শাইখ সিরাজ
বলা হয় নারীর হাতেই পৃথিবীতে কৃষির সূচনা। সত্যি বলতে হাজার বছর ধরে নারীরা কৃষির সঙ্গে যুক্ত। ফসল ফলানো ও পরিচর্যার কাজটুকু পুরুষের হাতে হলেও ফসল প্রক্রিয়াজাত করার কাজটুকু নারীরাই করে আসছেন। কিন্তু তাঁর সেই কাজটুকু ধর্তব্য হয়নি যুগের পর যুগ। আজ আমরা দেখছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনের আঙিনাকে ভরে তুলেছেন রকমারি ফল-ফসলে। তিনিই মনে হয় বর্তমানে পৃথিবীর প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি নিজে কৃষির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
সেই আশির দশকে যখন ‘মাটি ও মানুষ’ তৈরি করতে ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশের আনাচকানাচে, তখন থেকে দেখেছি আমাদের দেশেও কৃষির গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশে রয়েছে নারীর অবদান। সে সময় একবার ভেবেছিলাম নারী ঠিক কতটুকু কৃষিতে জড়িত, তা বোঝা যেত একটা পরিসংখ্যান বের করা গেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটা পরিসংখ্যান তখন পেয়েছিলাম: ‘বিশ্বজুড়ে কৃষিতে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি শ্রমিকের ৭০ শতাংশ, খাদ্য উৎপাদনকারীদের ৮০ শতাংশ, খাদ্যসামগ্রীর প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণে ১০ শতাংশ নারী। গ্রামীণ কৃষি বিপণনের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ নারীদের দখলে। এভাবে কৃষি উৎপাদনে যুক্ত কর্মীসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী।’ (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ১৯৮৫) যা হোক, আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন সারা পৃথিবী আয়োজন করে পালন করছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পৃথিবীর সব নারীকে এই বিশেষ দিনের শুভেচ্ছা জানাই।
বলছিলাম দেশে নারীদের কৃষিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে। নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া আমাদের কৃষি কখনোই পূর্ণাঙ্গ নয়। কিন্তু এক আজব কারণে নারীরা অবহেলিত হয়ে আসছেন। গত শতাব্দীর সেই আশির দশক থেকে দেখে এসেছি কৃষিশ্রমিক হিসেবে নারীরা মূল্যায়িত হয়েছেন পুরুষের অর্ধেক হিসেবে; অর্থাৎ একজন পুরুষ শ্রমিক যদি মজুরি ১০০ টাকা পান, তবে নারী পান ৫০ টাকা। অথচ নারী কাজটুকু করেন অনেক মমতা নিয়ে। তবে এই বৈষম্যের বিষয়গুলো পাল্টাচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা নিজেদের মতো কৃষিতে অবদান রাখছেন। অনেকে যুক্ত হচ্ছেন কৃষি উৎপাদনে, অনেকেই গড়ে তুলছেন কৃষি বাণিজ্যের ক্ষেত্র। পাঠক, আজ এ লেখায় আমাদের দেশে কয়েকজন নারীর গল্পই তুলে ধরতে চাই।
ঈশ্বরদীর নুরুন্নাহারের গল্পটাই বলি। ঈশ্বরদীতে গিয়েছিলাম স্থানীয় এক কৃষকের কৃষি সাফল্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে। কাজের এক ফাঁকে একজন নারী এসে বললেন, ‘স্যার, আপনার অনুষ্ঠান দেখে আমিও কৃষিকাজ করছি। আমার বাগানটা একটু দেখবেন।’ বললাম, ‘নিশ্চয়ই দেখব। কাজটা শেষ করি।’ কাজ শেষে গিয়ে দেখি একটা পেঁপের বাগানে কয়েকটা গাছ। উৎসাহিত করলাম। ধীরে ধীরে বাগান আরও বড় করতে বললাম। আমার কথা শুনে কেঁদে ফেললেন। আগ্রহী হলাম তাঁর জীবনের গল্পটা শুনতে। ভেজা কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন। বিয়ে হয়ে আসার পর শাশুড়ি একটা ইট আর একটা পাটের বস্তা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ইটটি ছিল তাঁর মাথার বালিশ আর পাটের বস্তাটি ছিল কাঁথা। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে খুঁজছিলেন মুক্তির পথ। পাশের বাড়ির টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে ভাবলেন বাগান করবেন। কিন্তু প্রথম বাধাই আসে পরিবার থেকে। নারী হয়ে এসব তিনি পারবেন—এই বিশ্বাসটাই তাদের ছিল না। অহেতুক সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে লাগানো গাছ কেটে দিয়েছে। সব শুনে আমি তাঁকে উৎসাহ দিয়ে আসলাম। বললাম, ‘আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান। আমি আগামী বছর আপনার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করব।’
নুরুন্নাহার থামেননি। তাঁর দুর্দম ইচ্ছার কাছে সবকিছু পরাজিত হয়। তিনি শ্রমে-ঘামে ঠিকই ছিনিয়ে আনেন আপন সাফল্য। ক্রমেই বেড়েছে তাঁর আবাদের পরিধি। গরুর খামার, মাছের পুকুর, ফল-ফসলের চাষ। কৃষিকে ঘিরেই তাঁর যত কাজকর্ম। এই ২০ বছরে একাধিকবার তাঁর ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছি। সব বাধা পেরিয়ে এখন তিনি একজন সমাজ উন্নয়নকর্মী ও নারী উদ্যোক্তা। নিজের দারিদ্র্য দূর করে সবজি, ফলমূল, পোলট্রি ও গাভির খামার করে এলাকার নারীদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন বছর পেয়েছেন সিটি গ্রুপ জাতীয় পুরস্কার, জাতীয় সবজি পদক, কেআইবি পদক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি ব্রোঞ্জপদক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদকসহ নানান পুরস্কার। গত বছর পেয়েছেন কৃষিক্ষেত্রে অবদানের জন্য এআইপি (অ্যাগ্রিকালচারাল ইম্পোর্ট্যান্ট পারসন) সম্মাননা।
আরেক নারী রাজিয়া সুলতানা ছিলেন গৃহিণী। শৈশব থেকে হৃদয়ে লালন করেছেন কৃষির প্রতি টান। বিয়ের পর স্বামীর চাকরির জন্য ঘুরতে হয়েছে জেলায় জেলায়। কখনো সিলেট, কখনো রাজশাহী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম। বিভিন্ন জেলা ঘুরে থিতু হয়েছিলেন সাভারে। সাভারে এসে অল্প অল্প জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেছেন কৃষির ক্ষেত্র। শুরু ২০১৪ সালে। প্রথমে ২ বিঘা, এরপর ৫ বিঘা। এভাবে অল্প অল্প করে ১৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেন তাঁর স্বপ্নের কৃষি খামার। ব্রকলি, ক্যাপসিকাম, চেরি টমেটো, ক্যাবেজ, রেডবিট, সেলেরি, চায়নিজ ক্যাবেজসহ নানা রকমের বিদেশি সবজি। তিনি বছরে ছয় মাস সবজির চাষ করেন। আর বাকি সময় গরু-ছাগল পালন করেন। প্রতি মৌসুমে সাত থেকে আট লাখ টাকার সবজি উৎপাদন হয় তাঁর খামারে। তাঁর খামারেই এখন প্রায় শতজনের কর্মসংস্থান।
মিরপুরে পারভীন নামের এক নারী কৃষিকে নিয়ে অন্য রকম এক পদক্ষেপ নিয়েছেন। ৪ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরে তিনটি রুমে শুরু করেন ঘরোয়া কৃষির কাজকারবার। ৪০টি র্যাকে প্রতি মাসে গড়ে ৮০০ কেজি সবজি উৎপাদন নিশ্চিত করছেন তিনি। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে শতভাগ ‘গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস’ অনুসরণ করে উৎপাদন করছেন লেটুস, বকচয়, চেরি টমেটো আর ক্যাপসিকাম। উদ্যোক্তা পারভীন বলছিলেন, নতুন প্রজন্মকে নতুন কৃষির সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়াও একটি লক্ষ্য তাঁদের। সেখানে পারভীনের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে রাদিয়া, রিয়ানাসহ বেশ কয়েকজন তরুণ কাজ করেন। আধুনিক এই প্রযুক্তির কৃষিতে দারুণ আগ্রহ তাঁদের। শার্ট, প্যান্ট, জুতা পরেই দিব্যি কাজ করা যাচ্ছেন সেখানে। বিদেশি সংস্থার করপোরেট চাকরি ছেড়ে পারভীন নিজের স্বপ্ন রচনা করছেন প্রযুক্তির কৃষিতে।
আমি আরও এক নারীর কথা বলতে চাই। মদিনা আলী। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। দেশের বাইরে বর্ণাঢ্য জীবনের হাতছানি ছেড়ে দেশে ফিরে কাজ করছেন কৃষকের জন্য। ডা. চাষি নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি অ্যাপ তৈরি করেছেন। অ্যাপটির মাধ্যমে ছবি তুলে কৃষক নির্ণয় করতে পারছেন ফল-ফসলের নানান সমস্যা। মিলছে তার সমাধানও। মদিনা আলীর সংগঠন চাষিদের স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁর এই অসাধারণ প্রচেষ্টার জন্য এবার তিনি ভূষিত হয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ডে। এ বছর শুধু মদিনা আলী নন, সেরা কৃষক নারী হয়েছেন হোসনে আরা রহমান, সেরা সংগ্রামী কৃষক হয়েছেন রেশমা ও শাপলা। তাঁদের একেকজনের জীবনের গল্পও অদ্ভুত সংগ্রামমুখর। তাঁদের কথাও একদিন আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
আমাদের দেশে অসংখ্য নারীর হাতে সমৃদ্ধ হচ্ছে আজকের কৃষি। তাঁদের সবার কথায় রচিত হতে পারে বিশাল গ্রন্থ। আজ থেকে শত বছর আগে নারীমুক্তির বার্তা নিয়ে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লিখেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। আজ যেন আমরা এই সংগ্রামী নারীদের ভেতর সেই মুক্তিসন্ধানী স্বনির্ভর নারী সুলতানার প্রতিকৃতিই দেখতে পাই। আজকের দিনে কৃষিতে বহুমুখী পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নারীর নিরন্তর শ্রম ও নিষ্ঠা। আমার প্রত্যাশা, বাণিজ্যিক হিসাব ও বোঝাপড়া নিয়ে কৃষিতে এগিয়ে আসবেন আরও অনেক নারী।
শাইখ সিরাজ, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
বলা হয় নারীর হাতেই পৃথিবীতে কৃষির সূচনা। সত্যি বলতে হাজার বছর ধরে নারীরা কৃষির সঙ্গে যুক্ত। ফসল ফলানো ও পরিচর্যার কাজটুকু পুরুষের হাতে হলেও ফসল প্রক্রিয়াজাত করার কাজটুকু নারীরাই করে আসছেন। কিন্তু তাঁর সেই কাজটুকু ধর্তব্য হয়নি যুগের পর যুগ। আজ আমরা দেখছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনের আঙিনাকে ভরে তুলেছেন রকমারি ফল-ফসলে। তিনিই মনে হয় বর্তমানে পৃথিবীর প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি নিজে কৃষির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
সেই আশির দশকে যখন ‘মাটি ও মানুষ’ তৈরি করতে ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশের আনাচকানাচে, তখন থেকে দেখেছি আমাদের দেশেও কৃষির গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশে রয়েছে নারীর অবদান। সে সময় একবার ভেবেছিলাম নারী ঠিক কতটুকু কৃষিতে জড়িত, তা বোঝা যেত একটা পরিসংখ্যান বের করা গেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটা পরিসংখ্যান তখন পেয়েছিলাম: ‘বিশ্বজুড়ে কৃষিতে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি শ্রমিকের ৭০ শতাংশ, খাদ্য উৎপাদনকারীদের ৮০ শতাংশ, খাদ্যসামগ্রীর প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণে ১০ শতাংশ নারী। গ্রামীণ কৃষি বিপণনের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ নারীদের দখলে। এভাবে কৃষি উৎপাদনে যুক্ত কর্মীসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী।’ (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ১৯৮৫) যা হোক, আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন সারা পৃথিবী আয়োজন করে পালন করছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। পৃথিবীর সব নারীকে এই বিশেষ দিনের শুভেচ্ছা জানাই।
বলছিলাম দেশে নারীদের কৃষিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে। নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া আমাদের কৃষি কখনোই পূর্ণাঙ্গ নয়। কিন্তু এক আজব কারণে নারীরা অবহেলিত হয়ে আসছেন। গত শতাব্দীর সেই আশির দশক থেকে দেখে এসেছি কৃষিশ্রমিক হিসেবে নারীরা মূল্যায়িত হয়েছেন পুরুষের অর্ধেক হিসেবে; অর্থাৎ একজন পুরুষ শ্রমিক যদি মজুরি ১০০ টাকা পান, তবে নারী পান ৫০ টাকা। অথচ নারী কাজটুকু করেন অনেক মমতা নিয়ে। তবে এই বৈষম্যের বিষয়গুলো পাল্টাচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা নিজেদের মতো কৃষিতে অবদান রাখছেন। অনেকে যুক্ত হচ্ছেন কৃষি উৎপাদনে, অনেকেই গড়ে তুলছেন কৃষি বাণিজ্যের ক্ষেত্র। পাঠক, আজ এ লেখায় আমাদের দেশে কয়েকজন নারীর গল্পই তুলে ধরতে চাই।
ঈশ্বরদীর নুরুন্নাহারের গল্পটাই বলি। ঈশ্বরদীতে গিয়েছিলাম স্থানীয় এক কৃষকের কৃষি সাফল্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে। কাজের এক ফাঁকে একজন নারী এসে বললেন, ‘স্যার, আপনার অনুষ্ঠান দেখে আমিও কৃষিকাজ করছি। আমার বাগানটা একটু দেখবেন।’ বললাম, ‘নিশ্চয়ই দেখব। কাজটা শেষ করি।’ কাজ শেষে গিয়ে দেখি একটা পেঁপের বাগানে কয়েকটা গাছ। উৎসাহিত করলাম। ধীরে ধীরে বাগান আরও বড় করতে বললাম। আমার কথা শুনে কেঁদে ফেললেন। আগ্রহী হলাম তাঁর জীবনের গল্পটা শুনতে। ভেজা কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন। বিয়ে হয়ে আসার পর শাশুড়ি একটা ইট আর একটা পাটের বস্তা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ইটটি ছিল তাঁর মাথার বালিশ আর পাটের বস্তাটি ছিল কাঁথা। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে খুঁজছিলেন মুক্তির পথ। পাশের বাড়ির টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে ভাবলেন বাগান করবেন। কিন্তু প্রথম বাধাই আসে পরিবার থেকে। নারী হয়ে এসব তিনি পারবেন—এই বিশ্বাসটাই তাদের ছিল না। অহেতুক সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে লাগানো গাছ কেটে দিয়েছে। সব শুনে আমি তাঁকে উৎসাহ দিয়ে আসলাম। বললাম, ‘আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান। আমি আগামী বছর আপনার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করব।’
নুরুন্নাহার থামেননি। তাঁর দুর্দম ইচ্ছার কাছে সবকিছু পরাজিত হয়। তিনি শ্রমে-ঘামে ঠিকই ছিনিয়ে আনেন আপন সাফল্য। ক্রমেই বেড়েছে তাঁর আবাদের পরিধি। গরুর খামার, মাছের পুকুর, ফল-ফসলের চাষ। কৃষিকে ঘিরেই তাঁর যত কাজকর্ম। এই ২০ বছরে একাধিকবার তাঁর ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছি। সব বাধা পেরিয়ে এখন তিনি একজন সমাজ উন্নয়নকর্মী ও নারী উদ্যোক্তা। নিজের দারিদ্র্য দূর করে সবজি, ফলমূল, পোলট্রি ও গাভির খামার করে এলাকার নারীদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন বছর পেয়েছেন সিটি গ্রুপ জাতীয় পুরস্কার, জাতীয় সবজি পদক, কেআইবি পদক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি ব্রোঞ্জপদক, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদকসহ নানান পুরস্কার। গত বছর পেয়েছেন কৃষিক্ষেত্রে অবদানের জন্য এআইপি (অ্যাগ্রিকালচারাল ইম্পোর্ট্যান্ট পারসন) সম্মাননা।
আরেক নারী রাজিয়া সুলতানা ছিলেন গৃহিণী। শৈশব থেকে হৃদয়ে লালন করেছেন কৃষির প্রতি টান। বিয়ের পর স্বামীর চাকরির জন্য ঘুরতে হয়েছে জেলায় জেলায়। কখনো সিলেট, কখনো রাজশাহী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম। বিভিন্ন জেলা ঘুরে থিতু হয়েছিলেন সাভারে। সাভারে এসে অল্প অল্প জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেছেন কৃষির ক্ষেত্র। শুরু ২০১৪ সালে। প্রথমে ২ বিঘা, এরপর ৫ বিঘা। এভাবে অল্প অল্প করে ১৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেন তাঁর স্বপ্নের কৃষি খামার। ব্রকলি, ক্যাপসিকাম, চেরি টমেটো, ক্যাবেজ, রেডবিট, সেলেরি, চায়নিজ ক্যাবেজসহ নানা রকমের বিদেশি সবজি। তিনি বছরে ছয় মাস সবজির চাষ করেন। আর বাকি সময় গরু-ছাগল পালন করেন। প্রতি মৌসুমে সাত থেকে আট লাখ টাকার সবজি উৎপাদন হয় তাঁর খামারে। তাঁর খামারেই এখন প্রায় শতজনের কর্মসংস্থান।
মিরপুরে পারভীন নামের এক নারী কৃষিকে নিয়ে অন্য রকম এক পদক্ষেপ নিয়েছেন। ৪ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরে তিনটি রুমে শুরু করেন ঘরোয়া কৃষির কাজকারবার। ৪০টি র্যাকে প্রতি মাসে গড়ে ৮০০ কেজি সবজি উৎপাদন নিশ্চিত করছেন তিনি। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে শতভাগ ‘গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস’ অনুসরণ করে উৎপাদন করছেন লেটুস, বকচয়, চেরি টমেটো আর ক্যাপসিকাম। উদ্যোক্তা পারভীন বলছিলেন, নতুন প্রজন্মকে নতুন কৃষির সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়াও একটি লক্ষ্য তাঁদের। সেখানে পারভীনের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে রাদিয়া, রিয়ানাসহ বেশ কয়েকজন তরুণ কাজ করেন। আধুনিক এই প্রযুক্তির কৃষিতে দারুণ আগ্রহ তাঁদের। শার্ট, প্যান্ট, জুতা পরেই দিব্যি কাজ করা যাচ্ছেন সেখানে। বিদেশি সংস্থার করপোরেট চাকরি ছেড়ে পারভীন নিজের স্বপ্ন রচনা করছেন প্রযুক্তির কৃষিতে।
আমি আরও এক নারীর কথা বলতে চাই। মদিনা আলী। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। দেশের বাইরে বর্ণাঢ্য জীবনের হাতছানি ছেড়ে দেশে ফিরে কাজ করছেন কৃষকের জন্য। ডা. চাষি নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি অ্যাপ তৈরি করেছেন। অ্যাপটির মাধ্যমে ছবি তুলে কৃষক নির্ণয় করতে পারছেন ফল-ফসলের নানান সমস্যা। মিলছে তার সমাধানও। মদিনা আলীর সংগঠন চাষিদের স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁর এই অসাধারণ প্রচেষ্টার জন্য এবার তিনি ভূষিত হয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ডে। এ বছর শুধু মদিনা আলী নন, সেরা কৃষক নারী হয়েছেন হোসনে আরা রহমান, সেরা সংগ্রামী কৃষক হয়েছেন রেশমা ও শাপলা। তাঁদের একেকজনের জীবনের গল্পও অদ্ভুত সংগ্রামমুখর। তাঁদের কথাও একদিন আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
আমাদের দেশে অসংখ্য নারীর হাতে সমৃদ্ধ হচ্ছে আজকের কৃষি। তাঁদের সবার কথায় রচিত হতে পারে বিশাল গ্রন্থ। আজ থেকে শত বছর আগে নারীমুক্তির বার্তা নিয়ে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লিখেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। আজ যেন আমরা এই সংগ্রামী নারীদের ভেতর সেই মুক্তিসন্ধানী স্বনির্ভর নারী সুলতানার প্রতিকৃতিই দেখতে পাই। আজকের দিনে কৃষিতে বহুমুখী পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নারীর নিরন্তর শ্রম ও নিষ্ঠা। আমার প্রত্যাশা, বাণিজ্যিক হিসাব ও বোঝাপড়া নিয়ে কৃষিতে এগিয়ে আসবেন আরও অনেক নারী।
শাইখ সিরাজ, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১০ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে