জ্বালানি তেলের দামে আশা-নিরাশা

চিররঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৪, ০৮: ০৪

আমাদের রাজনীতিতে যেমন কোনো সুসংবাদ নেই, অর্থনীতিতেও নেই। করোনা মহামারির পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট চলছে। সেই সংকটের ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের অর্থনীতিতেও। ডলারসংকট চলছে তো চলছেই। আমদানি ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। আর এই ব্যয় মেটাতে টান পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। চলছে মুদ্রাস্ফীতি আর মূল্যস্ফীতি।

মূল্যবৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। এর মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের খবর কিছুটা স্বস্তি বয়ে এনেছিল। গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম সরকারিভাবে কিছুটা কমানোও হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১০৯ থেকে ৭৫ পয়সা কমে ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা, অকটেনের দাম লিটারপ্রতি ১৩০ থেকে ৪ টাকা কমে ১২৬ টাকা এবং পেট্রলের দাম ১২৫ থেকে ৩ টাকা কমে ১২২ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

সরকার গত ২৯ ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের নির্দেশিকার প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ মার্চ প্রাইসিং ফর্মুলা অনুসারে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে।

জ্বালানি তেলের সর্বশেষ মূল্য সমন্বয় হয় ২৯ আগস্ট, ২০২২। এরপর করোনা মহামারি-উত্তর সরবরাহ-সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার কারণে সমুদ্রপথে জ্বালানি পণ্যের প্রিমিয়াম, পরিবহন ভাড়া, বিমা ও ব্যাংক সুদের হার ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছে। উল্লিখিত সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা অবমূল্যায়িত হয়েছে এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের (প্রধানত ডিজেল) মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল। সরকারকে আইএমএফ যে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে তার অন্যতম শর্ত হচ্ছে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ থেকে সব ভর্তুকি তুলে দিতে হবে।

জ্বালানি বিভাগ বলছে, আইএমএফ গত নভেম্বর থেকেই স্বয়ংক্রিয় এই মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি কার্যকর করার বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। তবে নির্বাচনের আগে সরকার তেলের দামের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার পক্ষে ছিল না।

প্রতিবেশী দেশ ভারত জ্বালানি তেলের মূল্য না কমালেও বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করে একটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে।ভারতের কলকাতায় বর্তমানে ডিজেল লিটারপ্রতি ৯২ দশমিক ৭৬ রুপি বা ১৩৩ টাকা ৫৭ পয়সা (১ রুপি= ১.৪৪ টাকা) এবং পেট্রল ১০৬ দশমিক শূন্য ৩ রুপি বা ১৫২ টাকা ৬৮ পয়সা বিক্রি হচ্ছে। এটা বাংলাদেশ থেকে যথাক্রমে প্রায় ২৪ টাকা ৫৭ পয়সা ও ২৭ টাকা ৬৮ পয়সা বেশি।

আইএমএফের শর্তের কারণে হোক, আর সরকারের সদিচ্ছার কারণেই, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। আমাদের দেশে কোনো কিছুর দাম কখনো কমে না। একবার বাড়লে তা কেবল বাড়তেই থাকে।

সেদিক থেকে জ্বালানির দাম কমানোটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। জ্বালানির দাম কমলে পরিবহন খরচসহ সব খরচ কমে। তাতে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আসার একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমাদের পোড়া কপাল। জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল ভোগ করার আগেই আবার বিশ্ববাজারে এর দাম বেড়ে যাওয়ার আলামত লক্ষ করা যাচ্ছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ক্রমাগত কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তেল উৎপাদনকারী দেশের জোট ওপেক ও এর সহযোগী দেশগুলো হঠাৎ করেই তেল উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই খবরে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। ওপেক এবং রাশিয়াসহ ওপেকের সহযোগী দেশগুলোর এক ভার্চুয়াল বৈঠকে তেল উৎপাদন হ্রাসের এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের জোগান কমানোর সময়সীমা আগামী জুন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে চলেছে অপরিশোধিত তেলের উৎপাদক ও রপ্তানিকারী দেশগুলোর সংগঠন ‘ওপেক’ এবং রাশিয়াসহ তাদের সহযোগী দেশগুলোর একাংশ।

এই সূত্রে দৈনিক ২২ লাখ ব্যারেল উৎপাদন হ্রাস করা হচ্ছে। সরবরাহ কমিয়ে জ্বালানির দরকে ঠেলে তুলতে তেলের উৎপাদন কমাচ্ছে ওপেক এবং এর সহযোগীরা। এই হ্রাসের অনেকাংশই বহন করছে ওপেকের নেতৃত্বদানকারী সৌদি আরব, যে গত জুলাই থেকে উৎপাদন দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেল করে কমিয়ে আসছে। আপাতত সেই মাত্রার ছাঁটাই বহাল রাখা হলো। রাশিয়াও দৈনিক ৪ দশমিক ৭৭ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক এবং কুয়েতের মতো বৃহত্তর ওপেকের বেশ কিছু সদস্যও সৌদি আরবের পথেই হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিশ্বের ৪০ শতাংশের কাছাকাছি অপরিশোধিত তেল উৎপাদিত হয় বৃহত্তর ওপেকের দ্বারা। তেলের বাজারের ভারসাম্য বজায় রাখতে সময়ে-সময়ে চাহিদা-জোগানও নিয়ন্ত্রণ করে তারা। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বহু দেশ যখন লকডাউন পরিস্থিতির জেরে বিপর্যস্ত, তখন ক্রেতার অভাবে হ্রাস পেয়েছিল তেলের দাম।

সেই সময় তেলের দাম জোরদার করতে উৎপাদনের মাত্রা বহু গুণ কমিয়েছিল এই সংগঠন। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে বাজারে চাহিদার বিপর্যয়ের আশঙ্কায় এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড) দাম ১৩০ ডলারে পৌঁছে যায়। যদিও গত বছরের মার্চে দামের পতন ঘটে প্রতি ব্যারেলে ৭০ ডলারের কাছাকাছি।

ফলে অপরিশোধিত তেলের বাজারে একদিকে স্থিতাবস্থা কায়েম এবং অন্যদিকে তেলের দাম জোরদার করতে ওপেক ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন হ্রাসের পথ নিয়েছে। যার জেরে ব্রেন্ট ক্রুড সম্প্রতি প্রতি ব্যারেল ৮৩ দশমিক ৫৫ ডলারে বিক্রি হয়েছে, যা ছিল গত চার মাসে সর্বাধিক। কিন্তু সংগঠনটি এযাবৎ যে মূল্যবৃদ্ধির আশা করেছিল, তা সম্ভব হয়নি বিবিধ কারণে।

যার অন্যতম মহামারি এবং তৎপরবর্তী সময়ে যুদ্ধের জেরে উন্নত দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দা; বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারী রাষ্ট্র চীনে তেলের চাহিদা যথেষ্ট থাকলেও, মহামারি-পরবর্তী সময়ে মন্দা-আক্রান্ত দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের ধারা কতখানি বজায় থাকবে, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি রোধে বহু দেশে ব্যাংকের চড়া সুদের হারের জেরে মানুষের ব্যবহারযোগ্য আয় (ডিসপোজিবল ইনকাম) প্রভাবিত হওয়ায়, তেলের চাহিদা কমার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

জ্বালানি তেলের দামে মোটামুটি একটি স্থিতিশীল অবস্থার কারণে কয়েক মাসে উন্নত দেশসহ বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। তাতে বিশ্ব অর্থনীতি যখন আশার আলো দেখতে শুরু করেছিল, তখন ওপেক ও তার মিত্রদের এই তেল উৎপাদন হ্রাসের খবরে আতঙ্কিত হওয়ার সমূহ কারণ রয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার আবার বেড়ে যেতে পারে।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সাধারণত বহুমাত্রিক হয়। প্রথমত, এতে পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ে, এর সঙ্গে বাড়ে উৎপাদন খরচ। এতে সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে যেসব দেশ আমদানিনির্ভর, সেই সব দেশ দুর্দশার মধ্যে পড়ে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে টান পড়ে। তখন ফেডারেল রিজার্ভসহ বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদ বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দিতে পারে। তাতে মন্দার আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ টন পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা আছে। অপর্যাপ্ত পরিশোধন সুবিধার কারণে এর ৮০ শতাংশ পরিশোধিত আকারে আমদানি করা হয়। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যের ওঠাপড়ার ওপর আমাদের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল।

মুদ্রাস্ফীতির চাপ ছাড়াও এই আমদানির খরচ বাড়ার জেরে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলাফল (ট্রেড ব্যালেন্স), বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার, টাকার দাম হ্রাস, পেট্রল ও ডিজেলের বাজারমূল্য বাড়লে ঘরোয়া অর্থনীতির ওপর চাপ—অর্থনীতির নানা দিকে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশকে তেল আমদানির পথটি বহুমুখী করার চেষ্টা করতে হবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে যদি বিকল্প পথ বেরোয়ও, কিছু স্বল্পমেয়াদি সংকট আপাতত এড়ানো কঠিন, এ কথা মেনে নিয়েই এগোতে হবে সরকারকে।

দেশের মানুষ এমনিতেই ভালো নেই। অনেক তোড়জোড়ের পরও রমজান শুরু হওয়ার আগেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম না বাড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য সুচিন্তিত উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত