হাসান মামুন
শবে বরাত থেকেই রমজানের আমেজ শুরু হয়ে যায় দেশে এবং এর অর্থনীতি চাঙা হতে থাকে। মিডিয়ায় খবর—মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে রমজান সামনে রেখে কয়েকটি পণ্যের দামে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর সিংহভাগই নিত্যপণ্য। আর দেশে খবর হলো, শুল্ক ছাড় দেওয়ার পরও বাড়ার প্রবণতা চিনির দামে! এর আগেও চিনির দাম কমাতে এই ধারার পদক্ষেপ নেয় সরকার। তাতেও দাম কমেনি বা থেকেছে ‘উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল’।
চিনির দাম কমাতে আরও আগে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল এবং আরও বেশি শুল্ক ছাড় দেওয়া দরকার বলে সমালোচনা রয়েছে অবশ্য। বেশি শুল্ক ছাড় দিয়ে সুফল না পাওয়ার উদাহরণও কম নেই। আশঙ্কা, রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার এবার আগের মতোই অস্থির থাকবে।
চালের দাম হ্রাসের পদক্ষেপও সুফল দেয় কি না, সংশয় রয়েছে। মাঠে এখন বোরো নিয়ে ব্যস্ত কৃষক। এটা আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন মৌসুম। চালের বাজারে অস্থিরতা চলাকালে বোরোর উৎপাদন কোনোভাবেই বিঘ্নিত হতে দেওয়া যাবে না। মাঝে খবর মিলেছিল, উপকরণনির্ভর এই মৌসুমের প্রয়োজনীয় সার সংগ্রহে জটিলতা চলছে।
বহুল আলোচিত ডলারের সংকটে সারের মতো জরুরি পণ্যের আমদানিও ব্যাহত বলে জানা গিয়েছিল। দেশে সার উৎপাদনের যে আয়োজন রয়েছে, তার সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখাও কঠিন। সেটা একাধিক কারণে। এর মধ্যে গ্যাসের সংকটও কম দায়ী নয়। পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় কখনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে সার কারখানায় গ্যাস জোগাতে হচ্ছে; কখনো একটি সার কারখানা বন্ধ করে চালু রাখতে হচ্ছে অন্যটি।
শীতে এবার গ্যাসের বিপর্যয়ও ঘটেছিল চট্টগ্রামসহ দেশের একাংশে। এমন একটা অংশে, যেখানে শিল্প-বাণিজ্য কেন্দ্রীভূত। বাসাবাড়িতেও গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। অনেকেই তখন শঙ্কা প্রকাশ করেন, গ্রীষ্মে না জানি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে! কেননা, ওই সময়ে বর্ধিত চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশি গ্যাস সরবরাহ করতে হয়। শিল্পেও বাড়ে চাহিদা। এ অবস্থায় খবর—দেশের ভেতর থেকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহতভাবে কমছে। বাড়ছে আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরতা।
ভালো যে, এলএনজির দাম অনেক কমে এসেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। মাঝে দাম এত বেড়েছিল যে, এলএনজি আমদানি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে হয় বেশ কিছুদিন। পরে দাম কমে এলেও ডলারের সংকটে আমদানি ছিল কঠিন। তারপর সম্প্রতি দুটি এলএনজি টার্মিনালই প্রায় একযোগে অকার্যকর হয়ে পড়লে ঘটে গ্যাস বিপর্যয়। শহরের দালানকোঠায়ও উঠে আসে কেরোসিনের চুলা; কোথাও কোথাও লাকড়ি!
আশা করে থাকব, রমজানে বিশেষত ইফতার ও সাহ্রির সময় এমন পরিস্থিতি ফিরে আসবে না। শিল্প, এমনকি রপ্তানিমুখী খাতে গ্যাসের সংকট আরও বেড়ে ওঠার শঙ্কা কিন্তু রয়েছে। ওষুধশিল্পেও আছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আবশ্যকতা। সম্প্রতি তারা নতুন করে ওষুধের দাম বাড়াতে ধরনা দিয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে। তাদের বক্তব্য হলো, ডলার-সংকটের সঙ্গে আরও কিছু কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ওষুধের দাম না বাড়ালে আর চলছে না। তারাও গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বাড়ানোর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। গেল বছরের শুরুতে টানা তিন মাস বিদ্যুতের দাম যখন ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়, তখন গ্যাসের দামও এক লাফে বাড়ানো হয়েছিল অনেক। দু-তিনটি ক্ষেত্রকে ছাড় দিয়ে শিল্প-বাণিজ্যে নজিরবিহীনভাবে এর দাম বাড়ানো হয়।
উদ্যোক্তারা সেটা মেনে নিয়েছিলেন এই দাবিতে যে, গ্যাস সরবরাহ তাহলে ‘নিরবচ্ছিন্ন’ রাখতে হবে! কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আসছে গ্রীষ্মে গ্যাসের সঙ্গে বিদ্যুতের সংকট বাড়বে বলেও প্রক্ষেপণ রয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বাড়ানোর পর অবশ্য বিদ্যুতের সংকট হওয়ার কথা নয়। বাস্তবতা হলো, চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর সক্ষমতার একটা বড় অংশ এবারও অব্যবহৃত থাকবে বলে মত রয়েছে। এ জন্য আবার গুনতে হবে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’। সরবরাহ বাড়াতে কিছু বিদ্যুৎ আমদানিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সে ক্ষেত্রেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট সক্ষমতা ব্যবহারে ব্যর্থ হলে ‘চার্জ’ পরিশোধের ঝক্কি। ক্যাপাসিটি চার্জ তাই হয়ে উঠেছে বড় আলোচনার বিষয়। এই বাবদ বিপুল ব্যয়ের বাধ্যবাধকতায় সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনাই শুধু এলোমেলো হচ্ছে না, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। এ কারণেও সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে যেতে হচ্ছে বলে অনেকের অভিমত।
সম্প্রতি রমজানের আগে নতুন করে বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কায় এর দাম ঈদের আগে না বাড়ানোর চিন্তা ছিল বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু অবস্থাটা এমন যে, সরকারকে দ্রুতই নিতে হচ্ছে এসব অপ্রিয় পদক্ষেপ। সিদ্ধান্ত বদলে ঘোষণার আগের মাস থেকেও করা হচ্ছে ‘মূল্য সমন্বয়’! অবশ্য এর জন্য তাকে আর ‘গণশুনানি’ মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। নির্বাহী আদেশেই এ ধরনের সেবার দাম বাড়ানোর সুযোগ করে নিয়েছে সরকার। কিন্তু তাতে সমালোচনা এড়ানো যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, চলমান মূল্যস্ফীতিতে এসব পদক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের শর্ত রয়েছে সরকারকে ঋণ জুগিয়ে যাওয়া আইএমএফের। সরকার নিজেও ভর্তুকির চাপ থেকে রেহাই চাইছে মনে হয়। এর আওতায় সারের দামও বাড়িয়েছে। এতে কৃষিতে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। চলমান বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে বিদ্যুতের দাম নতুন করে বাড়ায়। বৃহদায়তন সেচে বিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে। ছোট ও মাঝারি সেচযন্ত্র অবশ্য চলে ডিজেলে। ডিজেলসহ প্রায় সব জ্বালানি তেলের দামও মাঝে ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছিল।
তখন বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কমে এলে এগুলোর দাম দেশেও কমানো হবে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির দাম দ্রুত বাড়ার পর তা কিন্তু কমেও এসেছে। গেল বছর এর দাম গড়ে ১০ শতাংশ কম ছিল। এই নিবন্ধ লেখার সময় জ্বালানি তেলের দাম আরও কমে যাওয়ার খবর মিলল। আমাদের মতো জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এটি ইতিবাচক। তবে ডিজেলসহ জ্বালানির দাম কমাতে দেখা যাচ্ছে না সরকারকে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কমে আসার পরও দেশে জ্বালানির দাম না কমানোয় এর একচেটিয়া ব্যবসা করা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি নাকি এখন লাভে রয়েছে। কিন্তু জ্বালানির দাম না কমায় এর যে বহুমুখী সুফল পাওয়া যেত, তা মিলছে না। পরিবহন ও কৃষিতে ব্যয় কমত শুধু ডিজেলের দাম কমানো গেলে। সঙ্গে ফার্নেস অয়েলের দাম কমানো গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ব্যয় কমত। কিছুটা হলেও প্রভাব পড়ত মূল্যস্ফীতিতে।
সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে চাইছে না, তা তো নয়। সেই লক্ষ্য অর্জনে ঠিক যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, সেগুলোয় আঘাত হানতে হবে। এর একটা বড় জায়গা নিশ্চয় জ্বালানি তেলের দাম।
এই খাত থেকে সরকার উল্লেখযোগ্য হারে কর-শুল্কও আহরণ করে আসছে। এমন একটা পণ্য মূল্যস্ফীতিতে যার রয়েছে বিরাট প্রভাব, তাতে এত বেশি করারোপকে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই কিন্তু বলছেন ‘অযৌক্তিক’।
আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানির দাম নির্ধারণের এজেন্ডা বাস্তবায়নেও সরকার দেরি করছে। এটাও আইএমএফের শর্ত এবং সরকার নীতিগতভাবে একমত। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের নতুন এই পদ্ধতিতে যাওয়া গেলেও ইতিমধ্যে বিষয়টি কিছুটা সহনীয় হয়ে আসত। ক্যাপাসিটি চার্জের চক্র থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি ব্যয় হ্রাসের অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুতের দাম আর না বাড়ানোর অবস্থানে থাকাও সম্ভব বলে অনেকের মত।
গ্যাসের ক্ষেত্রেও এলএনজি-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এ ক্ষেত্রে ব্যয় এত বাড়ত না। এর দামও বাড়াতে হতো না বিপুলভাবে। সম্প্রতি গ্যাসের দাম আরও কিছুটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাসাবাড়িতে আর গ্যাসের সংযোগ না দেওয়ার নীতিতে আছে সরকার। কিন্তু শিল্পে সংযোগ দিতে হবে আর সরবরাহ রাখতে হবে অব্যাহত। নইলে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হয়ে কর্মসংস্থান, এমনকি রপ্তানি কমবে। দেশেও শিল্পপণ্যের সরবরাহ কমবে; বাড়বে দাম।
এমনিতেই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কাঁচামাল ও পুঁজিপণ্য আমদানি কমে যাওয়ায়। এর পেছনেও আছে ডলারের সংকট। সরকার খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানি নির্বিঘ্ন রাখতে আর সব পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের পথে আছে এখনো। এর প্রভাবে অর্থনীতি গতি হারালে সরকার রাজস্বই বা পাবে কোত্থেকে? প্রশাসন পরিচালনার বিপুল ব্যয় জোগানোও তখন কঠিন হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থ জোগানো তো পরে!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
শবে বরাত থেকেই রমজানের আমেজ শুরু হয়ে যায় দেশে এবং এর অর্থনীতি চাঙা হতে থাকে। মিডিয়ায় খবর—মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে রমজান সামনে রেখে কয়েকটি পণ্যের দামে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর সিংহভাগই নিত্যপণ্য। আর দেশে খবর হলো, শুল্ক ছাড় দেওয়ার পরও বাড়ার প্রবণতা চিনির দামে! এর আগেও চিনির দাম কমাতে এই ধারার পদক্ষেপ নেয় সরকার। তাতেও দাম কমেনি বা থেকেছে ‘উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল’।
চিনির দাম কমাতে আরও আগে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল এবং আরও বেশি শুল্ক ছাড় দেওয়া দরকার বলে সমালোচনা রয়েছে অবশ্য। বেশি শুল্ক ছাড় দিয়ে সুফল না পাওয়ার উদাহরণও কম নেই। আশঙ্কা, রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার এবার আগের মতোই অস্থির থাকবে।
চালের দাম হ্রাসের পদক্ষেপও সুফল দেয় কি না, সংশয় রয়েছে। মাঠে এখন বোরো নিয়ে ব্যস্ত কৃষক। এটা আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন মৌসুম। চালের বাজারে অস্থিরতা চলাকালে বোরোর উৎপাদন কোনোভাবেই বিঘ্নিত হতে দেওয়া যাবে না। মাঝে খবর মিলেছিল, উপকরণনির্ভর এই মৌসুমের প্রয়োজনীয় সার সংগ্রহে জটিলতা চলছে।
বহুল আলোচিত ডলারের সংকটে সারের মতো জরুরি পণ্যের আমদানিও ব্যাহত বলে জানা গিয়েছিল। দেশে সার উৎপাদনের যে আয়োজন রয়েছে, তার সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখাও কঠিন। সেটা একাধিক কারণে। এর মধ্যে গ্যাসের সংকটও কম দায়ী নয়। পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় কখনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে সার কারখানায় গ্যাস জোগাতে হচ্ছে; কখনো একটি সার কারখানা বন্ধ করে চালু রাখতে হচ্ছে অন্যটি।
শীতে এবার গ্যাসের বিপর্যয়ও ঘটেছিল চট্টগ্রামসহ দেশের একাংশে। এমন একটা অংশে, যেখানে শিল্প-বাণিজ্য কেন্দ্রীভূত। বাসাবাড়িতেও গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। অনেকেই তখন শঙ্কা প্রকাশ করেন, গ্রীষ্মে না জানি পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে! কেননা, ওই সময়ে বর্ধিত চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশি গ্যাস সরবরাহ করতে হয়। শিল্পেও বাড়ে চাহিদা। এ অবস্থায় খবর—দেশের ভেতর থেকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহতভাবে কমছে। বাড়ছে আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরতা।
ভালো যে, এলএনজির দাম অনেক কমে এসেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। মাঝে দাম এত বেড়েছিল যে, এলএনজি আমদানি ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে হয় বেশ কিছুদিন। পরে দাম কমে এলেও ডলারের সংকটে আমদানি ছিল কঠিন। তারপর সম্প্রতি দুটি এলএনজি টার্মিনালই প্রায় একযোগে অকার্যকর হয়ে পড়লে ঘটে গ্যাস বিপর্যয়। শহরের দালানকোঠায়ও উঠে আসে কেরোসিনের চুলা; কোথাও কোথাও লাকড়ি!
আশা করে থাকব, রমজানে বিশেষত ইফতার ও সাহ্রির সময় এমন পরিস্থিতি ফিরে আসবে না। শিল্প, এমনকি রপ্তানিমুখী খাতে গ্যাসের সংকট আরও বেড়ে ওঠার শঙ্কা কিন্তু রয়েছে। ওষুধশিল্পেও আছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আবশ্যকতা। সম্প্রতি তারা নতুন করে ওষুধের দাম বাড়াতে ধরনা দিয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে। তাদের বক্তব্য হলো, ডলার-সংকটের সঙ্গে আরও কিছু কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ওষুধের দাম না বাড়ালে আর চলছে না। তারাও গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বাড়ানোর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। গেল বছরের শুরুতে টানা তিন মাস বিদ্যুতের দাম যখন ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়, তখন গ্যাসের দামও এক লাফে বাড়ানো হয়েছিল অনেক। দু-তিনটি ক্ষেত্রকে ছাড় দিয়ে শিল্প-বাণিজ্যে নজিরবিহীনভাবে এর দাম বাড়ানো হয়।
উদ্যোক্তারা সেটা মেনে নিয়েছিলেন এই দাবিতে যে, গ্যাস সরবরাহ তাহলে ‘নিরবচ্ছিন্ন’ রাখতে হবে! কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আসছে গ্রীষ্মে গ্যাসের সঙ্গে বিদ্যুতের সংকট বাড়বে বলেও প্রক্ষেপণ রয়েছে। উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বাড়ানোর পর অবশ্য বিদ্যুতের সংকট হওয়ার কথা নয়। বাস্তবতা হলো, চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর সক্ষমতার একটা বড় অংশ এবারও অব্যবহৃত থাকবে বলে মত রয়েছে। এ জন্য আবার গুনতে হবে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’। সরবরাহ বাড়াতে কিছু বিদ্যুৎ আমদানিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সে ক্ষেত্রেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট সক্ষমতা ব্যবহারে ব্যর্থ হলে ‘চার্জ’ পরিশোধের ঝক্কি। ক্যাপাসিটি চার্জ তাই হয়ে উঠেছে বড় আলোচনার বিষয়। এই বাবদ বিপুল ব্যয়ের বাধ্যবাধকতায় সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনাই শুধু এলোমেলো হচ্ছে না, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। এ কারণেও সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে যেতে হচ্ছে বলে অনেকের অভিমত।
সম্প্রতি রমজানের আগে নতুন করে বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কায় এর দাম ঈদের আগে না বাড়ানোর চিন্তা ছিল বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু অবস্থাটা এমন যে, সরকারকে দ্রুতই নিতে হচ্ছে এসব অপ্রিয় পদক্ষেপ। সিদ্ধান্ত বদলে ঘোষণার আগের মাস থেকেও করা হচ্ছে ‘মূল্য সমন্বয়’! অবশ্য এর জন্য তাকে আর ‘গণশুনানি’ মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। নির্বাহী আদেশেই এ ধরনের সেবার দাম বাড়ানোর সুযোগ করে নিয়েছে সরকার। কিন্তু তাতে সমালোচনা এড়ানো যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, চলমান মূল্যস্ফীতিতে এসব পদক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের শর্ত রয়েছে সরকারকে ঋণ জুগিয়ে যাওয়া আইএমএফের। সরকার নিজেও ভর্তুকির চাপ থেকে রেহাই চাইছে মনে হয়। এর আওতায় সারের দামও বাড়িয়েছে। এতে কৃষিতে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। চলমান বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে বিদ্যুতের দাম নতুন করে বাড়ায়। বৃহদায়তন সেচে বিদ্যুতের ব্যবহার রয়েছে। ছোট ও মাঝারি সেচযন্ত্র অবশ্য চলে ডিজেলে। ডিজেলসহ প্রায় সব জ্বালানি তেলের দামও মাঝে ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছিল।
তখন বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কমে এলে এগুলোর দাম দেশেও কমানো হবে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির দাম দ্রুত বাড়ার পর তা কিন্তু কমেও এসেছে। গেল বছর এর দাম গড়ে ১০ শতাংশ কম ছিল। এই নিবন্ধ লেখার সময় জ্বালানি তেলের দাম আরও কমে যাওয়ার খবর মিলল। আমাদের মতো জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এটি ইতিবাচক। তবে ডিজেলসহ জ্বালানির দাম কমাতে দেখা যাচ্ছে না সরকারকে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কমে আসার পরও দেশে জ্বালানির দাম না কমানোয় এর একচেটিয়া ব্যবসা করা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি নাকি এখন লাভে রয়েছে। কিন্তু জ্বালানির দাম না কমায় এর যে বহুমুখী সুফল পাওয়া যেত, তা মিলছে না। পরিবহন ও কৃষিতে ব্যয় কমত শুধু ডিজেলের দাম কমানো গেলে। সঙ্গে ফার্নেস অয়েলের দাম কমানো গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ব্যয় কমত। কিছুটা হলেও প্রভাব পড়ত মূল্যস্ফীতিতে।
সরকার মূল্যস্ফীতি কমাতে চাইছে না, তা তো নয়। সেই লক্ষ্য অর্জনে ঠিক যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, সেগুলোয় আঘাত হানতে হবে। এর একটা বড় জায়গা নিশ্চয় জ্বালানি তেলের দাম।
এই খাত থেকে সরকার উল্লেখযোগ্য হারে কর-শুল্কও আহরণ করে আসছে। এমন একটা পণ্য মূল্যস্ফীতিতে যার রয়েছে বিরাট প্রভাব, তাতে এত বেশি করারোপকে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই কিন্তু বলছেন ‘অযৌক্তিক’।
আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানির দাম নির্ধারণের এজেন্ডা বাস্তবায়নেও সরকার দেরি করছে। এটাও আইএমএফের শর্ত এবং সরকার নীতিগতভাবে একমত। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের নতুন এই পদ্ধতিতে যাওয়া গেলেও ইতিমধ্যে বিষয়টি কিছুটা সহনীয় হয়ে আসত। ক্যাপাসিটি চার্জের চক্র থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি ব্যয় হ্রাসের অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুতের দাম আর না বাড়ানোর অবস্থানে থাকাও সম্ভব বলে অনেকের মত।
গ্যাসের ক্ষেত্রেও এলএনজি-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এ ক্ষেত্রে ব্যয় এত বাড়ত না। এর দামও বাড়াতে হতো না বিপুলভাবে। সম্প্রতি গ্যাসের দাম আরও কিছুটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাসাবাড়িতে আর গ্যাসের সংযোগ না দেওয়ার নীতিতে আছে সরকার। কিন্তু শিল্পে সংযোগ দিতে হবে আর সরবরাহ রাখতে হবে অব্যাহত। নইলে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হয়ে কর্মসংস্থান, এমনকি রপ্তানি কমবে। দেশেও শিল্পপণ্যের সরবরাহ কমবে; বাড়বে দাম।
এমনিতেই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কাঁচামাল ও পুঁজিপণ্য আমদানি কমে যাওয়ায়। এর পেছনেও আছে ডলারের সংকট। সরকার খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানি নির্বিঘ্ন রাখতে আর সব পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের পথে আছে এখনো। এর প্রভাবে অর্থনীতি গতি হারালে সরকার রাজস্বই বা পাবে কোত্থেকে? প্রশাসন পরিচালনার বিপুল ব্যয় জোগানোও তখন কঠিন হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অর্থ জোগানো তো পরে!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে