প্রকৃত লেখকসত্তার দুটি অংশ–একটি হৃদয়, অন্যটি বুদ্ধি

বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৩, ১০: ১১

আজকের পত্রিকা: স্যার, ৮৮তম জন্মদিন উপলক্ষে আপনাকে শুভেচ্ছা। প্রথমেই জানতে চাই, লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মানসগঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন কে বা কারা? 
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার মানসগঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন দুজন—আমার পিতা ও মাতা। এঁদের দুজনের মধ্যে কার প্রভাব বেশি বলতে পারব না। বাবা আমাকে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন, মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি সংবেদনশীলতা। একসময় মনে হতো বাবার ভূমিকা ছিল বেশি, কিন্তু এখন মনে হয় আমার মানসগঠনে মা আরও গভীরে কাজ করেছেন। আমার মা অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন।

আজকের পত্রিকা: কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করতে চান, যাঁরা আপনাকে লেখালেখিতে প্রণোদিত করেছেন? 
সি ই চৌ: স্কুলজীবনে প্রণোদনা পেয়েছি চক্রবর্তী স্যারের কাছ থেকে। আমাদের সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে তিনি বাংলা পড়াতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসুর সমসাময়িক ছাত্র ছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধের সঙ্গে তিনিই আমার পরিচয় ঘটিয়েছিলেন।

আমি পড়েছি সেন্ট গ্রেগরীজ কলেজে, যেটি এখন নটর ডেম কলেজ; এই কলেজে বাংলার অধ্যাপক ছিলেন অজিত কুমার গুহ। ইংরেজি পড়াতেন ফাদার মার্টিন। এঁদের দুজনের সান্নিধ্যেও আমি লেখার ব্যাপারে উৎসাহ পেয়েছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে। প্রণোদনা তিনিও দিয়েছেন। 

আজকের পত্রিকা: আপনি আমাদের দেশের একজন স্বনামধন্য লেখক, লেখালেখির জগতে সাহিত্যিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে উপন্যাস, কবিতা, নাটক, ছোটগল্প ইত্যাদি বিষয়ে আপনার কোনো আগ্রহ ছিল না? 
সি ই চৌ: কবিতায় আমার আগ্রহ ছিল না। অঙ্কে সুবিধা করতে পারব না ভেবে আমি বিজ্ঞান শাখায় যাইনি। ছন্দ মেলানোর ব্যাপারেও আমার অঙ্কভীতির মতোই একটা ভয় ছিল বলে মনে হয়। তবে আমি ছোটগল্প কিছু লিখেছি। আমার একটি নয়, দুটি উপন্যাস আছে। আমার কল্পনা ছিল যে আমি কথাসাহিত্যিক হব। কিন্তু হতে পারিনি দুই কারণে। একটি হচ্ছে অভিজ্ঞতার সীমা, অপরটি পেশা। আমি বড় হয়েছি মধ্যবিত্ত জীবনের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে থেকে, পরবর্তী সময়েও থেকেছি ওই গণ্ডির ভেতরেই। আমার অভিজ্ঞতার সীমা আমাকে পর্যাপ্ত উপাদান দেয়নি গল্প-উপন্যাস লেখার। আমার পেশাও আমাকে সাহায্য করেনি। সাহিত্য পড়াতে গিয়ে আমাকে যেভাবে সাহিত্য পড়তে হয়েছে, সেটা ছিল বিশ্লেষণধর্মী; কথাসাহিত্যের জন্য প্রয়োজন ছিল সংশ্লেষণের চর্চা। তা ছাড়া সাহিত্য পড়াতে ও পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, কথাসাহিত্যের যে মান প্রতিষ্ঠিত, আমার পক্ষে তার ধারেকাছে যাওয়াও সম্ভব হবে না। প্রবন্ধে বরং চেষ্টা করা যেতে পারে। সে চেষ্টাই করেছি। তা ছাড়া প্রবন্ধে আমি ব্যক্তিগত মতও প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছি। কথাসাহিত্যের চর্চা আমার কাছে যে নৈর্ব্যক্তিকতা দাবি করত, সেটা অর্জনও দুঃসাধ্য মনে হয়েছে। তবে আমি চেষ্টা করেছি আমার গদ্য রচনায় কথাসাহিত্যের আদল আনতে, রচনাকে হৃদয়গ্রাহী করার লক্ষ্যে। 

আজকের পত্রিকা: সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে সাহিত্যের অন্যান্য শাখা রেখে প্রবন্ধেই কেন এত বেশি আগ্রহ? কোন প্রেরণায় এদিকে অগ্রসর হয়েছেন? 
সি ই চৌ: প্রবন্ধে আমি মোটেই পাণ্ডিত্য প্রকাশে আগ্রহী নই। তবে হ্যাঁ, বিষয়বস্তু না থাকলে তো প্রবন্ধ হয় না। প্রবন্ধকে আমি সৃষ্টিশীলতার মাধ্যম হিসেবেই দেখি। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় এর মর্যাদা হয়তো কম; কিন্তু গুরুত্ব মোটেই কম নয়। পৃথিবীর বড় দার্শনিকেরা তো প্রাবন্ধিকই ছিলেন। প্রেরণাটা ভেতরের। সেটা হলো এই বোধ যে আমার বলার কিছু আছে এবং সেটা না লিখে বলার উপায় নেই। যতই নৈর্ব্যক্তিক হোন না কেন, শেষ পর্যন্ত সব লেখকই আত্মজৈবনিক। আমার প্রবন্ধেও আত্মজৈবনিকতা আছে। 
 
আজকের পত্রিকা: মার্ক্সবাদের প্রতি কখন এবং কীভাবে আকৃষ্ট হন?  
সি ই চৌ: মার্ক্সবাদের প্রতি আমার আকর্ষণ স্কুলজীবন থেকেই। তখন বইপত্র তেমন পাওয়া যেত না। যা পেতাম তা-ই পড়তাম। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আমাকে আকর্ষণ করত। কলকাতার ‘পরিচয়’ ও ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকা নিয়মিত পড়তাম। মার্ক্সবাদের বৈষম্যবিরুদ্ধতা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। সর্বত্র আমি অন্যায় ও অবিচার দেখতাম; তার ব্যাখ্যা এবং তার হাত থেকে মুক্তির পথ মার্ক্সবাদই দেখাত।

আজকের পত্রিকা: সমাজ ও শ্রেণিচেতনায় যে বৈষম্য, সেটি দূরীকরণের চিন্তা থেকেই কী কার্ল মার্ক্সের আদর্শ আপনার অনুসরণীয়, নাকি আরও কিছু বিষয় এর নেপথ্যে রয়েছে? 
সি ই চৌ: নেপথ্যে আরও কিছু ঘটনা আছে। আমার স্কুলজীবনের প্রথমটা কেটেছে রাজশাহীতে, কিছুটা কলকাতায়। এ দুই সময়েই আমি কমিউনিস্ট পার্টির কিছু কাজ দেখেছি। রাজশাহীর সাহেব বাজারে কমিউনিস্ট পার্টির একটা অফিস ছিল। আমরা মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কথাই শুনতাম, কমিউনিস্ট পার্টিকে ভিন্ন রকমের বলে মনে হতো। ওই সময় কাপড় সেলাইয়ের দর্জিরা একটি ধর্মঘট করে। সে উপলক্ষে টাউন হলে (যেটি আবার সিনেমা হলও ছিল) একটি সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। তার ছোট্ট একটা ইশতেহার পেয়েছিলাম, দিয়েছিলেন পাড়ারই একজন। হয়তো তিনি পেশায় দর্জিই ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম।

এরপরে আমরা কলকাতায় যাই। সেখানে ট্রাম ধর্মঘট হয়েছিল। ধর্মঘটের পরেও অনেক দিন ট্রামের মাথায় তিনটি পতাকা উড়তে দেখেছি। এক পাশে কংগ্রেসের, অন্য পাশে মুসলিম লীগের, মাঝখানে পতপত করে উড়ত কমিউনিস্টদের পতাকা। সেই ছবি এখনো মনে পড়ে।

কলকাতায় আমরা পড়তাম ‘আজাদ’ পত্রিকা; মাঝেমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকাও পেয়ে যেতাম। আমার বাবা বলতেন, আসল স্বাধীনতার কথা কিন্তু ওরাই বলে, যদিও বাসায় তিনি ‘আজাদ’ রাখতেন।

সাতচল্লিশে কয়েক মাস ছিলাম ময়মনসিংহে। বিকেলে নদীর ধারে যেতাম বেড়াতে, একদিন দেখি কমিউনিস্ট পার্টির সভা হচ্ছে। অল্প লোক, কিন্তু অন্য ধরনের বক্তব্য। 
ঢাকায় এসেও কমিউনিস্ট পার্টির এক সভার আয়োজন দেখেছিলাম। সভাটি হতে পারেনি। আয়োজনটা ছিল বাহাদুর শাহ পার্কে (তখনকার নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক)। কলতাবাজার থেকে মুসলিম লীগের কয়েকজন গুন্ডা লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আয়োজনটা পণ্ড করে দিল। সেটা দেখলাম। তাতে যারা আক্রান্ত, তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং আক্রমণকারীদের প্রতি প্রবল ঘৃণা জন্মে। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র।

আমাদের স্কুলে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক কয়েকজন ছাত্র ছিল মনে হয়, নইলে একদিন সকালে এসে বেঞ্চের ওপরে তাদের বক্তব্য সংবলিত কাগজ পাব কেন?

মার্ক্সবাদীরা বলতেন, স্বাধীনতা আসেনি। আসেনি যে তার প্রমাণ দেখতে পেতাম। এই বক্তব্যটা তাই আকর্ষণ করত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আমি আইএ ক্লাসের ছাত্র। সেই আন্দোলনে মূল শক্তি যে ছিল মার্ক্সবাদীরা, সেটা টের পেতাম।

উচ্চশিক্ষার জন্য আমি গিয়েছিলাম ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ ও ষাটের দশকের শুরুর সময়। ইউরোপজুড়ে তখন বামপন্থীরা তৎপর। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে লন্ডনে বামপন্থীদের তৎপরতার প্রভাব আমার প্রাদেশিকতার দ্বারা সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারে কাজ করেছে। লন্ডনে তখন আমার কজন বন্ধু ছিলেন, যাঁরা ঢাকা থেকে গেছেন; এঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভাবতেন। ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে যে সমাজতান্ত্রিক হতে হবে—এই চিন্তা তাঁদের কারও কারও ছিল।

মার্ক্সবাদের প্রতি আকর্ষণের একটি কারণ মার্ক্সবাদীদের দিক থেকে ইতিহাসকে গুরুত্বদান এবং সাহিত্যের পেছনে যে ইতিহাস থাকে, থাকে শ্রেণিদ্বন্দ্ব, এই ধারণার অনুশীলন। ইতিহাসের ব্যাখ্যায় শ্রেণি সম্পর্কের ভূমিকা বিবেচনার শিক্ষাও মার্ক্সবাদের কাছ থেকেই পেয়েছি। 

আজকের পত্রিকা: বাঙালি যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সেই স্বপ্ন কতটুকু সফল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? 
সি ই চৌ: সফল শুধু এইটুকু যে আমরা স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র পেয়েছি। স্বপ্ন ছিল সামাজিক বিপ্লবের, যাতে করে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এককথায় মুক্তিযুদ্ধ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

আজকের পত্রিকা: কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কী কী গুণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনুপস্থিত বলে আপনার ধারণা? 
সি ই চৌ: বাংলাদেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব, অভাব স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার নিরাপত্তার। অধিকাংশ মানুষের উপযুক্ত বাসস্থান নেই। শিক্ষাও সবাই সমানভাবে পায় না। মেয়েরা বিশেষভাবে হুমকির মুখে থাকে। কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া এবং সবার জন্য অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা। 

আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার ক্ষেত্রে ফ্রেমওয়ার্ক কী হতে পারে এবং জ্ঞানচর্চায় আমাদের প্রতিবন্ধকতাগুলো কী? 
সি ই চৌ: প্রথম প্রতিবন্ধক হচ্ছে তিন ধারার শিক্ষা। শিক্ষাকে অভিন্ন, অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে করা চাই। দ্বিতীয় সমস্যা, রাষ্ট্র ও সমাজে জ্ঞানের মূল্য বৃদ্ধির পরিবর্তে অবমূল্যায়ন। জ্ঞানের চর্চাকে মূল্যায়ন করা চাই। এর জন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতাটা বোকামি, নির্ভর করতে হবে সমাজ পরিবর্তনকামী মানুষের ওপরই। তাঁদের ওপর, যাঁরা আন্দোলন করবেন, বসে থাকবেন না। 

আজকের পত্রিকা: নারীশিক্ষা বা নারীর ক্ষমতায়ন, সর্বোপরি বাংলাদেশের নারীর গতিশীল জীবনব্যবস্থা কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 
সি ই চৌ: মেয়েরা সমাজের অর্ধেক; কিন্তু সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে সমাজকে যথার্থ অর্থে গণতান্ত্রিক করা চাই। 

আজকের পত্রিকা: প্রকৃত লেখকসত্তা অর্জনের জন্য কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন? তরুণ লেখকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে? 
সি ই চৌ: প্রকৃত লেখকসত্তার দুটি অংশ—একটি হৃদয়, অন্যটি বুদ্ধি। এই দুয়ের বিকাশ দরকার। বিকাশের ক্ষেত্রে দুয়ের ভেতরে অবৈরী দ্বন্দ্ব থাকলে খুবই ভালো। তরুণ লেখকদের প্রতি পরামর্শ হৃদয় ও বুদ্ধির চর্চা করার। অনেক পড়তে হবে, অনুশীলন থাকবে, থাকবে সংবেদনশীলতার চর্চা।

আজকের পত্রিকা: জীবনের প্রাপ্তির ব্যাপারে তৃপ্তি ও অতৃপ্তির স্বরূপ ব্যাখ্যা করুন। 
সি ই চৌ: তৃপ্তি ও অতৃপ্তি নির্ভর করে আকাঙ্ক্ষার ওপরে। কী চাই সেটা জানলে জানা সম্ভব কতটা পেলাম, কতটা পাইনি। 

আজকের পত্রিকা: জীবনে এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি, এমনটি মনে হয়?

এটি কী? আবার কোন ব্যাপারে নিজেকে সফলও মনে করেন?

সি ই চৌ: কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছাতে পারিনি। সফলতা এখানে যে চেষ্টার ত্রুটি করিনি। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত