ইকবাল জাসাত
গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, তখন থেকেই পুরো বিশ্ব এর ফলাফলের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিল। সর্বজনীন আলোচনায় যে প্রশ্নটি সবার মনে জেগেছে তা হলো, প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার নেতৃত্বে এএনসির নেতৃত্বাধীন সরকার কি ঠিক কাজ করেছে? এটি ইসরায়েলের পশ্চিমা রক্ষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজ্ঞদের দল নিশ্চিত করেছে যে, তাদের মামলাটি অকাট্য এবং আইসিজে প্যানেলের বিচারকদের কাছে অত্যন্ত বিস্তৃত এবং আকর্ষণীয় একটি মামলা উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকার দাবি অসার ও ভিত্তিহীন বলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আসরে আবির্ভূত হয়েছেন পশ্চিমা দেশগুলোর জ্যেষ্ঠ নেতারা। বাইডেন প্রশাসনও একে অভিহিত করেছে: ‘অসার, ক্ষতিকারক এবং সম্পূর্ণরূপে তথ্য-প্রমাণহীন।’
দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলাটি যাতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) খারিজ করে দেয়, সে জন্য ইসরায়েলের আইনজ্ঞ দলও নির্লজ্জের মতো যাবতীয় আইনি কৌশল ব্যবহারের চেষ্টা করে।
কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক আদালতের চূড়ান্ত রায় বের হয়, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার আইনগত যুক্তি শুনে কটু ভাষা ব্যবহারকারীরা হতবাক হয়ে যান। আদালতের রায় ছিল, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গণহত্যা চালানোর আশঙ্কা যথেষ্ট। এই রায় ইসরায়েল ও তার সমর্থকদের ঘুম ভেঙে দিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের ‘অস্পৃশ্যতার’ যুগ শেষ হতে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পশ্চিম ইউরোপের নিঃশর্ত রাজনৈতিক সহায়তার কারণে ইসরায়েল যে বিনা প্রতিদানে নির্যাতন চালিয়ে যেতে পারবে, সেই বিশ্বাস আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পর নষ্ট হয়ে গেছে।
যে আইনজ্ঞরা রায়টি মনোযোগসহকারে বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁরা তুলে ধরেছেন যে, এটি ‘ইসরায়েলি রাষ্ট্রনেতাদের, যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের এবং উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের “ধ্বংস করার ইচ্ছা” ঘোষণার কয়েক ডজন সুস্পষ্ট উক্তি এবং নজিরহীন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি ইঙ্গিত করে।’
কল্পনা করুন, ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আইনজ্ঞদের একটি দল। তাদের হাতে রয়েছে রায়ের কাগজ, যা তারা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। তাদের চোখে বিস্ময় ও ক্ষোভ। কারণ, রায়ে লেখা রয়েছে ইসরায়েলি নেতারা কীভাবে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, কীভাবে যুদ্ধে নির্মমভাবে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদন মেনে নিয়ে আদালত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা জারি করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ২৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও ৬৪ হাজারের বেশি আহত হওয়ার কথা। পাশাপাশি প্রায় ২০ লাখ মানুষকে জোর করে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে ‘দুর্ভিক্ষ ও সংক্রামক রোগের মুখোমুখি’র মতো বেদনাদায়ক ও সত্য পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে।
এদিকে জায়নবাদীরা আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধবিরতির আদেশ না জারি হওয়াকে তাদের পক্ষে ‘বিজয়’ বলে উল্লাস করেছে। তবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই সত্য বাদ দিয়েছে যে, আদালতের ১৫ জন বিচারকের মধ্যে ১২ জনের রায়ে গণহত্যা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে, নির্দেশ অত্যন্ত স্পষ্ট: গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং সামরিক বাহিনীকে এই আদেশ মেনে চলতে হবে।
এ ছাড়া, ‘আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গণহত্যায় উসকানি দিতে ইসরায়েলকে অবশ্যই রোধ করতে হবে এবং শাস্তি প্রদান করতে হবে; গাজায় জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে; অপরাধের প্রমাণাদি ধ্বংস রোধ করতে হবে এবং তা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে; এবং এই পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে এক মাসের মধ্যে আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।’
নিউজার্সির স্টকটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলোকাস্ট ও গণহত্যা অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজ সেগালের মতে, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কার্যকর করার জন্য যুদ্ধবিরতি অপরিহার্য। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘এই নির্দেশগুলো বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন, কারণ এগুলো কার্যকর করার আর কোনো উপায় নেই।’ তার এই মূল্যায়ন দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কমন্ত্রী নালেদি পান্ডোরের মতামতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যিনি বলেছেন যে, নির্দেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে ‘যুদ্ধবিরতি অবশ্যই হতে হবে’।
সেগালের একটি দারুণ পর্যবেক্ষণ হলো, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়টি ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ গণহত্যা কনভেনশন থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা এই মতামতের ওপর ভিত্তি করে যে, নাৎসিবাদ ও হলোকাস্ট ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ‘এটি একটি উদ্দেশ্যে কাজ করেছে: ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ—যা তখনো চলমান ছিল—পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে সারা বিশ্বে যে মৃতদেহের স্তূপ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে এটি হলোকাস্টকে আলাদা করেছে।’
অন্য কথায়, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, হলোকাস্টের ব্যতিক্রমী অবস্থান, যা ১৯৪৮ সালে ‘নতুন ইহুদি রাষ্ট্র’কেও ব্যতিক্রমী বানিয়েছে। আর সেই রাষ্ট্র ধাবিত হয়েছে মৌলিক অপরাধের দিকে—নকবা: সাড়ে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির গণবিতাড়ন এবং ১৯৪৮ সালের জাতিগত পরিশুদ্ধির নামে তাদের শত শত গ্রাম ও শহর ধ্বংস করা।
তাঁর মতে, ‘এই বিশেষ কাঠামোর মধ্যে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, সেখানে ইসরায়েলের কোনো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করার কথা কল্পনাও করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার মধ্যে ইসরায়েল এভাবেই নির্যাতন, দমন করে গিয়েছে। নকবার স্মৃতি লুপ্ত করার এই জরুরি প্রয়োজনটি ইসরায়েল রাষ্ট্রের উপনিবেশবাদী বসতি স্থাপন প্রকল্প হিসেবে এর প্রকৃত রূপ অস্বীকার করার বৃহত্তর প্রবণতা থেকেও উঠে এসেছে।’
সেগালের মতে, তিক্ত সত্য হলো, বিদ্রুপাত্মকভাবে ইহুদিদের রক্ষার জন্য যে ইসরায়েলের সৃষ্টি, সেই ইসরায়েলেই বর্ণবাদ ও শ্বেতাধিপত্য তীব্র আকার নিয়েছে।
আমরা এই বর্ণবাদী মানসিকতার কথা মনে করি ইসরায়েলি নেতাদের মতো। উদাহরণস্বরূপ—প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জোগ, যিনি ৫ ডিসেম্বর এমএসএনবিসিতে একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে শ্বেতাধিপত্যবাদী ও ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন: ‘এই যুদ্ধ শুধু ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধ নয়।’ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আসলে সত্যিই পশ্চিমা সভ্যতা রক্ষার উদ্দেশ্যে করা একটি যুদ্ধ...আমরা একটি জিহাদি নেটওয়ার্ক, ... একটি সাম্রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্য জয় করতে চায়। আমরা না থাকলে ইউরোপ হবে পরবর্তী লক্ষ্য এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্র।’
দক্ষিণ আফ্রিকার বিশাল আবেদন ও আন্তর্জাতিক আদালতের ১৭ বিচারকের এক বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছ থেকে এটি যে ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে, তা কেবল নতুন ক্ষেত্র খুলে দেওয়াই নয়, এটি আসলেই বিপ্লব। সেগালের গভীর বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, এত দিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থায় গণহত্যার ধারণাটি হলোকাস্ট এবং ইসরায়েলের বিশেষ মর্যাদা রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার পরিবর্তে এটিকে সমর্থন করেছে।
আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় অনুযায়ী ইসরায়েলের গাজায় হামলা সম্ভবত জেনোসাইড বলে বিবেচিত হতে পারে। ফলে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কোম্পানি ও রাষ্ট্রকে এখন ইসরায়েল ও তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এ ধরনের সম্পর্ক এখন সম্ভবত জাতিগত নিধনের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
যদি আন্তর্জাতিক আদালতের এই ঐতিহাসিক রায় সত্যিই ফিলিস্তিনিরা যে দুঃখ ভোগ করছে তা বর্ণনা করার জন্য গণহত্যার মতো অপরাধকে একটি আইনি কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের নতুন যুগে অনুপ্রবেশ করানোর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা পূর্ণ কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য। কারণ শেষ পর্যন্ত নিপীড়ন, দখল, বর্ণবাদ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘আইনি যুদ্ধ’।
লেখক: ইকবাল জাসাত
নির্বাহী সদস্য, মিডিয়া রিভিউ নেটওয়ার্ক, জোহানেসবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা
(মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, তখন থেকেই পুরো বিশ্ব এর ফলাফলের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিল। সর্বজনীন আলোচনায় যে প্রশ্নটি সবার মনে জেগেছে তা হলো, প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার নেতৃত্বে এএনসির নেতৃত্বাধীন সরকার কি ঠিক কাজ করেছে? এটি ইসরায়েলের পশ্চিমা রক্ষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজ্ঞদের দল নিশ্চিত করেছে যে, তাদের মামলাটি অকাট্য এবং আইসিজে প্যানেলের বিচারকদের কাছে অত্যন্ত বিস্তৃত এবং আকর্ষণীয় একটি মামলা উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকার দাবি অসার ও ভিত্তিহীন বলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আসরে আবির্ভূত হয়েছেন পশ্চিমা দেশগুলোর জ্যেষ্ঠ নেতারা। বাইডেন প্রশাসনও একে অভিহিত করেছে: ‘অসার, ক্ষতিকারক এবং সম্পূর্ণরূপে তথ্য-প্রমাণহীন।’
দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলাটি যাতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) খারিজ করে দেয়, সে জন্য ইসরায়েলের আইনজ্ঞ দলও নির্লজ্জের মতো যাবতীয় আইনি কৌশল ব্যবহারের চেষ্টা করে।
কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক আদালতের চূড়ান্ত রায় বের হয়, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার আইনগত যুক্তি শুনে কটু ভাষা ব্যবহারকারীরা হতবাক হয়ে যান। আদালতের রায় ছিল, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গণহত্যা চালানোর আশঙ্কা যথেষ্ট। এই রায় ইসরায়েল ও তার সমর্থকদের ঘুম ভেঙে দিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের ‘অস্পৃশ্যতার’ যুগ শেষ হতে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পশ্চিম ইউরোপের নিঃশর্ত রাজনৈতিক সহায়তার কারণে ইসরায়েল যে বিনা প্রতিদানে নির্যাতন চালিয়ে যেতে পারবে, সেই বিশ্বাস আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পর নষ্ট হয়ে গেছে।
যে আইনজ্ঞরা রায়টি মনোযোগসহকারে বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁরা তুলে ধরেছেন যে, এটি ‘ইসরায়েলি রাষ্ট্রনেতাদের, যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের এবং উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের “ধ্বংস করার ইচ্ছা” ঘোষণার কয়েক ডজন সুস্পষ্ট উক্তি এবং নজিরহীন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি ইঙ্গিত করে।’
কল্পনা করুন, ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আইনজ্ঞদের একটি দল। তাদের হাতে রয়েছে রায়ের কাগজ, যা তারা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। তাদের চোখে বিস্ময় ও ক্ষোভ। কারণ, রায়ে লেখা রয়েছে ইসরায়েলি নেতারা কীভাবে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, কীভাবে যুদ্ধে নির্মমভাবে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদন মেনে নিয়ে আদালত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা জারি করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ২৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও ৬৪ হাজারের বেশি আহত হওয়ার কথা। পাশাপাশি প্রায় ২০ লাখ মানুষকে জোর করে উচ্ছেদ হয়ে বর্তমানে ‘দুর্ভিক্ষ ও সংক্রামক রোগের মুখোমুখি’র মতো বেদনাদায়ক ও সত্য পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে।
এদিকে জায়নবাদীরা আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধবিরতির আদেশ না জারি হওয়াকে তাদের পক্ষে ‘বিজয়’ বলে উল্লাস করেছে। তবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই সত্য বাদ দিয়েছে যে, আদালতের ১৫ জন বিচারকের মধ্যে ১২ জনের রায়ে গণহত্যা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে, নির্দেশ অত্যন্ত স্পষ্ট: গণহত্যা বন্ধ করতে হবে এবং সামরিক বাহিনীকে এই আদেশ মেনে চলতে হবে।
এ ছাড়া, ‘আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গণহত্যায় উসকানি দিতে ইসরায়েলকে অবশ্যই রোধ করতে হবে এবং শাস্তি প্রদান করতে হবে; গাজায় জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে; অপরাধের প্রমাণাদি ধ্বংস রোধ করতে হবে এবং তা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে; এবং এই পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে এক মাসের মধ্যে আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।’
নিউজার্সির স্টকটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলোকাস্ট ও গণহত্যা অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজ সেগালের মতে, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কার্যকর করার জন্য যুদ্ধবিরতি অপরিহার্য। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘এই নির্দেশগুলো বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন, কারণ এগুলো কার্যকর করার আর কোনো উপায় নেই।’ তার এই মূল্যায়ন দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কমন্ত্রী নালেদি পান্ডোরের মতামতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যিনি বলেছেন যে, নির্দেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে ‘যুদ্ধবিরতি অবশ্যই হতে হবে’।
সেগালের একটি দারুণ পর্যবেক্ষণ হলো, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়টি ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ গণহত্যা কনভেনশন থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা এই মতামতের ওপর ভিত্তি করে যে, নাৎসিবাদ ও হলোকাস্ট ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ‘এটি একটি উদ্দেশ্যে কাজ করেছে: ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ—যা তখনো চলমান ছিল—পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে সারা বিশ্বে যে মৃতদেহের স্তূপ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে এটি হলোকাস্টকে আলাদা করেছে।’
অন্য কথায়, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, হলোকাস্টের ব্যতিক্রমী অবস্থান, যা ১৯৪৮ সালে ‘নতুন ইহুদি রাষ্ট্র’কেও ব্যতিক্রমী বানিয়েছে। আর সেই রাষ্ট্র ধাবিত হয়েছে মৌলিক অপরাধের দিকে—নকবা: সাড়ে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির গণবিতাড়ন এবং ১৯৪৮ সালের জাতিগত পরিশুদ্ধির নামে তাদের শত শত গ্রাম ও শহর ধ্বংস করা।
তাঁর মতে, ‘এই বিশেষ কাঠামোর মধ্যে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, সেখানে ইসরায়েলের কোনো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করার কথা কল্পনাও করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার মধ্যে ইসরায়েল এভাবেই নির্যাতন, দমন করে গিয়েছে। নকবার স্মৃতি লুপ্ত করার এই জরুরি প্রয়োজনটি ইসরায়েল রাষ্ট্রের উপনিবেশবাদী বসতি স্থাপন প্রকল্প হিসেবে এর প্রকৃত রূপ অস্বীকার করার বৃহত্তর প্রবণতা থেকেও উঠে এসেছে।’
সেগালের মতে, তিক্ত সত্য হলো, বিদ্রুপাত্মকভাবে ইহুদিদের রক্ষার জন্য যে ইসরায়েলের সৃষ্টি, সেই ইসরায়েলেই বর্ণবাদ ও শ্বেতাধিপত্য তীব্র আকার নিয়েছে।
আমরা এই বর্ণবাদী মানসিকতার কথা মনে করি ইসরায়েলি নেতাদের মতো। উদাহরণস্বরূপ—প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জোগ, যিনি ৫ ডিসেম্বর এমএসএনবিসিতে একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে শ্বেতাধিপত্যবাদী ও ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন: ‘এই যুদ্ধ শুধু ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধ নয়।’ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আসলে সত্যিই পশ্চিমা সভ্যতা রক্ষার উদ্দেশ্যে করা একটি যুদ্ধ...আমরা একটি জিহাদি নেটওয়ার্ক, ... একটি সাম্রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্য জয় করতে চায়। আমরা না থাকলে ইউরোপ হবে পরবর্তী লক্ষ্য এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্র।’
দক্ষিণ আফ্রিকার বিশাল আবেদন ও আন্তর্জাতিক আদালতের ১৭ বিচারকের এক বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছ থেকে এটি যে ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছে, তা কেবল নতুন ক্ষেত্র খুলে দেওয়াই নয়, এটি আসলেই বিপ্লব। সেগালের গভীর বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, এত দিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থায় গণহত্যার ধারণাটি হলোকাস্ট এবং ইসরায়েলের বিশেষ মর্যাদা রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার পরিবর্তে এটিকে সমর্থন করেছে।
আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় অনুযায়ী ইসরায়েলের গাজায় হামলা সম্ভবত জেনোসাইড বলে বিবেচিত হতে পারে। ফলে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কোম্পানি ও রাষ্ট্রকে এখন ইসরায়েল ও তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এ ধরনের সম্পর্ক এখন সম্ভবত জাতিগত নিধনের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
যদি আন্তর্জাতিক আদালতের এই ঐতিহাসিক রায় সত্যিই ফিলিস্তিনিরা যে দুঃখ ভোগ করছে তা বর্ণনা করার জন্য গণহত্যার মতো অপরাধকে একটি আইনি কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের নতুন যুগে অনুপ্রবেশ করানোর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা পূর্ণ কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য। কারণ শেষ পর্যন্ত নিপীড়ন, দখল, বর্ণবাদ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘আইনি যুদ্ধ’।
লেখক: ইকবাল জাসাত
নির্বাহী সদস্য, মিডিয়া রিভিউ নেটওয়ার্ক, জোহানেসবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা
(মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে