সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ
১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম স্বাধীনতার লাল সূর্য ৫২ বছর আগে—১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
সেই বিজয় শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের এবং সে বিজয় তো সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে।
স্বাধীনতার একটি অন্তর্নিহিত মাত্রিকতা আছে, কিন্তু স্বাধীনতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। অন্যদিকে বিজয়েরও একটি বহির্মাত্রা আছে,
কিন্তু বিজয় তো বোধের। সুতরাং বিজয় বা স্বাধীনতা শুধু উদ্যাপনের নয়, চেতনারও এবং সেই চেতনা ধারণ করতে হবে বর্ষব্যাপী, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে; যারা ১৯৭১ দেখেছি তাদের এবং যারা দেখেনি তাদেরও।
আমরা যারা বিজয় দেখেছি, তাদের একটি অংশ সেই চেতনাকে ধারণ করে রাখতে পেরেছি। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও তো সত্য, আমরা অনেকেই সেই চেতনা বিস্মৃত হয়েছি এবং আমাদের কেউ কেউ বেপথুও তো হয়েছি। স্বাধীনতাসংগ্রাম দেখেছেন, কিন্তু স্বীকার করেননি, তাঁদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চেতনাকে আমরা যারা স্বাধীনতাসংগ্রামের সাক্ষী, তাদের জন্য নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আসলে পুরো প্রেক্ষাপট অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা বিজয় দেখেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে হয়তো একটি কল্পকাহিনি, বিজয় তাদের কাছে সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আবেগী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ যোগ সব সময় না-ও থাকতে পারে। কারণগুলো সংগতই; হয়তো কেউ তাদের বিষয়টি ঠিকভাবে বলেনি কিংবা তাদের পাঠ্যক্রমে তা অনুপস্থিত থেকেছে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভ্রান্তিমূলক ধারণারও জন্ম হতে পারে সহজেই।
বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, আজকের বাংলাদেশে এ অবস্থাটির কমতি নেই এবং সেটা শঙ্কাজনক। এ প্রবণতা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধারণ করবে না বিজয়ের সত্যিকারের চেতনা, জানবে না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় আমাদের জাতিসত্তার অহংকার, আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস, আমাদের চেতনার ভিত্তি বিলুপ্তির পথ এই প্রক্রিয়া প্রশস্ত করে দেবে।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন এই বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের সংগ্রামের মূলমন্ত্র ওই ডাকটির মধ্যেই নিহিত। বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ শব্দ দুটোকে সুচিন্তিতভাবে আলাদা করে উচ্চারণ করেছিলেন। কারণ বাঙালির সংগ্রামকে তিনি দুটো পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখেছিলেন। একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একটি সংগ্রামের শেষ কথা নয়, তার জনগণের সার্বিক মুক্তিই হচ্ছে সেই সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সার্বিক মুক্তির আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই সব চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর নিকটজনদের নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধ অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্য খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বেপথু করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
ফলে দিনে দিনে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ না আমরা ব্যক্তিজীবনে ধারণ করতে পেরেছি, না পেরেছি সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে।
গণতন্ত্রের বোধকে আমরা একটি সীমিত পরিমণ্ডলের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছি। আমরা রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কথাই বলেছি, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র বা সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রের কথা বলিনি। আমরা কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতার দিকে দৃষ্টি দিইনি, আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে পেছনে রেখে দিয়েছি, আমরা পরমতসহিষ্ণুতাকে মর্যাদা দিইনি। নানা কারণে আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড়া করাতে পারিনি। আমরা বিস্মৃত হয়েছি যে গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতি, যার নিত্য চর্চার প্রয়োজন। গণতন্ত্রের জন্য নিত্য সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র।
দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিস্ময়করভাবে ঘটেছে, কিন্তু সেই উন্নয়নকে আমরা এখনো সমতাভিত্তিক করতে পারিনি এবং সামাজিক ন্যায্যতাকে এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে আমাদের সমাজে সুযোগের অসমতা আছে, আয় ও সম্পদের অসম বণ্টন রয়েছে। দেশে দারিদ্র্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু ধনিকশ্রেণি ও দরিদ্র এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। দেশে অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য রয়েছে, বৈষম্য রয়েছে পল্লি ও শহরাঞ্চলের মধ্যে, নারী-পুরুষের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘অর্থনৈতিক মুক্তির’ জন্য আরও কাজ আমাদের করতে হবে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে আমরা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হই। এরই অংশ হিসেবে ‘আমরা বাঙালি’ নাকি ‘আমরা বাংলাদেশি’ এমন অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। নিষ্পত্তিকৃত নানান সত্যকে খুঁচিয়ে তুলে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ প্রশ্নে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়।
চতুর্থ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বিসর্জন দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে ‘ইসলামকে’ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যে মুহূর্তে একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সেই মুহূর্তে একটি রাষ্ট্র আর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশ বলে দাবি করতে পারে না এবং সেই মুহূর্তে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরা দেশের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ধর্মনির্বিশেষে দেশের মানুষকে যে সম অধিকার দেয়, একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিলে চালচিত্রটি বদলে যায়।
এই সবকিছুর কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বেপথুও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয় বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
এ বছর বাংলাদেশের মুক্তির বায়ান্ন বছর পূর্ণ হলো। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সে লড়াই বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধকে সংহত করার। এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই—এ লড়াইয়ে জিততে হবে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম স্বাধীনতার লাল সূর্য ৫২ বছর আগে—১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
সেই বিজয় শুধু একটি ভূখণ্ডের নয়, নয় একটি মানবগোষ্ঠীর; সে বিজয় একটি চেতনার, একটি সংগ্রামের, একটি ইতিহাসের এবং সে বিজয় তো সীমাবদ্ধ নয় একটি দিবসে, তা অনুরণিত প্রতিদিন, প্রতি পলে, প্রতি প্রাণে।
স্বাধীনতার একটি অন্তর্নিহিত মাত্রিকতা আছে, কিন্তু স্বাধীনতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। অন্যদিকে বিজয়েরও একটি বহির্মাত্রা আছে,
কিন্তু বিজয় তো বোধের। সুতরাং বিজয় বা স্বাধীনতা শুধু উদ্যাপনের নয়, চেতনারও এবং সেই চেতনা ধারণ করতে হবে বর্ষব্যাপী, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে; যারা ১৯৭১ দেখেছি তাদের এবং যারা দেখেনি তাদেরও।
আমরা যারা বিজয় দেখেছি, তাদের একটি অংশ সেই চেতনাকে ধারণ করে রাখতে পেরেছি। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও তো সত্য, আমরা অনেকেই সেই চেতনা বিস্মৃত হয়েছি এবং আমাদের কেউ কেউ বেপথুও তো হয়েছি। স্বাধীনতাসংগ্রাম দেখেছেন, কিন্তু স্বীকার করেননি, তাঁদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চেতনাকে আমরা যারা স্বাধীনতাসংগ্রামের সাক্ষী, তাদের জন্য নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আসলে পুরো প্রেক্ষাপট অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যারা বিজয় দেখেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধ তাদের কাছে হয়তো একটি কল্পকাহিনি, বিজয় তাদের কাছে সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আবেগী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ যোগ সব সময় না-ও থাকতে পারে। কারণগুলো সংগতই; হয়তো কেউ তাদের বিষয়টি ঠিকভাবে বলেনি কিংবা তাদের পাঠ্যক্রমে তা অনুপস্থিত থেকেছে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভ্রান্তিমূলক ধারণারও জন্ম হতে পারে সহজেই।
বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, আজকের বাংলাদেশে এ অবস্থাটির কমতি নেই এবং সেটা শঙ্কাজনক। এ প্রবণতা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধারণ করবে না বিজয়ের সত্যিকারের চেতনা, জানবে না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। ভবিষ্যতের দিনগুলোয় আমাদের জাতিসত্তার অহংকার, আমাদের ঐতিহ্যের ইতিহাস, আমাদের চেতনার ভিত্তি বিলুপ্তির পথ এই প্রক্রিয়া প্রশস্ত করে দেবে।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন এই বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের সংগ্রামের মূলমন্ত্র ওই ডাকটির মধ্যেই নিহিত। বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ শব্দ দুটোকে সুচিন্তিতভাবে আলাদা করে উচ্চারণ করেছিলেন। কারণ বাঙালির সংগ্রামকে তিনি দুটো পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখেছিলেন। একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাই একটি সংগ্রামের শেষ কথা নয়, তার জনগণের সার্বিক মুক্তিই হচ্ছে সেই সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সার্বিক মুক্তির আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই সব চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। গণতন্ত্র ভিন্ন স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি বজায়ক্ষম ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মানবিকা অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতা ও সব ধরনের সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
এই আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলা শুরু। কিন্তু আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর নিকটজনদের নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধ অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্য খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে বেপথু করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
ফলে দিনে দিনে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ না আমরা ব্যক্তিজীবনে ধারণ করতে পেরেছি, না পেরেছি সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে।
গণতন্ত্রের বোধকে আমরা একটি সীমিত পরিমণ্ডলের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছি। আমরা রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কথাই বলেছি, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র বা সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রের কথা বলিনি। আমরা কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতার দিকে দৃষ্টি দিইনি, আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে পেছনে রেখে দিয়েছি, আমরা পরমতসহিষ্ণুতাকে মর্যাদা দিইনি। নানা কারণে আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড়া করাতে পারিনি। আমরা বিস্মৃত হয়েছি যে গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতি, যার নিত্য চর্চার প্রয়োজন। গণতন্ত্রের জন্য নিত্য সংগ্রামের নামই গণতন্ত্র।
দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিস্ময়করভাবে ঘটেছে, কিন্তু সেই উন্নয়নকে আমরা এখনো সমতাভিত্তিক করতে পারিনি এবং সামাজিক ন্যায্যতাকে এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে আমাদের সমাজে সুযোগের অসমতা আছে, আয় ও সম্পদের অসম বণ্টন রয়েছে। দেশে দারিদ্র্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু ধনিকশ্রেণি ও দরিদ্র এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। দেশে অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য রয়েছে, বৈষম্য রয়েছে পল্লি ও শহরাঞ্চলের মধ্যে, নারী-পুরুষের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘অর্থনৈতিক মুক্তির’ জন্য আরও কাজ আমাদের করতে হবে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে আমরা নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হই। এরই অংশ হিসেবে ‘আমরা বাঙালি’ নাকি ‘আমরা বাংলাদেশি’ এমন অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। নিষ্পত্তিকৃত নানান সত্যকে খুঁচিয়ে তুলে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ প্রশ্নে একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়।
চতুর্থ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বিসর্জন দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে ‘ইসলামকে’ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যে মুহূর্তে একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সেই মুহূর্তে একটি রাষ্ট্র আর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশ বলে দাবি করতে পারে না এবং সেই মুহূর্তে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরা দেশের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ধর্মনির্বিশেষে দেশের মানুষকে যে সম অধিকার দেয়, একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিলে চালচিত্রটি বদলে যায়।
এই সবকিছুর কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরও সংহত হয়েছে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বেপথুও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে, নয় বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
এ বছর বাংলাদেশের মুক্তির বায়ান্ন বছর পূর্ণ হলো। আমরা একটি ক্রান্তিকালের মাঝখান দিয়ে চলেছি। ১৯৭১ সালের মতো আজও একটি সংগ্রাম আমাদের করতে হবে—সে লড়াই বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধকে সংহত করার। এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই—এ লড়াইয়ে জিততে হবে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে