রাতের নৌপথে আতঙ্ক বাল্কহেড

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৩, ১১: ১২

রাতে চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানছে না বাল্কহেড। ফলে রাতের নৌপথে দুর্ঘটনার কারণ ও আতঙ্ক হয়ে উঠেছে বালুবাহী এই নৌযান। সর্বশেষ গত রোববার ঢাকার সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ওয়াটার বাস ডুবে তিন যাত্রী নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার ভোরে ওয়াটার বাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি।

বালুবোঝাই বাল্কহেডের বেশির ভাগ অংশ পানির নিচে থাকে। রাতে চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় এই নৌযানে আলোও থাকে না। ফলে নৌকা, লঞ্চসহ অন্যান্য নৌযানের চালকেরা বাল্কহেডকে সহজে দেখতে পান না। এতে দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করেন নৌপরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সূত্র বলেছে, দেশে ৪ হাজার ৭০০টি বাল্কহেডের নিবন্ধন থাকলেও চলছে প্রায় ১১ হাজার। বেশির ভাগেরই দক্ষ মাস্টার, ফিটনেস নেই।

দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে বাল্কহেড রাতে চলাচল নিষিদ্ধ করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে বেপরোয়াভাবে চলছে এই নৌযান। প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, নৌপথে নজরদারি করা সংস্থাকে ‘হাত’ করে এসব নৌযান চলছে।

তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বলছে, অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের কারণে বাল্কহেডের চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সংস্থার কেউ অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অনুমোদনহীন বাল্কহেড চালাতে সহায়তা দিলে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নৌপরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পানির বড়জোর দুই ফুট ওপরে বাল্কহেডের উপরিভাগ থাকে। কখনো কখনো এর ওপর দিয়ে পানি বয়ে যায়। লঞ্চ, কার্গো নৌযান, নৌকার পক্ষে রাতে এর অবস্থান বোঝা যায় না। এতে সংঘর্ষ হয়। ফলে এটি রাতের নৌপথে বড় আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে কারও টনক নড়ে না। 

এমভি সুন্দরবন লঞ্চের মাস্টার মো. ইকলাস বলেন, রাতে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের ঠেকানোর পাশাপাশি যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের পথে রাতে বাল্কহেড-কার্গোসহ ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি মাছ শিকারের জাল ফেলাও বন্ধ করতে হবে। নয়তো দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকেই যাবে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সূত্র বলেছে, ২০২২ সালে দেশে ৩৬টি নৌ-দুর্ঘটনার অর্ধেকের বেশি হয়েছে বাল্কহেডের কারণে। এদিকে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত দেশে ৪৯টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ৫৮ জন, আহত ৭ জন এবং নিখোঁজ ১২ জন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, নৌপথ নিরাপদ করার সঙ্গে জড়িত বিআইডব্লিউটিএ, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, নৌ পুলিশ এবং নৌযানমালিকদের অবহেলার কারণে নৌপথ এখনো নিরাপদ হয়নি।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁদের পাশাপাশি নৌপথে নিরাপত্তার জন্য নৌ পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড কাজ করে। সন্ধ্যার পর যেন বাল্কহেড চলাচল না করে, সে জন্য ঈদের আগে নৌ পুলিশকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। নৌ পুলিশ বিভিন্ন পয়েন্টে আরেকটু খেয়াল রাখলে কাজটা সহজ হয়ে যেত।

এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি নৌ পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাথী রানী শর্মা।

৯ ঘণ্টা পর ওয়াটার বাস উদ্ধার
রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে সদরঘাটের কাছে শ্যামবাজারের লালকুঠি ঘাটে আসার পথে বাল্কহেডের ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যাওয়া ওয়াটার বাসটি গতকাল ভোরে টেনে পোস্তগোলায় তুলেছে উদ্ধারকারী জাহাজ। নৌ পুলিশের এসপি (ঢাকা বিভাগ) গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ওয়াটার বাসটি তোলা হয়েছে। ভেতরে আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি।

ওয়াটার বাসটির অধিকাংশ যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠলেও কয়েকজন নিখোঁজ থাকেন। নৌ পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা উদ্ধারকাজ শুরু করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে চারজনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁরা হলেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মোহাম্মদ আলিফ (১৪), দোহারের মোহাম্মদ ফাহিম (৩০) এবং মিঠু (৫০)। এ ঘটনায় ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানের কর্মচারী তুহিন (২২) নিখোঁজ রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

সদরঘাট নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুর রহমান বলেন, বাল্কহেডের চালকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। বাল্কহেডটি জব্দ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত