংলা ভাষার জন্য আমাদের সংগ্রাম ছিল না। সব ভাষার অধিকার নিয়েই ছিল সে আন্দোলন। 
 
আজকের পত্রিকা: এখনো সাম্প্রদায়িকতা আছে। এর কারণ কী? 
আহমদ রফিক: হ্যাঁ, আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। শারদীয় দুর্গাপূজার সময় পরিকল্পিতভাবে যে ঘটনা ঘটানো হলো, তা থেকেই বোঝা যায় আমাদের দেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িকতার মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি। এই বিষয়টি অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। অখণ্ড ভারতে এবং অখণ্ড বঙ্গে এই সাম্প্রদায়িকতা স্থিত ছিল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সেখানে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। যার ফলে ভারত বিভাগ, বঙ্গ বিভাগ, পাঞ্জাব বিভাগ—এই সবই রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ। তার অবসান ঘটেনি। সেই উত্তরাধিকার আমরা বহন করছি। আমরা এখনো এ ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন হতে পারিনি। আর সে কারণেই পীড়াদায়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘মিডিয়া ছুটায় দেব, চেনো আমাদের’—সাংবাদিককে হুমকি কুড়িগ্রামের এসপির

মেঘনা আলম ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’, কারণ জানাল পুলিশ

বান্দরবান, মণিপুর, মিজোরাম ও রাখাইন নিয়ে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্র চলছে: বজলুর রশীদ

ইসলামপুর বিএনপির সহসভাপতি যোগ দিলেন জামায়াতে

যশোরে সেপটিক ট্যাংকে গৃহবধূর মরদেহ: ভিসেরা প্রতিবেদনে ধর্ষণের পর হত্যার আলামত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত