ড. জাহিদ হোসেন
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত উন্নয়নের পথে যত দূর এগিয়েছে, তাতে দেখা যায়, আমাদের দারিদ্র্যের হার কমেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও অনেক অর্জন রয়েছে। এসব অর্জনের পেছনে যে উপাদানগুলো সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, সেগুলোর মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
একটা হলো, শুরুতেই আমরা ছিলাম একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, তারপর ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ এল। আশির দশকের শুরুর দিকে প্রথম যে সমস্যাটা সামনে এল, সেটা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তখন জনসংখ্যা প্রায় ৩ শতাংশ হারে বাড়ছিল এবং মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। তখন বছরে একটামাত্র ধান উৎপাদিত হতো; অর্থাৎ চালের জন্য একটাই ছিল ফসল।
ওই সময় অনেকে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ব্যাপকভাবে এল। সে সময় অবশ্য ভারতেও এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। তাতে আমরা বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি।
এরপর এ দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি উন্মুক্ত করা হলো। শুধু বহিঃখাত নয়, অভ্যন্তরীণ খাতও। কৃষি খাতের ইনপুট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, যেটা একেবারে বিএডিসির অধীনে ছিল, সেটাকে বিএডিসি থেকে বের করে সার ও সেচের যন্ত্রপাতি হ্যান্ড টিউবওয়েল, শ্যালো টিউবওয়েল, পেস্টিসাইড বীজ—এগুলোর যে বিতরণব্যবস্থা, তাতে বেসরকারি খাতকে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হলো। এটা সবুজবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির রূপান্তরে একটা বড় অবদান রেখেছে। আর আমাদের উন্নয়নের পথযাত্রাটা ওখান থেকেই শুরু। কৃষির উদ্বৃত্ত তখন অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করা শুরু হয়।
এই উন্মুক্তকরণের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে কৃষির বাইরে গেছে। আশির দশকের মাঝামাঝি এসে শিল্প খাতে গার্মেন্টসের আগমন ঘটে, সেখানে ব্যক্তি খাতের একটা নতুন জায়গা তৈরি হয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সেখানে উচ্চপর্যায়ের আমদানিকে উদারীকরণ করা হলো। তারপর আর্থিক খাত খুলে দেওয়া হলো। এর আগে আর্থিক খাত অনেকটাই সরকারনির্ভর ছিল। সেখানে ব্যক্তিমালিকানায় ব্যাংকিংয়ে আসার দুয়ার খোলার সঙ্গে সঙ্গে সুদের হারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দেওয়া হলো। এক্সচেঞ্জ রেট তখনো বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু একেবারে যে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা, সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম।
ফরেন এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোলস যেগুলো ছিল, সেসব উঠিয়ে দেওয়া হলো একসময়। এটা আরেক ধরনের উন্মুক্তকরণ। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে জ্বালানি খাতকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিদেশি বিনিয়োগ এল জ্বালানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে। আইপিপিতে আবির্ভাব তখন আমরা দেখেছি। এরপর ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে যেসব বিধিনিষেধের সীমাবদ্ধতা ছিল, সেগুলো সবই চলে গেল। এই উন্মুক্তকরণ দ্বিতীয় উপকরণ হিসেবে কাজ করেছে।
তৃতীয় যেটা বড় বিষয় ছিল, সেটা হলো অবকাঠামোর ক্ষেত্রে। সেখানে আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছে গ্রামীণ রাস্তা এবং গ্রামের বিদ্যুতায়নের অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে। গ্রামীণ অর্থনীতি বলতে আগে যেটা বোঝাত, সেটা হলো কৃষি অর্থনীতি। কৃষি অর্থনীতির ভেতরে যেটা ছিল, তা হলো চালের অর্থনীতি। চাল উৎপাদনটাই ছিল কৃষির প্রধান কর্মকাণ্ড। এটা থেকে কৃষিটাকে বহির্মুখী করা হয়।
একটা ছিল চালের আবাদ মৌসুমকে ছোট করা, যাতে আরও বেশি চাষ করা যায়। তারপর শাকসবজি, ফল চাষাবাদে জমিকে ব্যবহার করা শুরু হয়। আবার মুরগি, গরু, ছাগলের খামারগুলো অর্থাৎ পশুপালন শুরু হয় বড় আকারে। এখানে অবশ্য ক্ষুদ্রঋণের অবদানও অস্বীকার করা যাবে না।
ক্ষুদ্রঋণের আবির্ভাবের ফলে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা এসব কাজ বাসার ভেতরে থেকেই করতে পেরেছেন। সেখানে পল্লি খামারভিত্তিক আয়ের বহুমুখী ব্যবহার আবার খামারের বাইরে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডভিত্তিক অন্যান্য আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। যেমন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ রিকশা কিনল অথবা একটা চায়ের দোকান দিল। এ রকম নানা ব্যবসা গড়ে উঠতে থাকে।
একদিকে বিদ্যুতায়ন বা বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, অন্যদিকে বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ, যেটা গ্রামীণ রাস্তা বা অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে হয়েছে। আন্তজেলা সংযোগ বা মহাসড়কের উন্নয়নেও আমরা বেশ কিছু সরকারি বিনিয়োগ দেখেছি। এর একটি উদাহরণ হলো বঙ্গবন্ধু সেতু। আগে আমরা যখন রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসতাম, তখন তিনটি ফেরি পার হতে হতো, অনেক সময় ওখানে চলে যেত। তবে পরে অবকাঠামোতে আমরা কিছু স্থবিরতা দেখেছি।
২০০৯-১০ সালের পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। ২০০৬ সালে সংকটের এমন এক রূপ ছিল, যখন অনেকে বলতেন—বিদ্যুৎ যায় না, বিদ্যুৎ আসে। আসাটাই তখন ছিল অস্বাভাবিক ব্যাপার। এবার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলো। এটি অবকাঠামো উন্নয়নের আরেক মাইলফলক।
মানবসম্পদ উন্নয়নেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এ দেশের অভিভাবকেরা সব সময় শিশুদের স্কুলে দিতে খুবই আগ্রহী থাকেন। কিন্তু স্কুলিংয়ের জন্য একটা কাঠামো লাগে, একটা ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়—সেটির অভাব ছিল। ১৯৯১ সালের পর বাংলাদেশ যখন সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রমে স্বাক্ষর করল এবং গণসাক্ষরতা অভিযানে নামল, তখন সাক্ষরতার হারে উন্নতি দেখতে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসার জন্য ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে পরীক্ষামূলকভাবে পাইলট বেসিসে বৃত্তি দেওয়া শুরু হয়েছিল। পরে এর সাফল্য দেখে সব সরকারই একে আরও এগিয়ে নিয়েছে। এর ফলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ, যেমন বাজেটে বরাদ্দ এবং শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা কার্যক্রম সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ায় একটি বড় কাজ হয়েছে। এখন বাচ্চাদের প্রায় সবাই স্কুলে আসে অর্থাৎ তাদের আমরা স্কুলে আনতে পেরেছি। সেখানে শিক্ষার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু এই যে স্কুলে আসছে, এটা মনে হয় আমাদের ৫০ বছরের যে অর্জন, তার প্রধান উপকরণ হিসেবে রয়েছে।
সবশেষে আসে ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্ট স্ট্যাবিলিটি বা সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো দেশের বাজেট ঘাটতি বাড়ে এবং রিজার্ভ কমে যায়। বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেয়। এ রকম কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশের ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ গত ৫০ বছরে আমাদের ঋণ জিডিপির অনুপাত ৪০-এর ওপরে ওঠেনি। এই স্থিতিশীলতা ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য বড় ব্যাপার। এটি পূর্বশর্তের মতো কাজ করে। এটি না থাকলে কিছু হবে না ঠিকই, কিন্তু থাকলেই যে হবে—তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এটি থাকা জরুরি।
সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা থাকলে, এর পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়া হলে সেগুলো কাজ করবে। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতি যদি অস্থির হয়ে যায়, তখন দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ যতই ভালো হোক না কেন, সেটা কাজে আসবে না। উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার কথা বলা যায়। অবকাঠামোয় বাংলাদেশের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক উন্নত। শ্রীলঙ্কার শ্রমশক্তিতে আমাদের চেয়ে অনেক উচ্চপর্যায়ের দক্ষতা আছে। কিন্তু যখন সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ে, তখন অন্য সবকিছুই বিকল হয়ে যায়। আমি মনে করি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, উন্মুক্তকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্কুলিং, স্থিতিশীলতা—এই পাঁচটিই বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনের পেছনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হলো ম্যাক্রো বা সামষ্টিকের ক্ষেত্রে। এই স্থিতিশীলতা এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদিও এটা অনেকটা আন্তর্জাতিক কারণে। তবে পুরোটাই আন্তর্জাতিক কারণে নয়। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের যে সংকট চলছে, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বাজেট ঘাটতি অত বড় বিষয় নয়। যদি টেকসইয়ের দিক থেকে চিন্তা করা হয়, আমরা কি আমাদের ঋণ সক্ষমতার চেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করে ফেলেছি? বা ঘাটতি যদি বাড়ে, তাহলে কি ওই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে? আমার মনে হয়, আমরা এখনো ওই পর্যায়ে যাইনি। কিন্তু বাজেট ঘাটতি এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে; কারণ, এটা মূল্যস্ফীতির ওপর এবং মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। সে জন্য একে সংযত পর্যায়ে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্টকে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, এভাবে নিয়ন্ত্রণ করে একে স্থিতিশীল করা যাবে না। কাজেই মূল্যস্ফীতি, বহির্বাণিজ্যের ঘাটতি এবং বিনিময় হারের ভারসাম্য আমরা যত তাড়াতাড়ি নিশ্চিত করতে পারব, তত তাড়াতাড়ি সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা গড়ে তোলা যাবে।
লেখক: সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত উন্নয়নের পথে যত দূর এগিয়েছে, তাতে দেখা যায়, আমাদের দারিদ্র্যের হার কমেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও অনেক অর্জন রয়েছে। এসব অর্জনের পেছনে যে উপাদানগুলো সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, সেগুলোর মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
একটা হলো, শুরুতেই আমরা ছিলাম একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, তারপর ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ এল। আশির দশকের শুরুর দিকে প্রথম যে সমস্যাটা সামনে এল, সেটা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তখন জনসংখ্যা প্রায় ৩ শতাংশ হারে বাড়ছিল এবং মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। তখন বছরে একটামাত্র ধান উৎপাদিত হতো; অর্থাৎ চালের জন্য একটাই ছিল ফসল।
ওই সময় অনেকে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ব্যাপকভাবে এল। সে সময় অবশ্য ভারতেও এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। তাতে আমরা বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি।
এরপর এ দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি উন্মুক্ত করা হলো। শুধু বহিঃখাত নয়, অভ্যন্তরীণ খাতও। কৃষি খাতের ইনপুট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, যেটা একেবারে বিএডিসির অধীনে ছিল, সেটাকে বিএডিসি থেকে বের করে সার ও সেচের যন্ত্রপাতি হ্যান্ড টিউবওয়েল, শ্যালো টিউবওয়েল, পেস্টিসাইড বীজ—এগুলোর যে বিতরণব্যবস্থা, তাতে বেসরকারি খাতকে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হলো। এটা সবুজবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির রূপান্তরে একটা বড় অবদান রেখেছে। আর আমাদের উন্নয়নের পথযাত্রাটা ওখান থেকেই শুরু। কৃষির উদ্বৃত্ত তখন অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করা শুরু হয়।
এই উন্মুক্তকরণের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে কৃষির বাইরে গেছে। আশির দশকের মাঝামাঝি এসে শিল্প খাতে গার্মেন্টসের আগমন ঘটে, সেখানে ব্যক্তি খাতের একটা নতুন জায়গা তৈরি হয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সেখানে উচ্চপর্যায়ের আমদানিকে উদারীকরণ করা হলো। তারপর আর্থিক খাত খুলে দেওয়া হলো। এর আগে আর্থিক খাত অনেকটাই সরকারনির্ভর ছিল। সেখানে ব্যক্তিমালিকানায় ব্যাংকিংয়ে আসার দুয়ার খোলার সঙ্গে সঙ্গে সুদের হারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দেওয়া হলো। এক্সচেঞ্জ রেট তখনো বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু একেবারে যে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা, সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম।
ফরেন এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোলস যেগুলো ছিল, সেসব উঠিয়ে দেওয়া হলো একসময়। এটা আরেক ধরনের উন্মুক্তকরণ। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এসে জ্বালানি খাতকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিদেশি বিনিয়োগ এল জ্বালানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে। আইপিপিতে আবির্ভাব তখন আমরা দেখেছি। এরপর ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে যেসব বিধিনিষেধের সীমাবদ্ধতা ছিল, সেগুলো সবই চলে গেল। এই উন্মুক্তকরণ দ্বিতীয় উপকরণ হিসেবে কাজ করেছে।
তৃতীয় যেটা বড় বিষয় ছিল, সেটা হলো অবকাঠামোর ক্ষেত্রে। সেখানে আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছে গ্রামীণ রাস্তা এবং গ্রামের বিদ্যুতায়নের অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে। গ্রামীণ অর্থনীতি বলতে আগে যেটা বোঝাত, সেটা হলো কৃষি অর্থনীতি। কৃষি অর্থনীতির ভেতরে যেটা ছিল, তা হলো চালের অর্থনীতি। চাল উৎপাদনটাই ছিল কৃষির প্রধান কর্মকাণ্ড। এটা থেকে কৃষিটাকে বহির্মুখী করা হয়।
একটা ছিল চালের আবাদ মৌসুমকে ছোট করা, যাতে আরও বেশি চাষ করা যায়। তারপর শাকসবজি, ফল চাষাবাদে জমিকে ব্যবহার করা শুরু হয়। আবার মুরগি, গরু, ছাগলের খামারগুলো অর্থাৎ পশুপালন শুরু হয় বড় আকারে। এখানে অবশ্য ক্ষুদ্রঋণের অবদানও অস্বীকার করা যাবে না।
ক্ষুদ্রঋণের আবির্ভাবের ফলে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা এসব কাজ বাসার ভেতরে থেকেই করতে পেরেছেন। সেখানে পল্লি খামারভিত্তিক আয়ের বহুমুখী ব্যবহার আবার খামারের বাইরে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডভিত্তিক অন্যান্য আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। যেমন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ রিকশা কিনল অথবা একটা চায়ের দোকান দিল। এ রকম নানা ব্যবসা গড়ে উঠতে থাকে।
একদিকে বিদ্যুতায়ন বা বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, অন্যদিকে বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ, যেটা গ্রামীণ রাস্তা বা অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে হয়েছে। আন্তজেলা সংযোগ বা মহাসড়কের উন্নয়নেও আমরা বেশ কিছু সরকারি বিনিয়োগ দেখেছি। এর একটি উদাহরণ হলো বঙ্গবন্ধু সেতু। আগে আমরা যখন রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসতাম, তখন তিনটি ফেরি পার হতে হতো, অনেক সময় ওখানে চলে যেত। তবে পরে অবকাঠামোতে আমরা কিছু স্থবিরতা দেখেছি।
২০০৯-১০ সালের পরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। ২০০৬ সালে সংকটের এমন এক রূপ ছিল, যখন অনেকে বলতেন—বিদ্যুৎ যায় না, বিদ্যুৎ আসে। আসাটাই তখন ছিল অস্বাভাবিক ব্যাপার। এবার পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলো। এটি অবকাঠামো উন্নয়নের আরেক মাইলফলক।
মানবসম্পদ উন্নয়নেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এ দেশের অভিভাবকেরা সব সময় শিশুদের স্কুলে দিতে খুবই আগ্রহী থাকেন। কিন্তু স্কুলিংয়ের জন্য একটা কাঠামো লাগে, একটা ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়—সেটির অভাব ছিল। ১৯৯১ সালের পর বাংলাদেশ যখন সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রমে স্বাক্ষর করল এবং গণসাক্ষরতা অভিযানে নামল, তখন সাক্ষরতার হারে উন্নতি দেখতে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসার জন্য ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে পরীক্ষামূলকভাবে পাইলট বেসিসে বৃত্তি দেওয়া শুরু হয়েছিল। পরে এর সাফল্য দেখে সব সরকারই একে আরও এগিয়ে নিয়েছে। এর ফলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ, যেমন বাজেটে বরাদ্দ এবং শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা কার্যক্রম সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ায় একটি বড় কাজ হয়েছে। এখন বাচ্চাদের প্রায় সবাই স্কুলে আসে অর্থাৎ তাদের আমরা স্কুলে আনতে পেরেছি। সেখানে শিক্ষার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু এই যে স্কুলে আসছে, এটা মনে হয় আমাদের ৫০ বছরের যে অর্জন, তার প্রধান উপকরণ হিসেবে রয়েছে।
সবশেষে আসে ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্ট স্ট্যাবিলিটি বা সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো দেশের বাজেট ঘাটতি বাড়ে এবং রিজার্ভ কমে যায়। বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেয়। এ রকম কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশের ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ গত ৫০ বছরে আমাদের ঋণ জিডিপির অনুপাত ৪০-এর ওপরে ওঠেনি। এই স্থিতিশীলতা ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখা বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য বড় ব্যাপার। এটি পূর্বশর্তের মতো কাজ করে। এটি না থাকলে কিছু হবে না ঠিকই, কিন্তু থাকলেই যে হবে—তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এটি থাকা জরুরি।
সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা থাকলে, এর পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়া হলে সেগুলো কাজ করবে। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতি যদি অস্থির হয়ে যায়, তখন দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ যতই ভালো হোক না কেন, সেটা কাজে আসবে না। উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার কথা বলা যায়। অবকাঠামোয় বাংলাদেশের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক উন্নত। শ্রীলঙ্কার শ্রমশক্তিতে আমাদের চেয়ে অনেক উচ্চপর্যায়ের দক্ষতা আছে। কিন্তু যখন সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ে, তখন অন্য সবকিছুই বিকল হয়ে যায়। আমি মনে করি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, উন্মুক্তকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্কুলিং, স্থিতিশীলতা—এই পাঁচটিই বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনের পেছনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হলো ম্যাক্রো বা সামষ্টিকের ক্ষেত্রে। এই স্থিতিশীলতা এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদিও এটা অনেকটা আন্তর্জাতিক কারণে। তবে পুরোটাই আন্তর্জাতিক কারণে নয়। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের যে সংকট চলছে, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বাজেট ঘাটতি অত বড় বিষয় নয়। যদি টেকসইয়ের দিক থেকে চিন্তা করা হয়, আমরা কি আমাদের ঋণ সক্ষমতার চেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করে ফেলেছি? বা ঘাটতি যদি বাড়ে, তাহলে কি ওই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে? আমার মনে হয়, আমরা এখনো ওই পর্যায়ে যাইনি। কিন্তু বাজেট ঘাটতি এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে; কারণ, এটা মূল্যস্ফীতির ওপর এবং মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। সে জন্য একে সংযত পর্যায়ে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্টকে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, এভাবে নিয়ন্ত্রণ করে একে স্থিতিশীল করা যাবে না। কাজেই মূল্যস্ফীতি, বহির্বাণিজ্যের ঘাটতি এবং বিনিময় হারের ভারসাম্য আমরা যত তাড়াতাড়ি নিশ্চিত করতে পারব, তত তাড়াতাড়ি সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা গড়ে তোলা যাবে।
লেখক: সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে