Ajker Patrika

বাবার পথ চেয়ে থাকে না তারা

রাশেদ নিজাম ও  সোহান শেখ, বাগেরহাট থেকে
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২: ২২
বাবার পথ চেয়ে থাকে না তারা

তিন মেয়ে শাবানার। বছর দুয়েক আগে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। মেজ মেয়ে সুরাইয়া (১৩) মাদ্রাসাছাত্রী। ছোট সুমাইয়া (১০) পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জাল বুনে দিনে আয় ৪০-৫০ টাকা। সঙ্গে ইউনিয়নের রাস্তায় ইট বিছানোর কাজের মজুরি দিয়েই কোনোমতে চলছে তাঁদের জীবন।

এই তিন মা-মেয়ের বাস বগা গ্রামের এক ভাঙা ঘরে। গ্রামটি বাগেরহাট সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে কচুয়া উপজেলার ধোবাখালী ইউনিয়নে। শাবানার স্বামী মনির মাঝি সাগরে হারিয়ে গেছেন ২০১৫ সালে। সংসার চলে কীভাবে–এ প্রশ্নে মুখে উত্তর না দিয়ে চোখের পানিতেই বুঝিয়ে দিলেন সব।

২০১৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে ঝড়ে সুন্দরবনের পশুর নদের চালনার খড়িতে ডুবে যায় মাছ ধরার বেশ কয়েকটি ট্রলার। মারা যান অর্ধশত জেলে। সে রাতে মনিরসহ নিখোঁজ বাগেরহাটের ২৯ জনের ১৯ জনেরই বাড়ি এই বগা গ্রামে। তবে গ্রামে এর জন্য কিছু থেমে নেই। সব চলছে। শুধু বাবার স্নেহ-ভালোবাসা বঞ্চিত হয়ে আছে প্রায় ৪০টি শিশু। তাদের অন্তত ১৫ জনের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছর। তারা যখন বাবার কাছে আবদার করতে শিখেছিল, বাবা মাছ ধরে ফেরার সময় হাতে কিছু নিয়ে এলে খুশি হতে শিখেছিল, তখনই তিনি হারিয়ে গেলেন।

বগা গ্রামের হারিয়ে যাওয়া এই মৎস্যজীবীরা হলেন মিজান বেপারী, রেজাউল বেপারী, রুস্তম বাবনা, তালেব আলী হাওলাদার, আলীয়ার হাওলাদার, মজিদ মল্লিক, কালাম মল্লিক, জাহাঙ্গীর বেপারী, হাসান মল্লিক, আল আমিন আমানী, আতিয়ার বেপারী, মাসুম শেখ, গণি বেপারী, নেয়ামুল আমানী, তৈয়ব আলী বাওয়ালী, আইয়ুব আলী বাবনা, হান্নান আমানী, হাফিজুল বাবনা ও মনির হোসেন। তাঁদের মরদেহ না পাওয়ায় ক্ষতিপূরণও পায়নি তাঁদের পরিবার।

একই উপজেলার মঘিয়া ইউনিয়নের চারজন, গোপালপুরের তিনজন, বাধালের দুজন এবং গজালিয়া ইউনিয়নের একজনের মরদেহ পাওয়া যায়নি। এই ২৯ জনের পরিবারের জন্য প্রশাসনের কোনো স্তর থেকেই সহায়তা আসেনি।

১১ বছরের আবু তালেবের বাবা নিখোঁজ তৈয়ব আলী বাওয়ালী। বগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এই ছাত্রের কাছে বাবার স্মৃতি বলতে তৈয়বের একটি পাসপোর্ট আকারের ছবি। সর্বশেষ বাবাকে দেখার কথা তার মনে নেই। তবে সে এখন জানে, বাবা আর আসবেন না। তালেবের মা নুরুন নাহার এলাকায় বিভিন্ন মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালান। তালেবের তিন বোন আছে।

পাশের বাড়ি আরেক নিখোঁজ তালেব আলী হাওলাদারের। তাঁর স্ত্রী মরিয়ম একমনে জাল বুনছেন। প্রতিদিন এ কাজের পাশাপাশি অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়ির ফুটফরমাশের আয়েই জীবন চলে তাঁর। গ্রামের দোকানে কারও সঙ্গে সন্তান দেখলেই দৌড়ে ঘরে চলে আসে ১২ বছরের ছেলে সালমান। মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদে।

মানুষের বাসায় কাজ করে দুই সন্তান নিয়ে টিকে আছেন শাবানাএই পরিবারগুলো উপজেলা প্রশাসন, জেলা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে দৌড়াদৌড়ি করলেও কোনো লাভ হয়নি বলে জানান একই ঘটনায় চাচা, ভাইসহ চারজনকে হারানো ইব্রাহীম আমানী। মৃত্যুসদন ছাড়া ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম নেই বলে অপেক্ষা করেছেন সাত বছর। পরে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে লিখিত এনে গত বছরের মাঝামাঝি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সেই সদনও জমা দিয়েছেন কচুয়া উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ে। কিন্তু তারও কোনো খোঁজ নেই।

ইব্রাহীম বলেন, ‘যাঁদের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল তাঁদের পরিবার সব মিলিয়ে ৮০ হাজার টাকার সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের এই ১৯ জনের পরিবার এখনো কিছু পায়নি। হঠাৎ করে উপজেলা কার্যালয় থেকে মারা যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে আবেদন করতে হবে—এমন নিয়মের কথা বলছে।’

কচুয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘বগা গ্রাম থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিহত জেলেদের ক্ষতিপূরণের জন্য কিছু আবেদন পেয়েছি। কিন্তু এসব জেলে নতুন নীতিমালার আওতায় নেই। তাই এঁদের আবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়নি। কেন নীতিমালার বাইরে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নীতিমালা হওয়ার আগেই এসব জেলে মারা গেছেন।

২০১৯ সালের নিহত জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের আর্থিক সহায়তা প্রদান নীতিমালার ৬.৫ ধারায় বলা হয়েছে, নিহত/নিখোঁজ জেলে পরিবারের পক্ষ থেকে বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেকে তিন মাসের মধ্যে স্থানীয় উপজেলা মৎস্য অফিসে আবেদন করতে হবে।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, ‘মৃত্যুসনদ না থাকায় তাঁরা শুরুতে আবেদন করতে পারেননি। বিষয়টি আমাদের জানা। তবে জেলেদের পরিবারের আবেদনগুলো এখনো আমার হাতে আসেনি। খোঁজখবর নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এক ছাতায় সব নাগরিক সেবা

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

তানভীর ইমামের বাড়ি ভেবে গুলশানের একটি বাসায় মধ্যরাতে শতাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, তছনছ

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত