অরক্ষিত বামুন্দীর গণকবর

রাশেদুজ্জামান, মেহেরপুর
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২২, ০৭: ৫০
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২২, ১৭: ২৮

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েছে অথচ এখনো অরক্ষিত দেশের অনেক গণকবর। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামুন্দীতে তেমনি একটি গণকবরের সন্ধান মিলেছে। স্থানটির কথা মনে হলেই এখনো আঁতকে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীরা। গণকবরগুলো সংরক্ষণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

গাংনী উপজেলার বামুন্দীর ইব্রাহীম হোসেন এখন চা দোকানি। নিজ চোখে দেখেছেন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা। তাঁর চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় একজনকে। সেদিনের সেই নির্মমতার কথা তুলে ধরলেন ইব্রাহীম। তিনি বলেন, বামুন্দী পশুহাটের পাশেই ছিল ইংরেজদের একটি কুঠিবাড়ি। দেশ স্বাধীনের পরে ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যুদ্ধের সময় এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় ক্যাম্প। এখানে জেলার ও পার্শ্ববর্তী জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে আনতো পাকিস্তানি সেনারা। চালাত নির্যাতন। অনেককে আবার নির্যাতনের পর ক্যাম্প থেকে অর্ধ কিলোমিটার দূরের একটি মাঠে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। মাটি চাপা দেওয়া হতো সেখানে। যেখানে এখন গড়ে উঠেছে একটি বসতি। পাড়াটির নাম দেওয়া হয়েছে হাটপাড়া।

ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘দিনটির কথা মনে নেই। সেদিন সকালে নিড়ানি ও কোদাল নিয়ে মাঠে গিয়েছিলাম। তখন আমি ১৫ বছরের তরুণ। বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ করে তিন পাক সেনা আমার গতিরোধ করে। সে সময় একজনের হাত-পা বাঁধা ছিল। পাশের একটি আখখেতে একটি গর্ত খুঁড়তে বলা হয় আমাকে। আমি গর্ত খোঁড়ার পরই সেখানে নামানো হয় ওই ব্যক্তিকে। এমন সময় এক সেনা তাঁর মুখের দিকে বুক পর্যন্ত রাইফেলের গুলি তাক করে। পরে গুলি করা হয় তাঁকে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি গর্তে লুটিয়ে পড়েন। রক্ত ছড়িয়ে পড়ে আমার সারা শরীরে। পরে আমাকে বলা হয় মাটি চাপা দিতে। সেদিন ভয়ে ভয়ে আমি মাটি চাপা দিই। ফেরার পথে তাদের পকেট থেকে ১ টাকার একটি নোট বের করে দেয় হাতে। আমি প্রাণ ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসি। সেদিন ভয়ে আমি ঘুমাতে পারিনি।’

চা দোকানি ইব্রাহীম আরও বলেন, ‘শুধু ওই ব্যক্তিকেই নন, শত শত মানুষকে ধরে এনে পাক বাহিনী হত্যা করেছে এ মাঠে। স্বাধীনের পর থেকে আমি আর সেখানে যাই না। জায়গাটির কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে।’

স্থানীয় যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হুদা বলেন, ‘শুধু মেহেরপুর নয়, পাশের অনেক জেলার মানুষকে ধরে নিয়ে এখানে হত্যা করেছে পাক সেনারা। এখানে তারা গড়ে তুলেছিল টর্চার সেল। সেখানে বাঙালিদের ধরে এনে চালানো হতো নির্যাতন। এমনকি একটি গোল চিহ্নের মধ্যে সবাইকে প্রবেশ করানো হতো। শুরু করত লাঠিপেটা। দাগের বাইরে চলে আসলেও তাঁর চোখ-মুখ বেঁধে আবারও চালানো হতো নির্যাতন।’ তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরোলেও জায়গাটি সংরক্ষণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

শহীদ পরিবারের সদস্য সাইদুর রহমান টেবু ও রানু বিশ্বাস বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা খুব ছোট। হঠাৎ একদিন রাতে আমাদের বাবাদের ধরে নিয়ে যায় মিলিটারি বাহিনী। এরপর থেকে আর সন্ধান মেলেনি তাঁদের। ধারণা করা হচ্ছে, ওই মাঠেই তাঁদের হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দাবি, সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বদ্ধভূমিটি। অন্তত বছরে দুটি দিন হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ফুল দিয়ে যেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন।

দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পেরোলেও গণহত্যার স্থানগুলো সংরক্ষণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আব্দুল্লাহ আল আমিন ধুমকেতু। তিনি বলেন, ‘দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য বদ্ধভূমি। যা এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি। অথচ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই এ স্থানগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, যাতে তরুণেরা জানতে পারে দেশ স্বাধীনের গৌরবগাথা ইতিহাস।’

গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী খানম বলেন, স্থানীয় কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা জায়গাটির তথ্য না দেওয়ায় এখন পর্যন্ত জায়গাটি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। আর ওই স্থানটিও ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা। তবে জায়গাটি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত