আজকের পত্রিকা: আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা শুধু একাত্তর সালে অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে না। যাঁরা মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ শুধু একাত্তর সালের ৯ মাসের, তাঁরা সঠিক ন্যারেটিভ দিচ্ছেন না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ৯ মাসের ব্যাপার ছিল না। অনেক আগে থেকেই নানা ঘটনা, আন্দোলন এবং বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়েছে। আমি একটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যাঁরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আত্মাহুতি দিয়েছেন ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন তাঁদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলব না কেন? তাঁরা তো দেশমাতৃকার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।
আমাদের ইতিহাস কি শুধু ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল? এভাবে ভাবাটা কিন্তু অনৈতিহাসিক। এ ধরনের বিকৃতির দিকে যদি আমরা আমাদের ইতিহাসকে নিক্ষেপ করি, তাহলে ইতিহাসের মূল জায়গা বুঝতে পারব না।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার মধ্যে দেশপ্রেম গড়ে ওঠে এবং জাতীয় মুক্তি ও শ্রেণি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে দৃঢ় হতে থাকে। এভাবে স্কুলজীবন শেষ হওয়ার পর আমার মধ্যে রাজনৈতিক ভাবনার সূচনা হয়। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ হলো, এই সবকিছুর ধারাবাহিকতা।
আজকের পত্রিকা: কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মধ্যে কীভাবে মুক্তির বীজটা অঙ্কুরিত হলো? প্রবল দেশপ্রেম, বাঙালির আত্মপরিচয় এবং বিদেশি শাসন-শোষণ এবং তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের আঘাত করছে, যা ধীরে ধীরে আমাকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। শ্রমের প্রতি মর্যাদা, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয় তা ঠিক নয়। কারণ তারা এক অর্থে আমার চেয়ে জ্ঞানী, শ্রমটা যে আমার আয়ত্তের মধ্যে নেই। তাঁদের তুচ্ছ করা উচিত নয়। অন্যদিকে ইতিহাস পাঠ। শুধু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে নিজের জাতিকে ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই পরিচালনা করেছেন জুলিয়াস ফুচিকসহ আরও বিখ্যাত বীরদের জীবনকাহিনি পাঠ করে এবং বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার ভিত্তিতে আমার ভেতরে মুক্তির চেতনা জন্ম নেয়।
আর আগাগোড়া আমি মুক্তিযুদ্ধটাকে শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা হিসেবে দেখিনি। মানব অস্তিত্বের এবং মানব পরিচয়ের মুক্তি হিসেবে এটাকে দেখেছি। সে জন্য আমি আমার সব শক্তি এবং সামর্থ্য নিবেদন করেছি মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এই সংগ্রামই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত একাত্তরে উপনীত হয়। তখন আমরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ শুরু করলাম।
এর ইমিডিয়েট পটভূমি যদি বলি, সেটাও কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়নি। অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি স্রোতোধারা পাশাপাশি অগ্রসর হয়েছে। একটা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারা—এটা আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে। অন্যটি হলো বামপন্থী ধারা—কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে। আরও ছোট ছোট ধারা ছিল। কিন্তু মূল দুটি ধারা ও অন্য ধারাগুলো একাত্তর সালে একটি জায়গায় এসে মিলিত হয়েছিল। ফলে অনন্য একজাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটা বড় অবদান রেখেছে। এই নির্বাচনের রায় কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকেরা যখন গড়িমসি করা শুরু করলেন, তখন আমরা ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘পুরো পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল তোমরা যদি বাস্তবায়ন করতে না দাও, তাহলে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে হলেও আমরা জনগণের ভোটের রায় কার্যকর করব।’ সেটা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণার সমতুল্য একটা ব্যাপার।
১ মার্চ যখন অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়া হলো, তখন আর আমাদের অপেক্ষা করার কোনো জায়গা ছিল না। এর আগে আমাদের নেতা কমরেড মণি সিংহ বলেছিলেন, ‘তোমাদের স্যালুট জানাই। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তোমরা বড় সংগ্রাম করেছ। তবে মনে রাখবা, এটা হলো ড্রেস রিহার্সাল। আসল বড় সংগ্রাম সামনে আছে।’ তিনি আসলে সশস্ত্র যুদ্ধের ইঙ্গিত করেছিলেন। সুতরাং আমরা সেভাবেই তৈরি হচ্ছিলাম।
১ মার্চ আমার অনার্স পরীক্ষার একটা বিষয় বাকি ছিল। সেই দিন মুহসীন হলের ৬৬০ নম্বর রুম বন্ধ করে যে দুপুরবেলা বের হয়ে গেলাম আর ফিরে এলাম মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে।
২৫ মার্চের পর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় গিয়ে পৌঁছালাম। কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের ট্রেনিং শুরু হলো। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের একটা বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। প্রথম ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেলাম আমি। পরে আমরা বেস ক্যাম্প করে, ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে দেশের ভেতরে কাজ শুরু করলাম।
আজকের পত্রিকা: সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়নের দেশ গড়ার স্লোগান কি ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: খুবই স্বাভাবিকভাবে সেটা একটা বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; যাতে ছাত্রসমাজের বিপুল সমর্থন পাই। আমাদের স্লোগান ছিল—‘বেয়নেটকে লাঙলের ফলায় পরিণত কর’; ‘লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, এসো হে এবার দেশ গড়ি’। তবে কিছু কিছু ছাত্রসংগঠন এসবকে নরম স্লোগান হিসেবে চিহ্নিত করে টিটকারি করত। কিন্তু দেশ গড়ার সংগ্রাম যে সংঘাতবিহীন কোনো কিছু নয়, পরের অনেক ঘটনায় তা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা দেশ গড়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ১৭ ডিসেম্বর দেশে ঢুকেছি আর ২ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং করে আমাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছি। এর মধ্যে একটা পদক্ষেপ ছিল স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি শিক্ষানীতির খসড়া প্রণয়ন করা। ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে আমরা একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলাম।
আমি এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলাম। সেখানে নিচ থেকে ওপর ক্লাস পর্যন্ত সিলেবাস কেমন হবে এবং কত সময় ধরে কোন বিষয় পড়ানো হবে, তা বিস্তৃত উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশগুলো পরবর্তী সময়ে ‘কুদরাত-এ-খুদা’ কমিশন গ্রহণ করেছিল।
আমাদের কিছু উদ্যোগ সংঘাতের দিকে গিয়েছিল। রেশন কার্ড উদ্ধার, দুর্নীতি বন্ধ ইত্যাদি বিষয়ে সরকার-সমর্থকদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ দেখা দেয়। মানবমুক্তির প্রকৃত যোদ্ধা হিসেবে দেশে দেশে যে মুক্তিসংগ্রাম চলেছে, তার প্রতি সংহতি জানানোর জন্য ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ভিয়েতনাম সংহতি দিবস পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আমাদের দুজন ছাত্র মতিউল-কাদের মারা যায়। এর প্রতিবাদে প্রবল আন্দোলন হয়। আমরা যতগুলো দাবি করেছিলাম, সরকার তা মেনে নেয়।
আজকের পত্রিকা: স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নীতি-কৌশল কি ঠিক ছিল?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মনে হয়, কিছু ভুল অবশ্যই ছিল। তবে শুধু বঙ্গবন্ধুর একার নয়, আমাদের সবারই ভুল ছিল। এর একটি হলো, হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ে আত্মহারা হয়ে যে সাংস্কৃতিক বা মতাদর্শগত বিপ্লব শুরু করা উচিত ছিল, সে কথাটা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে অনেক শক্তির জায়গা যেমন ছিল, তেমনি কতগুলো ঘাটতির জায়গাও ছিল। সেই অবহেলার দায় এখনো আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হলো, প্রতিটি ইতিহাসের মধ্যে একটা কনটিনিউটি থাকে আবার ডিস-কনটিনিউটি থাকে। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ডিস-কনটিনিউটির মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর পুরোনো পেনাল কোড থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রসহ সবকিছু আগের মতোই বহাল রাখলাম। এটারই কনটিনিউটি চলতে থাকল।
একপর্যায়ে আমরা দেখতে পেলাম, সমাজের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়ে গেল। একদিকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখীনতার কথা বলা হলো, অন্যদিকে নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠল। বঙ্গবন্ধুর তাঁর দলের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তির পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই দল আবার শ্রেণি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না। সুতরাং যতই প্রগতিশীল নীতি নেওয়া হোক না কেন, প্রতিটি কাজ করার জন্য আওয়ামী লীগ বাধা দেওয়া শুরু করল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি সরাসরি মোকাবিলা করলেন না। এখানেই ছিল তাঁর দুর্বলতা।
এরপর তিনি একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন। আমরা কিন্তু আগেই বলেছিলাম, পার্লামেন্টারি সিস্টেমে যাওয়া ঠিক হবে না। ১৭ ডিসেম্বরের পরেই আমাদের প্রস্তাব ছিল সবাইকে নিয়ে একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করার। এরপর স্বাধীনতাকে সংহত করার
পর পার্লামেন্টারি সিস্টেমে যেতে হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো কিছুই আমলে নেননি। এ রকম আরও কিছু ভুল ছিল।
আজকের পত্রিকা: সিপিবি ও ন্যাপ তো সেই সময়ে এসব ভুলের কথা বলেনি। এ বিষয়ে কী বলবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমি মনে করি, আমাদের পার্টির নীতিও সে সময় আংশিকভাবে ভুল ছিল। স্বাধীনতা সংহত করতে হবে—আমাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা সংহত করার জন্য আমাদের জনগণের সামনে এসে বলা উচিত ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারকে যদি আপনাদের পছন্দ না হয়, তাহলে সিপিবি ও ন্যাপ আছে। আমরাই বিকল্প পার্টি। আমাদের পেছনে আসুন। আমরা এটা না করে ঐক্য ও সংগ্রাম ধরে রেখেছিলাম। যেটা আমাদের প্রস্তাবে ছিল। কিন্তু ঐক্যটা বেশি করেছি, সংগ্রামটা সেভাবে করিনি; বিশেষ করে নিজেদের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিনি। ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারলাম না এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোও রক্ষা করতে পারলাম না। তবে এই ভুল আমরা সংশোধন করে নিয়েছি এবং প্রকাশ্যভাবে বলেছি, ওই অবস্থায় আর ফিরে যাব না। এখন আমরা স্বাধীন অবস্থান থেকে আমাদের রাজনীতি করে যাব। সমাজতন্ত্র অভিমুখীন একটা সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ও স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে দেশ যাতে পরিচালিত হয়, এর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাব।
আজকের পত্রিকা: আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা শুধু একাত্তর সালে অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে না। যাঁরা মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ শুধু একাত্তর সালের ৯ মাসের, তাঁরা সঠিক ন্যারেটিভ দিচ্ছেন না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ৯ মাসের ব্যাপার ছিল না। অনেক আগে থেকেই নানা ঘটনা, আন্দোলন এবং বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়েছে। আমি একটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যাঁরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আত্মাহুতি দিয়েছেন ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন তাঁদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলব না কেন? তাঁরা তো দেশমাতৃকার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।
আমাদের ইতিহাস কি শুধু ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়েছিল? এভাবে ভাবাটা কিন্তু অনৈতিহাসিক। এ ধরনের বিকৃতির দিকে যদি আমরা আমাদের ইতিহাসকে নিক্ষেপ করি, তাহলে ইতিহাসের মূল জায়গা বুঝতে পারব না।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার মধ্যে দেশপ্রেম গড়ে ওঠে এবং জাতীয় মুক্তি ও শ্রেণি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে দৃঢ় হতে থাকে। এভাবে স্কুলজীবন শেষ হওয়ার পর আমার মধ্যে রাজনৈতিক ভাবনার সূচনা হয়। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ হলো, এই সবকিছুর ধারাবাহিকতা।
আজকের পত্রিকা: কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মধ্যে কীভাবে মুক্তির বীজটা অঙ্কুরিত হলো? প্রবল দেশপ্রেম, বাঙালির আত্মপরিচয় এবং বিদেশি শাসন-শোষণ এবং তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের আঘাত করছে, যা ধীরে ধীরে আমাকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। শ্রমের প্রতি মর্যাদা, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয় তা ঠিক নয়। কারণ তারা এক অর্থে আমার চেয়ে জ্ঞানী, শ্রমটা যে আমার আয়ত্তের মধ্যে নেই। তাঁদের তুচ্ছ করা উচিত নয়। অন্যদিকে ইতিহাস পাঠ। শুধু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে নিজের জাতিকে ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই পরিচালনা করেছেন জুলিয়াস ফুচিকসহ আরও বিখ্যাত বীরদের জীবনকাহিনি পাঠ করে এবং বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার ভিত্তিতে আমার ভেতরে মুক্তির চেতনা জন্ম নেয়।
আর আগাগোড়া আমি মুক্তিযুদ্ধটাকে শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতা হিসেবে দেখিনি। মানব অস্তিত্বের এবং মানব পরিচয়ের মুক্তি হিসেবে এটাকে দেখেছি। সে জন্য আমি আমার সব শক্তি এবং সামর্থ্য নিবেদন করেছি মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এই সংগ্রামই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত একাত্তরে উপনীত হয়। তখন আমরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ শুরু করলাম।
এর ইমিডিয়েট পটভূমি যদি বলি, সেটাও কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়নি। অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি স্রোতোধারা পাশাপাশি অগ্রসর হয়েছে। একটা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারা—এটা আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে। অন্যটি হলো বামপন্থী ধারা—কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে। আরও ছোট ছোট ধারা ছিল। কিন্তু মূল দুটি ধারা ও অন্য ধারাগুলো একাত্তর সালে একটি জায়গায় এসে মিলিত হয়েছিল। ফলে অনন্য একজাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটা বড় অবদান রেখেছে। এই নির্বাচনের রায় কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকেরা যখন গড়িমসি করা শুরু করলেন, তখন আমরা ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘পুরো পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল তোমরা যদি বাস্তবায়ন করতে না দাও, তাহলে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে হলেও আমরা জনগণের ভোটের রায় কার্যকর করব।’ সেটা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণার সমতুল্য একটা ব্যাপার।
১ মার্চ যখন অধিবেশন স্থগিত করে দেওয়া হলো, তখন আর আমাদের অপেক্ষা করার কোনো জায়গা ছিল না। এর আগে আমাদের নেতা কমরেড মণি সিংহ বলেছিলেন, ‘তোমাদের স্যালুট জানাই। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তোমরা বড় সংগ্রাম করেছ। তবে মনে রাখবা, এটা হলো ড্রেস রিহার্সাল। আসল বড় সংগ্রাম সামনে আছে।’ তিনি আসলে সশস্ত্র যুদ্ধের ইঙ্গিত করেছিলেন। সুতরাং আমরা সেভাবেই তৈরি হচ্ছিলাম।
১ মার্চ আমার অনার্স পরীক্ষার একটা বিষয় বাকি ছিল। সেই দিন মুহসীন হলের ৬৬০ নম্বর রুম বন্ধ করে যে দুপুরবেলা বের হয়ে গেলাম আর ফিরে এলাম মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে।
২৫ মার্চের পর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় গিয়ে পৌঁছালাম। কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের ট্রেনিং শুরু হলো। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের একটা বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। প্রথম ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেলাম আমি। পরে আমরা বেস ক্যাম্প করে, ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে দেশের ভেতরে কাজ শুরু করলাম।
আজকের পত্রিকা: সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়নের দেশ গড়ার স্লোগান কি ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: খুবই স্বাভাবিকভাবে সেটা একটা বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; যাতে ছাত্রসমাজের বিপুল সমর্থন পাই। আমাদের স্লোগান ছিল—‘বেয়নেটকে লাঙলের ফলায় পরিণত কর’; ‘লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, এসো হে এবার দেশ গড়ি’। তবে কিছু কিছু ছাত্রসংগঠন এসবকে নরম স্লোগান হিসেবে চিহ্নিত করে টিটকারি করত। কিন্তু দেশ গড়ার সংগ্রাম যে সংঘাতবিহীন কোনো কিছু নয়, পরের অনেক ঘটনায় তা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা দেশ গড়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ১৭ ডিসেম্বর দেশে ঢুকেছি আর ২ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং করে আমাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছি। এর মধ্যে একটা পদক্ষেপ ছিল স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি শিক্ষানীতির খসড়া প্রণয়ন করা। ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে আমরা একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলাম।
আমি এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলাম। সেখানে নিচ থেকে ওপর ক্লাস পর্যন্ত সিলেবাস কেমন হবে এবং কত সময় ধরে কোন বিষয় পড়ানো হবে, তা বিস্তৃত উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশগুলো পরবর্তী সময়ে ‘কুদরাত-এ-খুদা’ কমিশন গ্রহণ করেছিল।
আমাদের কিছু উদ্যোগ সংঘাতের দিকে গিয়েছিল। রেশন কার্ড উদ্ধার, দুর্নীতি বন্ধ ইত্যাদি বিষয়ে সরকার-সমর্থকদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ দেখা দেয়। মানবমুক্তির প্রকৃত যোদ্ধা হিসেবে দেশে দেশে যে মুক্তিসংগ্রাম চলেছে, তার প্রতি সংহতি জানানোর জন্য ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ভিয়েতনাম সংহতি দিবস পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আমাদের দুজন ছাত্র মতিউল-কাদের মারা যায়। এর প্রতিবাদে প্রবল আন্দোলন হয়। আমরা যতগুলো দাবি করেছিলাম, সরকার তা মেনে নেয়।
আজকের পত্রিকা: স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নীতি-কৌশল কি ঠিক ছিল?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমার মনে হয়, কিছু ভুল অবশ্যই ছিল। তবে শুধু বঙ্গবন্ধুর একার নয়, আমাদের সবারই ভুল ছিল। এর একটি হলো, হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ে আত্মহারা হয়ে যে সাংস্কৃতিক বা মতাদর্শগত বিপ্লব শুরু করা উচিত ছিল, সে কথাটা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে অনেক শক্তির জায়গা যেমন ছিল, তেমনি কতগুলো ঘাটতির জায়গাও ছিল। সেই অবহেলার দায় এখনো আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হলো, প্রতিটি ইতিহাসের মধ্যে একটা কনটিনিউটি থাকে আবার ডিস-কনটিনিউটি থাকে। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ডিস-কনটিনিউটির মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর পুরোনো পেনাল কোড থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রসহ সবকিছু আগের মতোই বহাল রাখলাম। এটারই কনটিনিউটি চলতে থাকল।
একপর্যায়ে আমরা দেখতে পেলাম, সমাজের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়ে গেল। একদিকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখীনতার কথা বলা হলো, অন্যদিকে নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠল। বঙ্গবন্ধুর তাঁর দলের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তির পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই দল আবার শ্রেণি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না। সুতরাং যতই প্রগতিশীল নীতি নেওয়া হোক না কেন, প্রতিটি কাজ করার জন্য আওয়ামী লীগ বাধা দেওয়া শুরু করল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি সরাসরি মোকাবিলা করলেন না। এখানেই ছিল তাঁর দুর্বলতা।
এরপর তিনি একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন। আমরা কিন্তু আগেই বলেছিলাম, পার্লামেন্টারি সিস্টেমে যাওয়া ঠিক হবে না। ১৭ ডিসেম্বরের পরেই আমাদের প্রস্তাব ছিল সবাইকে নিয়ে একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করার। এরপর স্বাধীনতাকে সংহত করার
পর পার্লামেন্টারি সিস্টেমে যেতে হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো কিছুই আমলে নেননি। এ রকম আরও কিছু ভুল ছিল।
আজকের পত্রিকা: সিপিবি ও ন্যাপ তো সেই সময়ে এসব ভুলের কথা বলেনি। এ বিষয়ে কী বলবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমি মনে করি, আমাদের পার্টির নীতিও সে সময় আংশিকভাবে ভুল ছিল। স্বাধীনতা সংহত করতে হবে—আমাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা সংহত করার জন্য আমাদের জনগণের সামনে এসে বলা উচিত ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারকে যদি আপনাদের পছন্দ না হয়, তাহলে সিপিবি ও ন্যাপ আছে। আমরাই বিকল্প পার্টি। আমাদের পেছনে আসুন। আমরা এটা না করে ঐক্য ও সংগ্রাম ধরে রেখেছিলাম। যেটা আমাদের প্রস্তাবে ছিল। কিন্তু ঐক্যটা বেশি করেছি, সংগ্রামটা সেভাবে করিনি; বিশেষ করে নিজেদের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিনি। ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারলাম না এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোও রক্ষা করতে পারলাম না। তবে এই ভুল আমরা সংশোধন করে নিয়েছি এবং প্রকাশ্যভাবে বলেছি, ওই অবস্থায় আর ফিরে যাব না। এখন আমরা স্বাধীন অবস্থান থেকে আমাদের রাজনীতি করে যাব। সমাজতন্ত্র অভিমুখীন একটা সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ও স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে দেশ যাতে পরিচালিত হয়, এর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাব।
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে