আমরা আয়েশি প্রকল্প নিচ্ছি না

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০৭: ০৪
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০৯: ৪১

বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে জড়িয়ে ভীতিকর পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। আর পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম মনে করেন, অর্থনৈতিক বিচারে নয়, রাজনৈতিক কারণে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মেলানো হচ্ছে। তাঁরা দুজনই শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব বিতর্ক হচ্ছে, তার জবাবে আজকের পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে এসব মন্তব্য করেন।

বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগ দিয়েছে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বেশ কিছু ব্যয়বহুল প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর বাইরেও দেশব্যাপী সরকারের অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে নিজস্ব উৎসের পাশাপাশি সরকার বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বার্ষিক নিট বিদেশি ঋণ গ্রহণের (গৃহীত ঋণ থেকে পরিশোধ বাদ দিয়ে) পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটে বার্ষিক নিট বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রাক্কলন রয়েছে ৯৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার। গত অর্থবছরেও এর পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৪১০ কোটি টাকা।

বিদেশি ঋণ সাধারণত সবচেয়ে বেশি খরচ হয় মেগা প্রকল্পে। এসব প্রকল্পের কারণে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বাড়ে। ঋণগুলো দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় ও দাতা সংস্থার ঋণ, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট ও লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় নিয়ে থাকে সরকার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এত ঋণ কী আসলেই বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ? আর প্রকল্পগুলোই-বা কতটা লাভজনক? এসব বিষয়েই মূলত কথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘দেখতে হবে ঋণ করে আমরা টাকা ওড়াচ্ছি কি না, অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করছি কি না, ঘি খাচ্ছি কি না? এটা থেকে সমাজ, অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে না, দারিদ্র্য কমছে না—সে রকম তো হচ্ছে না। সার্বিক বিচারে আমাদের অবস্থা ভালো। আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদন, সেটা তুলনা করলে আমাদের ঋণের যে পরিমাণ, তা এখনো কম। আমরা যেসব কাজে টাকা ব্যয় করছি, প্রতিটা জনসম্পৃক্ত প্রকল্প।’ তিনি বলেন, ‘এগুলো আমাদের আরাম-আয়েশের প্রকল্প নয়। আমরা যদি তাজমহল বানাতাম, সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন—তাহলে একটা কথা ছিল। আমরা তো সেটা করছি না। আমরা রেললাইন বানাচ্ছি, সড়ক তৈরি করছি, সেতু বানাচ্ছি, স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বানাচ্ছি, হাসপাতাল নির্মাণ করছি।’ পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি না শ্রীলঙ্কা খাদে পড়ে গেছে। এটা তাদের সাময়িক অসুবিধা। তারা যদি কোমর বেঁধে নেমে পড়ে, সাবধান হয়, তাহলে অনেক দেশ ও সংস্থা তাদের সহায়তা করবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকেরও দায়িত্ব আছে। যেহেতু শ্রীলঙ্কার বিশ্বব্যবস্থার অংশ, তাই আমরাও তাদের অংশ। সুতরাং বিষয়টিকে এভাবে দেখা উচিত।’ তিনি ঋণ পরিশোধের বিষয়ে বলেন, ‘আমরা সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধ করছি। আমরা কখনো বলি না যে, আমাদের ঋণ পরিশোধে দুই মাস বেশি সময় দেন। আমাদের কয়েক মাসের বৈদেশিক বাণিজ্য বিল পরিশোধ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। সাধারণত দেড় মাসের থাকলেই অর্থনীতিবিদেরা বলেন এটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা। আমাদের শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে বলার কী আছে? একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।’

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের যে সামর্থ্য আছে, আগামী ৯ মাস আমদানি করলেও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি হবে না। এ সময়ে যদি আমাদের নতুন রিজার্ভ যোগ নাও হয়, তাতেও সমস্যা হবে না।’ পুরো বিষয়টির সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িয়ে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে এখানে একটা রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। রাজনৈতিক অর্থনীতিটা হলো–আমাদের কিছু কিছু অর্থনীতিবিদ আছেন, তাঁরা অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়েও রাজনৈতিক বিবেচনাকে গুরুত্ব দেন। তাঁরা সুযোগমতো কিছু কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসেন। একটা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক যেন তৈরি হয়—এটাই তাঁদের উদ্দেশ্য। যে অর্থনীতিবিদেরা শ্রীলঙ্কাকে দেখে শিক্ষা নিতে বলেন, এটা বাহুল্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। আমাদের অর্থনীতি ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। আর তাদের ৮৩ বিলিয়ন ডলার।’

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হলেও প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করা হয়। একেবারেই বাছবিচারহীনভাবে প্রকল্প নেওয়া হয় না। পদ্মা সেতু অর্থনীতির জন্যই প্রয়োজন। এটা জানার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার নেই। সুতরাং যাঁরা বলেন, তাঁরা সবাই অর্থনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেন তা নয়; এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছুই যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন আরেকটি বাসন্তী সাজানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচন সামনে রেখে এ রকম নানান ইস্যু সামনে এনে জন-অতৃপ্তি তৈরি করার অপচেষ্টা এগুলো।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত