গাজীপুরের তিন আসন: জাহাঙ্গীরের ‘কৌশল’ এবার খাটল না

মো. আসাদুজ্জামান ও সাখাওয়াত ফাহাদ, গাজীপুর থেকে
Thumbnail image

গত বছর গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী মা জায়েদা খাতুনকে বিজয়ী করে ‘চমক’ দেখিয়েছিলেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটিতে তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নেমেছিলেন তিনি। ওই তিন প্রার্থীর মধ্যে জিতেছেন একজন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ বলছে, জাহাঙ্গীরের বিগত সিটি নির্বাচনের কৌশল এবার কাজ করেনি। তিনি সমর্থন করলেও তাঁর অনুসারী-সমর্থকদের ভোট স্বতন্ত্রদের পক্ষে নিতে পারেননি। আর জাহাঙ্গীর বলেছেন, কয়েক নেতার কারণে যে আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে, তা প্রমাণের জন্য তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন করেছেন।

গত রোববার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের পাঁচটি আসনের মধ্যে চারটিতেই বিজয়ী হয়েছে নৌকা। আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীরা হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক (গাজীপুর-১), যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল (গাজীপুর-২), রুমানা আলী (গাজীপুর-৩) ও সিমিন হোসেন রিমি (গাজীপুর-৪)। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মহিলা লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি (গাজীপুর-৫) হেরে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানের কাছে। 

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দেওয়া তথ্য এবং ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকার ভোট, বিএনপি-জামায়াতের ভোট এবং নিম্নবিত্ত ভাসমান ভোটারদের ভোট স্বতন্ত্রদের পক্ষে টানতে সফল 
হননি জাহাঙ্গীর। যা পেরেছিলেন ২০১৮ সালের এবং গত বছরের সিটি নির্বাচনে। মূলত এই ভোটারদের ভোটেই ২০১৮ সালে তিনি এবং গত বছর তাঁর মা মেয়র নির্বাচিত হন।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই গাজীপুর-১, ২ ও ৫ আসনের ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী যথাক্রমে রেজাউল করিম রাসেল, কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন ও আখতারুজ্জামানকে নিয়ে ‘নৌকাবিরোধী জোট’ গড়ে তোলেন জাহাঙ্গীর আলম। এই তিন আসনের একাংশ পড়েছে সিটি করপোরেশন এলাকায়। জাহাঙ্গীর এই তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমে প্রতিপক্ষ নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির পর দল থেকে বাদ পড়া, মেয়র পদ হারানো, সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়া নিয়ে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বিরোধের ধারাবাহিকতায় তিনি এই অবস্থান নেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে তাঁর জনপ্রিয়তা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। 

বিজয়ে জাহাঙ্গীরের ভূমিকা নেই বলে মন্তব্য করেছেন গাজীপুর-৫ আসনে বিজয়ী আখতারুজ্জামান। তাঁর আসনে সিটি করপোরেশন এলাকার ভোট ৭৯ হাজার। এর মধ্যে মোট ভোট পড়েছে ২৫ শতাংশ। তিনি বলেন, ‘আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা। একবার এমপি ছিলাম, ডাকসুর ভিপি-জিএস ছিলাম, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। এসব দায়িত্বে থাকাকালে আমার কাজের মাধ্যমে মানুষের মনে যে ছাপ রেখেছি, তাঁরা এই নির্বাচনে তার মূল্যায়ন করেছেন।’ 

গত সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৮ শতাংশের বেশি। কিন্তু রোববারের জাতীয় নির্বাচনে সিটি এলাকায় ভোট পড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। সিটির বাইরে ভোট পড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ভোটাররা বলছেন, এবার সিটি করপোরেশন এলাকায় জাহাঙ্গীরের ভোটব্যাংক হিসেবে বিবেচিত ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরাও কেন্দ্রে যাননি। এ ছাড়া গাজীপুরে অন্যতম প্রভাবক ভাসমান শ্রমিকশ্রেণির ভোটাররা। জাহাঙ্গীরের প্রভাব থাকা এসব ভোটারের অনেকে টানা তিন দিনের ছুটিতে এলাকা ছেড়েছেন।

মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ দলীয় প্রার্থীদের সমালোচনা ও বিষোদ্গারকে ভালোভাবে নেননি গাজীপুর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলমকে দলীয় এবং মেয়র পদ থেকে অপসারণ করার কারণে তাঁর মধ্যে রাগ-ক্ষোভ থাকতে পারে। তিনি স্থানীয় নেতাদের দোষারোপ করে যা বলছেন, তা ঠিক নয়।’
গাজীপুর-২ আসনে বিজয়ী জাহিদ আহসান রাসেল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তিনি শুধু আমার বিরুদ্ধে নয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, শহীদ ময়েজউদ্দিনের মেয়ে চুমকি আপার মতো শ্রদ্ধেয় মানুষদের নিয়েও কুৎসা করছেন। এটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।’ গাজীপুর-১ আসনে বিজয়ী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘জাহাঙ্গীরের কার্যকলাপ কেন্দ্রের নেতারা পর্যবেক্ষণ করছেন। এখনকার কর্মকাণ্ডের জন্য ভবিষ্যতে তাঁকে ফল ভোগ করতে হবে।’

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ছিল ৮ লাখ আর এখন ২ লাখ। তাঁরা আওয়ামী লীগকে দুর্বল করেছেন। দুই মন্ত্রীর বোঝা উচিত ছিল আওয়ামী লীগের লোকজন ২ লাখ ভোট তাঁদের বিপক্ষে দিয়েছেন। যখন তাঁরা এমপি ছিলেন, তখন তাঁদের ভোট ছিল, মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁদের ভোট কমছে। তার মানে, তাঁরা এলাকায় সুশাসন দেননি, নেতাদের মূল্যায়ন করেননি। আমি এটা প্রমাণের জন্য ভোটে স্বতন্ত্রদের সমর্থন দিয়েছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত