মেয়র বিল্লালের রাজত্ব, কামিয়েছেন শতকোটি

ইলিয়াস আহমেদ, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০: ৩৩
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০: ৩৮

আশির দশকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন ঘানিশ্রমিক। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার বিল্লাল হোসেন সরকার। প্রথমে যুবলীগ; এরপর ২০০৫ সালে নির্বাচিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলীয় পদ পেয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বিল্লাল। উপজেলাজুড়ে চলে তাঁর দখলদারি, চাঁদাবাজি ও নিয়োগ-বাণিজ্য। মতের অমিল হলেই মামলা-হামলা দিয়ে হয়রানি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন এসব নিয়ে তথ্য দিচ্ছেন স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা।

সবশেষ দলীয় প্রতীকে ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি মুক্তগাছা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন বিল্লাল। অভিযোগ রয়েছে, এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। শহরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। রাজধানী ও ময়মনসিংহ শহরেও রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। কানাডাপ্রবাসী মেজ মেয়ে সনিয়া সরকারকে সেখানে বাড়ি কিনে দিয়েছেন বলেও এলাকায় প্রচার রয়েছে।

স্থানীয় ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৬ বছরে ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে দুবার আওয়ামী লীগ, একবার জাতীয় পার্টি এবং সবশেষ কৃষক লীগ নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কে এম খালিদ। খালিদের দুই মেয়াদে উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় একক আধিপত্য বিস্তার করেন বিল্লাল। তাঁর নেতৃত্বেই স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি গঠন, নিয়োগ, দখলদারি ও চাঁদাবাজি হতো। আর এসব করে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কে এম খালিদ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বিল্লাল। ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে নিজে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি মেয়ের জামাতা মাহবুবুল আলম মনিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করান। পান থেকে চুন খসলেই ভিন্ন আদর্শের মানুষের ওপর চলত বিল্লাল বাহিনীর নির্যাতন এবং মামলা দিয়ে হয়রানি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কিছুদিন আগে পৌরসভার দোকান বরাদ্দ ও ১১টি পদে নিয়োগ দিয়ে ৮-১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিল্লালের বিরুদ্ধে।

পৌরসভা সূত্র বলছে, পৌরসভার তত্ত্বাবধানে নির্মিত দোতলা পৌর শপিং কমপ্লেক্সের ৫৬টি দোকান বরাদ্দ দিয়ে ৪-৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বিল্লাল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে তিনি গা ঢাকা দেওয়ায় দুজন ব্যবসায়ী তাঁর নামে আদালতে মামলা করেছেন।

মামলার বাদী আল আমিন বলেন, ‘মার্কেটে আমার পুরোনো দুটি দোকান আগে থেকেই ছিল। ওই পুরোনো দুই দোকান এবং নতুন একটি নিয়ে আমরা দুই ভাই বিল্লালকে ২৯ লাখ টাকা দিয়েছি। আমাদের কাছে টাকা দেওয়ার রসিদও রয়েছে। টাকা পাওয়ার অনিশ্চয়তা দেখে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছি। গত ২৭ আগস্ট আমি এবং আব্দুর রশিদ নামের আরেক ব্যবসায়ী পৃথক দুটি মামলা করি। কিন্তু মার্কেটে “ইহা সরকারি সম্পত্তি”—সম্প্রতি এমন একটি সাইনবোর্ড টানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।’

পৌরসভার বাজার পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, দোকান পাওয়ার আশায় প্রত্যেক ব্যবসায়ী সাবেক মেয়র বিল্লালকে ১ থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। এই টাকা মেয়র ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। সম্প্রতি মার্কেটের জায়গা নিয়ে একটি মামলা হওয়ায় সেখানে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। 

পারিবারিক ‘লীগ’ প্রতিষ্ঠা
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে নিজের পাল্লা ভারী করতে বিল্লাল বড় মেয়ের জামাতা ছাত্রদল নেতা মাহবুবুল আলম মনিকে যুবলীগে প্রবেশ করান। মনি যুবলীগে প্রবেশ করে শ্বশুরের ছত্রচ্ছায়ায় অটোরিকশা ও টেম্পো থেকে চাঁদাবাজি, চিকিৎসককে মারধর, যুবলীগ নেতা আসাদ হত্যাসহ নানা অপকর্মের নেতৃত্ব দেন। শ্বশুরের কল্যাণে প্রায় চার বছর আগে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হন। গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্যও হন মনি। এ ছাড়া বিল্লাল তাঁর ভাই, ভাতিজা ও নিজ বলয়ের লোকজনকে আওয়ামী এবং সহযোগী সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন।

নামে-বেনামে যত সম্পত্তি
মুক্তাগাছায় বিল্লালের নামে-বেনামে জায়গাজমি রয়েছে। শহরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। নিজস্ব জায়গায় রয়েছে মুন সিনেমা হল, মৎস্য প্রজেক্টসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে কয়েক একর জমি। ময়মনসিংহ শহরের নতুন বাজারে রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ঢাকার গুলশানে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট।

শিক্ষক আজহার উদ্দিন বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যতগুলো নিয়োগ, কমিটি হয়েছে, বেশির ভাগ বিল্লাল সরকারের বাসায় বসে হয়েছে। খালিদ মুক্তাগাছার মানুষ না হওয়ায় সব দায়িত্ব পালন করতেন বিল্লাল। আর এসব করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই তিনি শতকোটি টাকা কামিয়েছেন। দুদক বিষয়টি তদন্ত করলে তার শতভাগ প্রমাণ পাবে।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাই আকন্দ বলেন, ‘বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিল্লাল দুর্নীতি করেছেন। এটি সবাই জানে। দোকান বরাদ্দের নামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টিও আমি শুনেছি।’

এদিকে ৫ আগস্ট থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন বিল্লাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এ বিষয়ে জানতে তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত