রাজস্ব আয়ের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র অব্যবহৃত

অরুণ কর্মকার
Thumbnail image

দেশে এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং চলতি ব্যয় নির্বাহের (ব্যালান্স অব পেমেন্টস) ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার শর্তসাপেক্ষ ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক আলোচনা হচ্ছে। সেই আলোচনায় অর্থনীতিবিদ, গবেষক, ব্যাংকার প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরা যেমন যোগ দিচ্ছেন, তেমনি সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং বিশেষ অজ্ঞরাও পিছিয়ে নেই।

কয়েক দিনে নগরীর অনেকগুলো জায়গায় আমার যাওয়া হয়েছে। কোথাও নিজের কাজে। কোথাও-বা কিছু তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে। এর প্রতিটি জায়গাতেই লক্ষ করে দেখেছি, আলাপ-আলোচনা ঘুরেফিরে ওই রাজস্ব এবং চলতি ব্যয় নির্বাহের সংকট প্রসঙ্গে চলে যায়।

এই সব আলোচনায় আরেকটি বিষয়ে দেখলাম, মোটামুটি সবাই একমত। বিষয়টি হলো—সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র পড়ে আছে। সেগুলো ব্যবহার করতে পারলে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়াতেও কোনো সমস্যা হবে না। তবে বিদ্যমান কর প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা দিয়ে তা সম্ভব কি না, সে বিষয়ে সবারই সন্দেহ আছে।

সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে আয়কর। আয়কর না দেওয়া এবং ফাঁকি দেওয়া লোকের সংখ্যা দেশে এত বিপুলসংখ্যক যে তা নিরূপণ করা কঠিন। কয়েক দিনে যেসব জায়গায় যেতে হয়েছে বলেছি, তার মধ্যে একটি জায়গা হলো ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস; অর্থাৎ সাব-রেজিস্ট্রার অফিস। সেখান থেকে অর্জিত একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে।

মিরপুর এলাকার একটি ফ্ল্যাট কেনাবেচার রেজিস্ট্রেশন হবে। বিক্রেতা, মানে দলিলদাতা ছয়জন। তাঁরা জায়গা কিনে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আটতলা একটি বাড়ি বানিয়েছেন। সেই বাড়ির কয়েকটি ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন। তারই একটির রেজিস্ট্রেশন হবে। ফ্ল্যাট ক্রেতা এক দম্পতি। তাঁরা দুজনই অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী।

দলিল লেখক উভয় পক্ষের কাছে যে কটি প্রয়োজনীয় কাগজ চাইলেন, তার একটি হচ্ছে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন। সঙ্গে ট্যাক্স রিটার্ন জমার স্লিপ। ফ্ল্যাট ক্রেতার সব কাগজপত্র দেওয়া হলো। বিক্রেতা ছয়জনের মধ্যে দেখা গেল তিনজনের টিআইএন নেই। বাকি তিনজনের আছে। কিন্তু তার মধ্যেও একজনের ট্যাক্স রিটার্ন জমার স্লিপ নেই; অর্থাৎ তিনি রিটার্ন দাখিল করেননি।

এখন কী হবে! যে তিনজন বিক্রেতার টিআইএন নেই তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০০ করে টাকা নেওয়া হলো। পাশেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন এক তরুণ। তিনি তাঁদের জন্য নতুন টিআইএন বানিয়ে দিলেন। টিআইএন নতুন হলে রিটার্ন জমার স্লিপ লাগে না। ঢাকার কোনো কোনো এলাকার সাব রেজিস্ট্রার অফিসের নাকি নতুন টিআইএন হলে সঙ্গে ‘নো রিটার্ন সার্টিফিকেট’ দিতে হয়। মিরপুর এখনো সে নিয়মের বাইরে।

কিন্তু যে বিক্রেতার পুরোনো টিআইএন আছে, তাঁর তো রিটার্ন জমার স্লিপ লাগবে। শেষ পর্যন্ত দুই-একটি তথ্য এদিক-সেদিক করে তাঁর জন্যও নতুন টিআইএন করে আনা হলো। সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। দলিল রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন।

এই যে ফ্ল্যাট বিক্রেতা ভদ্রলোকেরা তাঁরা কিন্তু প্রত্যেকেই ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। বাড়ি-ফ্ল্যাটও তাঁদের শুধু এই একটি নয়। তাঁরা এই শহরের সম্পন্ন মধ্যবিত্ত। স্থানীয় সমাজে তাঁরা সুপরিচিতও বটে। আইন অনুযায়ী তাঁদের প্রত্যেকেই আয়করের আওতায় পড়েন। কিন্তু দেন না। এমন অসংখ্য লোক আছেন আমার নিজের চেনা-জানা মহলের মধ্যেও। তাঁদের অনেকে বহু কোটিপতি। কিন্তু দিব্যি আছেন আয়কর জালের বাইরে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চার বছর আগে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ছিল ৪১ লাখের মতো। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৫ লাখ। অথচ এ বছর রিটার্ন জমা পড়েছে সাড়ে ২৮ লাখ।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আয়কর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক, এমন ব্যবসায়ী কোম্পানির সংখ্যা দেশে প্রায় পৌনে তিন লাখ। কিন্তু গত অর্থবছরে রিটার্ন জমা দিয়েছে মাত্র ২৮১টি কোম্পানি এবং এই কোম্পানিগুলোর ৯৮৭ জন পরিচালক। এসব তথ্য জানার পর আর কীই-বা বলার থাকে!

তবে আমরা এসব তথ্য যতই চেপে-ঢেকে রাখতে চাই আইএমএফের মতো সংস্থাগুলোর এসব জানা আছে। সে জন্যই তারা রাজস্ব আদায় বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট পরিমাণ ও সময় উল্লেখ করে শর্ত দিয়েছে। তাতে আগামী তিন অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা কর আদায় বাড়ানোর যে কথা বলা হয়েছে, তা শুধু আয়কর থেকেই তুলে আনা সম্ভব। সে জন্য যাঁরা আয়করের আওতায় পড়েন, তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে হবে। এখানেই প্রশ্ন—বর্তমান ব্যবস্থাপনায় এবং বিদ্যমান কর প্রশাসন এই কাজের উপযুক্ত কি না। আয়করের পর রাজস্ব আয় বাড়ানোর আরেকটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে মূসক বা ভ্যাট। নতুন ভ্যাট আইন চালু করা হয়েছে তিন বছর আগে। কিন্তু ভ্যাট আদায়ে অগ্রগতি কম। অথচ খুচরা দোকানদারেরা পর্যন্ত পারলে ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করেন। ধারণা করা হয়, ভ্যাট যত আদায় হয়, সরকারি কোষাগারে ততটা জমা হয় না।

কাস্টমস থেকেও অন্তত আগামী দুই বছর বাড়তি শুল্ক আদায়ের সুযোগ আছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার পর অবশ্য এই সুযোগ আর থাকবে না।

রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিষয়ে এনবিআর সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা ক্ষেত্র অথবা কর্মপদ্ধতি চূড়ান্ত করেনি। তবে রাজস্ব আয় বাড়ানো যে সম্ভব হবে, সে বিষয়ে তারাও মোটামুটি নিশ্চিত। আগামী বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত