ড. মইনুল ইসলাম
সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির দাম অসম্ভব বেড়েছে। বিদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করতে হয়, সেগুলোর জন্য মূল্যস্ফীতি ছাড়াও অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের পথ নিতে হয়েছে। এ জন্য করতে হচ্ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। প্রতিদিন চাহিদার থেকে প্রায় দেড়-দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হচ্ছে। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি অর্জন সত্ত্বেও দৈনিক উৎপাদনকে ১০-১১ হাজার মেগাওয়াটে সীমিত রাখায় লোডশেডিং বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ হিসেবে প্রদত্ত হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ। (লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্পকারখানাগুলোর ‘ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট’ এবং জেনারেটর চালাতে হলে ডিজেল ব্যবহার বেড়ে যায়, শহরাঞ্চলের বাড়িঘরে ব্যবহৃত জেনারেটরেও ডিজেল ব্যবহার বাড়ে। সুতরাং, আসলে যোগ-বিয়োগ করে ডিজেল ব্যবহার কতখানি কমছে, তা বলা কঠিন। লোডশেডিং যে জনদুর্ভোগ ঘটাচ্ছে এবং জনজীবনকে ব্যয়বহুল করে তুলছে, তার কথা নাহয় বাদই দিলাম)!
একই সঙ্গে দেশে গ্যাসের ঘাটতিও ক্রমেই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় গ্যাসের রেশনিং বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম গত দুই বছরে প্রায় ১০ গুণ বেড়ে যাওয়ায় এলএনজি আমদানি ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আমদানি করা এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদননীতি, শিল্পনীতি এবং গৃহস্থালি জ্বালানিনীতি দেশের অর্থনীতিকে উল্লিখিত বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে বলা চলে। সে জন্যই প্রশ্ন উঠবে, বর্তমান এই বিপর্যয়কর গ্যাস-সংকটের জন্য দায়ী কে?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ রকম বদ্বীপ অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন সাগর-উপসাগরের তলদেশগুলো সাধারণত সবচেয়ে বেশি হাইড্রোকার্বন (তেল ও গ্যাস) খনির ভান্ডার হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের গালফ ডেলটা এবং আফ্রিকার নাইজার ডেলটা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্গোপসাগরের ভারত উপকূলের অদূরে গোদাবরী বেসিন এবং মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের অদূরে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অঞ্চলের অগভীর সাগরতলে প্রাপ্ত বিপুল গ্যাসভান্ডার এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে চলেছে। অথচ বাংলাদেশ ২০ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকৃত বা স্বল্প-পরীক্ষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের খ্যাতিমান ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরূল ইমাম জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে জরিপ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় অভিমত হলো, এ দেশের স্থলভাগ এবং সাগরতলে এখনো ৩২ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের ভান্ডার বিদ্যমান।
উনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দুই বছরের একটি মূল্যায়ন প্রকল্পের অভিমত হলো, দেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের পরিমাণ কম-বেশি ৩২ টিসিএফ হতে পারে। নরওয়ে সরকারের অধীন নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের সঙ্গে যৌথ জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদ ৩৮-৪২ টিসিএফ হতে পারে। এরপর র্যাম্বল নামের একটি ইউরোপিয়ান তেল ও গ্যাস কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য গ্যাসের পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। বদরূল ইমাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন, ভারতের ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যে যেখানে ইতিমধ্যে ১৫০টি গ্যাসকূপ খনন করে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে, সেখানে ত্রিপুরার ১৫ গুণ বড় আয়তনের বাংলাদেশের স্থলভাগে ৫১ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে এক শর কম। অথচ এত কম অনুসন্ধান কূপ খনন করেও বাংলাদেশে ত্রিপুরার চেয়ে অনেক বেশি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমানার এক-তৃতীয়াংশের কম এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হয়েছে, অথচ বিশ্বের গড়ের চেয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্ত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা অনেক বেশি।
তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, গ্যাস পাওয়ার সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশে এত কম গ্যাস অনুসন্ধান চালানোর কারণ কী? বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় অভিমত, কয়েকজন প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারকের অন্যায্য কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্যই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গ্যাস অনুসন্ধানকে ‘কোল্ড স্টোরেজে’ পাঠিয়ে দিয়ে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকে এলএনজি আমদানিনির্ভর করে রেখেছেন।
বদরূল ইমাম জানাচ্ছেন, ২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা সমুদ্র অঞ্চলের ২৬টি অনুসন্ধান ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সার্ভিস কোম্পানির মাধ্যমে সিসমিক সার্ভে (মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে) পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, যাতে এই জরিপের মাধ্যমে একটি ডেটাবেইস তৈরি করে তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অনুসন্ধানের দর-কষাকষি চালানো যায়। সবচেয়ে উপযুক্ত সার্ভিস কোম্পানি বাছাইয়ের জন্য একটি ‘জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি’ও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে কমিটির বাছাই করা যুক্তরাষ্ট্র-নরওয়েজিয়ান জয়েন্ট ভেঞ্চার সার্ভিস কোম্পানিকে সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। ওই কোম্পানিটি যখন বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডের যোগ্যতার পরীক্ষায় আবার উত্তীর্ণ হয়েছিল, তখন কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকেই পুনরায় পুরো প্রক্রিয়া রহস্যজনকভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে পরবর্তী সাত বছরে বাংলাদেশের সাগরতলের গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি আর এগোতে পারেনি। এই সাত বছরে আর একবারও সাগরের ২৬টি ব্লকে ‘সিসমিক সার্ভে’ চালানো হয়নি, কোনো গ্যাস অনুসন্ধানও শুরু করা যায়নি।
সাম্প্রতিককালে ভারতের ‘অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন’কে একটি ব্লকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা সাত বছরে মাত্র একটি কূপ খনন করেছে। আর কোনো আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিকে এখনো দেশের অনুসন্ধান ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা যায়নি। উল্লিখিত ব্যর্থতার দায় কার? বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তো খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে, মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের হাতে তো মন্ত্রণালয়ের এত বড় গুরুদায়িত্ব থাকার কথা নয়!
উল্লেখ্য, প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল’স অব দ্য সি’স (ইটলস) এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ, যার পুরো কৃতিত্ব শেখ হাসিনা সরকারের। দুঃখজনক হলো, এই বিজয় অর্জনের আট বছর অতিক্রান্ত হলেও শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এই মহাসুযোগের সত্যিকার তাৎপর্য উপলব্ধি করে অগ্রাধিকার দিয়ে অবিলম্বে এই বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণ জোরদার করাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন কি না, তা নিয়েই আমি সন্দিগ্ধ। গ্যাস অনুসন্ধানে রহস্যজনক বিলম্ব যে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে, তার দায় কে নেবে?
নিচের বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে বিবেচনা করা যাক:বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার অদূরে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে বেশ কয়েক বছর আগে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রপ্তানি করছে মিয়ানমার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য ইজারা দিয়েছিল। দাইয়ু যথাযথ প্রস্তুতি এবং সরঞ্জাম নিয়ে ওই অঞ্চলে তেল-গ্যাস এক্সপ্লোরেশন চালানোর জন্য কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। ২০১২ সালের ইটলসের রায়ে ওই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা এখন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ, কিন্তু ১০ বছরেও ওখানে এখনো কোনো নতুন এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ইজারাদার কোম্পানি। এই বিলম্বের কারণে মিয়ানমার যে এই সমুদ্রাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, সেই গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ, সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুত তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ওখানে গ্যাস পাওয়া যাবেই, এটা প্রায় নিশ্চিত মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। (২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাউথইস্ট এশিয়া পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কোম্পানি বাংলাদেশের এসএস-১১ ব্লক সম্পর্কে এ অভিমত তুলে ধরেছে)। হয়তো এহেন বিলম্বের কারণে কয়েক টিসিএফ গ্যাস থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ!
এলএনজি আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর কায়েমি স্বার্থ কি সব আয়োজন ভন্ডুল করে দিচ্ছে তাদের মুনাফা দীর্ঘদিন চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে? আট বছর সময় অতিক্রান্ত হলেও আমাদের প্রস্তুতি এখনো শেষ হলো না কেন? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ‘ব্লু ইকোনমি’ পরিচালনা ও নীতি-নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন ও রশি-টানাটানি এই বিলম্বের প্রধান কারণ। ক্ষমতার রশি-টানাটানি সমস্যা সমাধানের জন্য স্বতন্ত্র একটি ‘সমুদ্রসম্পদ মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।
সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির দাম অসম্ভব বেড়েছে। বিদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করতে হয়, সেগুলোর জন্য মূল্যস্ফীতি ছাড়াও অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে। সব মিলিয়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের পথ নিতে হয়েছে। এ জন্য করতে হচ্ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। প্রতিদিন চাহিদার থেকে প্রায় দেড়-দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হচ্ছে। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি অর্জন সত্ত্বেও দৈনিক উৎপাদনকে ১০-১১ হাজার মেগাওয়াটে সীমিত রাখায় লোডশেডিং বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ হিসেবে প্রদত্ত হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ। (লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্পকারখানাগুলোর ‘ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট’ এবং জেনারেটর চালাতে হলে ডিজেল ব্যবহার বেড়ে যায়, শহরাঞ্চলের বাড়িঘরে ব্যবহৃত জেনারেটরেও ডিজেল ব্যবহার বাড়ে। সুতরাং, আসলে যোগ-বিয়োগ করে ডিজেল ব্যবহার কতখানি কমছে, তা বলা কঠিন। লোডশেডিং যে জনদুর্ভোগ ঘটাচ্ছে এবং জনজীবনকে ব্যয়বহুল করে তুলছে, তার কথা নাহয় বাদই দিলাম)!
একই সঙ্গে দেশে গ্যাসের ঘাটতিও ক্রমেই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় গ্যাসের রেশনিং বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম গত দুই বছরে প্রায় ১০ গুণ বেড়ে যাওয়ায় এলএনজি আমদানি ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আমদানি করা এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদননীতি, শিল্পনীতি এবং গৃহস্থালি জ্বালানিনীতি দেশের অর্থনীতিকে উল্লিখিত বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে বলা চলে। সে জন্যই প্রশ্ন উঠবে, বর্তমান এই বিপর্যয়কর গ্যাস-সংকটের জন্য দায়ী কে?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ রকম বদ্বীপ অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন সাগর-উপসাগরের তলদেশগুলো সাধারণত সবচেয়ে বেশি হাইড্রোকার্বন (তেল ও গ্যাস) খনির ভান্ডার হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের গালফ ডেলটা এবং আফ্রিকার নাইজার ডেলটা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্গোপসাগরের ভারত উপকূলের অদূরে গোদাবরী বেসিন এবং মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের অদূরে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অঞ্চলের অগভীর সাগরতলে প্রাপ্ত বিপুল গ্যাসভান্ডার এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে চলেছে। অথচ বাংলাদেশ ২০ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকৃত বা স্বল্প-পরীক্ষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের খ্যাতিমান ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরূল ইমাম জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে জরিপ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় অভিমত হলো, এ দেশের স্থলভাগ এবং সাগরতলে এখনো ৩২ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের ভান্ডার বিদ্যমান।
উনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দুই বছরের একটি মূল্যায়ন প্রকল্পের অভিমত হলো, দেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের পরিমাণ কম-বেশি ৩২ টিসিএফ হতে পারে। নরওয়ে সরকারের অধীন নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাইড্রোকার্বন ইউনিটের সঙ্গে যৌথ জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদ ৩৮-৪২ টিসিএফ হতে পারে। এরপর র্যাম্বল নামের একটি ইউরোপিয়ান তেল ও গ্যাস কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য গ্যাসের পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। বদরূল ইমাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন, ভারতের ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যে যেখানে ইতিমধ্যে ১৫০টি গ্যাসকূপ খনন করে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে, সেখানে ত্রিপুরার ১৫ গুণ বড় আয়তনের বাংলাদেশের স্থলভাগে ৫১ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে এক শর কম। অথচ এত কম অনুসন্ধান কূপ খনন করেও বাংলাদেশে ত্রিপুরার চেয়ে অনেক বেশি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমানার এক-তৃতীয়াংশের কম এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হয়েছে, অথচ বিশ্বের গড়ের চেয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্ত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা অনেক বেশি।
তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, গ্যাস পাওয়ার সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশে এত কম গ্যাস অনুসন্ধান চালানোর কারণ কী? বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় অভিমত, কয়েকজন প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারকের অন্যায্য কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্যই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গ্যাস অনুসন্ধানকে ‘কোল্ড স্টোরেজে’ পাঠিয়ে দিয়ে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকে এলএনজি আমদানিনির্ভর করে রেখেছেন।
বদরূল ইমাম জানাচ্ছেন, ২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা সমুদ্র অঞ্চলের ২৬টি অনুসন্ধান ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সার্ভিস কোম্পানির মাধ্যমে সিসমিক সার্ভে (মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে) পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, যাতে এই জরিপের মাধ্যমে একটি ডেটাবেইস তৈরি করে তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অনুসন্ধানের দর-কষাকষি চালানো যায়। সবচেয়ে উপযুক্ত সার্ভিস কোম্পানি বাছাইয়ের জন্য একটি ‘জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি’ও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে কমিটির বাছাই করা যুক্তরাষ্ট্র-নরওয়েজিয়ান জয়েন্ট ভেঞ্চার সার্ভিস কোম্পানিকে সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। ওই কোম্পানিটি যখন বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডের যোগ্যতার পরীক্ষায় আবার উত্তীর্ণ হয়েছিল, তখন কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকেই পুনরায় পুরো প্রক্রিয়া রহস্যজনকভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে পরবর্তী সাত বছরে বাংলাদেশের সাগরতলের গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি আর এগোতে পারেনি। এই সাত বছরে আর একবারও সাগরের ২৬টি ব্লকে ‘সিসমিক সার্ভে’ চালানো হয়নি, কোনো গ্যাস অনুসন্ধানও শুরু করা যায়নি।
সাম্প্রতিককালে ভারতের ‘অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন’কে একটি ব্লকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা সাত বছরে মাত্র একটি কূপ খনন করেছে। আর কোনো আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিকে এখনো দেশের অনুসন্ধান ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা যায়নি। উল্লিখিত ব্যর্থতার দায় কার? বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তো খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে, মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের হাতে তো মন্ত্রণালয়ের এত বড় গুরুদায়িত্ব থাকার কথা নয়!
উল্লেখ্য, প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল’স অব দ্য সি’স (ইটলস) এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ, যার পুরো কৃতিত্ব শেখ হাসিনা সরকারের। দুঃখজনক হলো, এই বিজয় অর্জনের আট বছর অতিক্রান্ত হলেও শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এই মহাসুযোগের সত্যিকার তাৎপর্য উপলব্ধি করে অগ্রাধিকার দিয়ে অবিলম্বে এই বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণ জোরদার করাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন কি না, তা নিয়েই আমি সন্দিগ্ধ। গ্যাস অনুসন্ধানে রহস্যজনক বিলম্ব যে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে, তার দায় কে নেবে?
নিচের বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে বিবেচনা করা যাক:বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার অদূরে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে বেশ কয়েক বছর আগে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রপ্তানি করছে মিয়ানমার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য ইজারা দিয়েছিল। দাইয়ু যথাযথ প্রস্তুতি এবং সরঞ্জাম নিয়ে ওই অঞ্চলে তেল-গ্যাস এক্সপ্লোরেশন চালানোর জন্য কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। ২০১২ সালের ইটলসের রায়ে ওই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা এখন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ, কিন্তু ১০ বছরেও ওখানে এখনো কোনো নতুন এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ইজারাদার কোম্পানি। এই বিলম্বের কারণে মিয়ানমার যে এই সমুদ্রাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, সেই গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ, সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুত তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ওখানে গ্যাস পাওয়া যাবেই, এটা প্রায় নিশ্চিত মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। (২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাউথইস্ট এশিয়া পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কোম্পানি বাংলাদেশের এসএস-১১ ব্লক সম্পর্কে এ অভিমত তুলে ধরেছে)। হয়তো এহেন বিলম্বের কারণে কয়েক টিসিএফ গ্যাস থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ!
এলএনজি আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর কায়েমি স্বার্থ কি সব আয়োজন ভন্ডুল করে দিচ্ছে তাদের মুনাফা দীর্ঘদিন চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে? আট বছর সময় অতিক্রান্ত হলেও আমাদের প্রস্তুতি এখনো শেষ হলো না কেন? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ‘ব্লু ইকোনমি’ পরিচালনা ও নীতি-নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন ও রশি-টানাটানি এই বিলম্বের প্রধান কারণ। ক্ষমতার রশি-টানাটানি সমস্যা সমাধানের জন্য স্বতন্ত্র একটি ‘সমুদ্রসম্পদ মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৩ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৭ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৭ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৭ দিন আগে