মামুনুর রশীদ
বাঙালি মৌলিক চিন্তায় খুবই উৎসাহী। দেশে কোনো গণ-অভ্যুত্থান বা রাজনৈতিক সংকট হলে নিজেদের মতো করে বিশ্লেষণ করে এবং এই কথা সর্বত্র বলে থাকে। তা নিয়ে পরিবারে, চায়ের দোকানে অথবা কোনো আড্ডায় প্রবল তর্কাতর্কি শুরু হয়। এবং এভাবেই দিনের পর দিন কাটতে থাকে। সম্প্রতি প্রতিটি জায়গায় রাজনীতি ছাড়া কোনো আলোচনা নেই। ঘরে-বাইরের ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে এখন তেমন কথা হয় না। কথা একটাই—সেটা বর্তমান সংকট ও ভবিষ্যৎ।
প্রতিদিনই যেহেতু নতুন নতুন সংকট সামনে আসে, কাজেই সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হতে থাকে। ঘটনাক্রমে মনে হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, খুদে ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, সিএনজি-বাসড্রাইভার, হেলপার, কন্ডাক্টরসহ সবাই ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে গেছে! সেই সঙ্গে গৃহবধূরা, বাড়ির কাজের ছেলেমেয়েরাও একই আলোচনায় যোগ দিচ্ছে আর মোটরগাড়ির ড্রাইভাররা এই সময়ে প্রায় দার্শনিক হয়ে গেছে! তবে আলোচনাতেই তাদের আনন্দ কিন্তু একেবারেই আগ্রহ নেই কোনো ঘটনায় অংশ নেওয়ার। যদিও সাম্প্রতিক আন্দোলনে কেউ কেউ অংশ নিয়েছিল এবং তাদের অংশগ্রহণ করার বিষয়টিও খুব ফলাও করে প্রচার করে থাকে। কিন্তু এ কাজে বাঙালি স্বভাবের অবিচ্ছেদ্য অংশ—কর্তব্যে অবহেলা, ফাঁকিবাজি করা এবং দুর্নীতি—কোনোটাতে তারা যে থামছে, তা নয়।
আমরা যেকোনো অভ্যুত্থানের পর মানুষের চরিত্রে কিছুটা গুণগত পরিবর্তন আশা করি। কিন্তু এখানে মুখে তুবড়ি ফুটিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেরাই দুর্নীতিতে অংশ নিয়ে থাকে। এবারে বেশ কিছু ইতিবাচক ঘোষণা এসেছে। বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার। যে সংস্কারটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করেছিলাম, সেটি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের ফলে দেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার একটা আমূল পরিবর্তন খুব প্রয়োজন ছিল। বইয়ের বোঝা ও আনন্দহীন শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি এবং শিক্ষার প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের সংস্কার দরকার।
প্রাইমারি স্কুল থেকে একেবারে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত একটা বড় ধরনের সংস্কারকাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তারই কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য একটি কমিটিও করা হলো। হঠাৎ করেই বাইরে আমরা আওয়াজ পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা এবং অন্য যাঁরা সাম্প্রতিক আন্দোলনে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না। এখানে আশান্বিত হয়েছিলাম, যেহেতু শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দীর্ঘদিন যাবৎ এমনই সংস্কারকাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন, সেহেতু তাঁর নেতৃত্বে একটা কিছু ঘটবে। কিন্তু ঘটল না, বরং ঘোষিত কমিটি বাতিল হয়ে গেল। কার প্ররোচনায় হলো, তা সম্প্রতি ছাত্ররা প্রকাশ করেছে—ইসলামি ফোবিয়ার কারণে একটি গোষ্ঠী তাঁকে চায়নি এবং সে কারণেই কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
এ তো গেল এই সময়ের কথা। একবার আমাকে প্রাইমারি শিক্ষার কারিকুলামের বিষয়ে এক কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল। একটি-দুটি সভায়ও আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু আমি যখন কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুললাম প্রাইমারি শিক্ষার বিষয়ে, তারপরে আমাকে আর ডাকা হয়নি এবং এ বিষয়ে আমার প্রস্তুতিগুলো প্রকাশ করারও সুযোগ পাইনি। বরং পত্রপত্রিকায় সেগুলো লিখে জানিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমি আর এখন বলব না যে মুক্তচিন্তার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোন পরিবেশ তৈরি করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রগতিশীল রাজনীতি ও থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। তিনি নাটক লেখেন একজন নাট্যকার হিসেবে, ইতিমধ্যে প্রশংসিতও হয়েছেন। শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক আছে এবং প্রয়োজনে পথেও দাঁড়িয়ে যান। ওই কমিটিতে তাঁর নাম থাকার জন্য কমিটিই বাতিল হয়ে গেল। আমাদের কর্তৃপক্ষ সব সময়ই একটা জুজুর ভয়ে থাকে, অতীতেও তা দেখেছি। আমি নিজে অনেকবার মিডিয়া সেন্সরের সঙ্গে লড়াই করেছি। কিন্তু এবারও দেখা গেল তার ব্যত্যয় হলো না। এক অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল পাঠ্যক্রমের কমিটি।
হেফাজতের প্রভাবে একসময় পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সেগুলো নিয়ে আমরা সোচ্চার ছিলাম কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস বা কারিকুলাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যার জন্য ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল এবং শরিফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। পরবর্তীকালে মজিদ কমিশনের বিরুদ্ধেও ছাত্ররা পথে নেমেছিল ও প্রাণ দিয়েছিল। রাস্তার আন্দোলনের সামনে শাসকগোষ্ঠী কখনো নতিস্বীকার করলেও গোপনে গোপনে তা কার্যকর হয়ে যায়।
আমাদের শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ আছে। আমরা আশা করেছিলাম শিল্পকলা একাডেমির জন্য একজন মহাপরিচালক আসবেন এবং জামিল আহমেদকে সেই পদে নিয়োগ করাতে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম। সম্প্রতি সব বিভাগীয় প্রধানও আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একশ্রেণির লোকের আকাঙ্ক্ষার মিল দেখা যাচ্ছে না। পিনাকী ভট্টাচার্য সুদূর প্রবাসে থেকে জামিল আহমেদকে অপসারণের জন্য হুমকি দিচ্ছেন। তাঁর অপরাধ, তিনি ভারতে পড়ালেখা করেছেন চার বছর, সেই কারণে তিনি ভারতের সমর্থক! কিছু লোক অকারণে মাঝে মাঝেই ভারতীয় দালালদের একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে। সেই তালিকায় এমন সব নাম রয়েছে, যাঁরা বহুবার ভারতীয় রাজনীতির বিপক্ষে কথা বলেছেন। এটিও বাঙালির মৌলিক চিন্তার ফল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে তৈরি হবে পাঠ্যক্রম, কীভাবে কাজ করবে শিল্পকলা একাডেমি? ইতিমধ্যে কিছু মৌলিক চিন্তার অধিকারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সেই চল্লিশের লাহোর প্রস্তাবকে আবার নতুন করে চিন্তার খোরাক দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে পাকিস্তান নির্মাণ করেছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, সেই পাকিস্তান কি খুব ভালো আছে? অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে ডলারের মূল্য বিবেচনায় পাকিস্তান থেকে কত এগিয়ে বাংলাদেশ! একটি ব্যর্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে বারবার সেনাবাহিনীর দ্বারা অধিকৃত, সেই রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের জন্য ভালো উদাহরণ হতে পারে?
আমাদের সমস্যা হচ্ছে, সাতচল্লিশের পরই দেখেছি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি। সব সময়ই রক্তের বিনিময়ে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। আমাদের ভাষাকে রক্ষা করতে হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হয়েছে, সেটিও রক্তের বিনিময়ে। সব সময়ই বিপুল বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে। গণতন্ত্রহীনতার কারণে আমাদের সমাজে যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শাসকগোষ্ঠীর বাইরেও ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সিভিল ভয়েজ’ অর্থাৎ জনতার কণ্ঠস্বর, সেটাও তেমন একটা গড়ে উঠতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের চিন্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, অহংকার করেছে নিজেদের শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। কিন্তু তারা অন্যের মতামতকে স্বীকার করে না অথবা একটু ভাবেও না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিলেন। কিন্তু আমলাদের ষড়যন্ত্রে তা একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আর এইসব বিশ্বমানের অর্থনীতিবিদেরা পরিকল্পনা কমিশন থেকে চলে যান। এখন ব্যাপারটি একেবারে আমলাদের হাতে, যাঁদের কাজ হচ্ছে নির্বাহী হওয়া, ভবিষ্যতের পরিকল্পনাকারী তাঁরা নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শিক্ষক তাঁদের নিয়ে একটা পাঠ্যক্রমের কমিটি হওয়ার পেছনেও থাকে আমলাতন্ত্রের প্রভাব। যাঁরা এইসব কমিটির প্রধান থাকেন তাঁরাও সাবেক শিক্ষক বটে, কিন্তু এই লোকগুলোর পাঠ্যক্রম করার কোনো দক্ষতা বা ক্ষমতা নেই। একেবারে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রধানের পদটি ধরে রাখেন এবং সব রকম সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে একসময় চাকরি থেকে বিদায় নেন। চাকরিজীবীদের দিয়ে যে কোনো উন্নয়ন হয় না, তা সারা বিশ্বে প্রমাণ আছে। শুধু চাকরিজীবী নন, সংসদ সদস্যদের দিয়েও কোনো কিছু হয় না, তা-ও প্রমাণিত।
আধুনিক রাষ্ট্রে সংস্কৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো সংস্কৃতিবিষয়ক কমিটিতে সংসদ সদস্য, আমলা আর দু-চারজন বিশেষজ্ঞ থাকেন। ওই সংসদ সদস্যের তদবির করা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা থাকে না। যাঁরা প্রতিবাদ করেন একসময় অজান্তেই তাঁদের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। বর্তমানে নানা কালাকানুন বাতিল করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি এসেছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ইতিমধ্যেই আমরা হোঁচট খেয়েছি এবং আশার কথা, ছাত্ররা ড. সামিনা লুৎফার বিষয়টি বুঝতে পেরে আন্দোলনে নেমেছেন। আশা করি, বিষয়টি নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। এটাও যেন একপেশে মীমাংসায় গিয়ে না পৌঁছায়।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
বাঙালি মৌলিক চিন্তায় খুবই উৎসাহী। দেশে কোনো গণ-অভ্যুত্থান বা রাজনৈতিক সংকট হলে নিজেদের মতো করে বিশ্লেষণ করে এবং এই কথা সর্বত্র বলে থাকে। তা নিয়ে পরিবারে, চায়ের দোকানে অথবা কোনো আড্ডায় প্রবল তর্কাতর্কি শুরু হয়। এবং এভাবেই দিনের পর দিন কাটতে থাকে। সম্প্রতি প্রতিটি জায়গায় রাজনীতি ছাড়া কোনো আলোচনা নেই। ঘরে-বাইরের ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে এখন তেমন কথা হয় না। কথা একটাই—সেটা বর্তমান সংকট ও ভবিষ্যৎ।
প্রতিদিনই যেহেতু নতুন নতুন সংকট সামনে আসে, কাজেই সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হতে থাকে। ঘটনাক্রমে মনে হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, খুদে ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, সিএনজি-বাসড্রাইভার, হেলপার, কন্ডাক্টরসহ সবাই ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে গেছে! সেই সঙ্গে গৃহবধূরা, বাড়ির কাজের ছেলেমেয়েরাও একই আলোচনায় যোগ দিচ্ছে আর মোটরগাড়ির ড্রাইভাররা এই সময়ে প্রায় দার্শনিক হয়ে গেছে! তবে আলোচনাতেই তাদের আনন্দ কিন্তু একেবারেই আগ্রহ নেই কোনো ঘটনায় অংশ নেওয়ার। যদিও সাম্প্রতিক আন্দোলনে কেউ কেউ অংশ নিয়েছিল এবং তাদের অংশগ্রহণ করার বিষয়টিও খুব ফলাও করে প্রচার করে থাকে। কিন্তু এ কাজে বাঙালি স্বভাবের অবিচ্ছেদ্য অংশ—কর্তব্যে অবহেলা, ফাঁকিবাজি করা এবং দুর্নীতি—কোনোটাতে তারা যে থামছে, তা নয়।
আমরা যেকোনো অভ্যুত্থানের পর মানুষের চরিত্রে কিছুটা গুণগত পরিবর্তন আশা করি। কিন্তু এখানে মুখে তুবড়ি ফুটিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেরাই দুর্নীতিতে অংশ নিয়ে থাকে। এবারে বেশ কিছু ইতিবাচক ঘোষণা এসেছে। বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার। যে সংস্কারটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করেছিলাম, সেটি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের ফলে দেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার একটা আমূল পরিবর্তন খুব প্রয়োজন ছিল। বইয়ের বোঝা ও আনন্দহীন শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি এবং শিক্ষার প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের সংস্কার দরকার।
প্রাইমারি স্কুল থেকে একেবারে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত একটা বড় ধরনের সংস্কারকাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তারই কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য একটি কমিটিও করা হলো। হঠাৎ করেই বাইরে আমরা আওয়াজ পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা এবং অন্য যাঁরা সাম্প্রতিক আন্দোলনে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না। এখানে আশান্বিত হয়েছিলাম, যেহেতু শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দীর্ঘদিন যাবৎ এমনই সংস্কারকাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন, সেহেতু তাঁর নেতৃত্বে একটা কিছু ঘটবে। কিন্তু ঘটল না, বরং ঘোষিত কমিটি বাতিল হয়ে গেল। কার প্ররোচনায় হলো, তা সম্প্রতি ছাত্ররা প্রকাশ করেছে—ইসলামি ফোবিয়ার কারণে একটি গোষ্ঠী তাঁকে চায়নি এবং সে কারণেই কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
এ তো গেল এই সময়ের কথা। একবার আমাকে প্রাইমারি শিক্ষার কারিকুলামের বিষয়ে এক কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল। একটি-দুটি সভায়ও আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু আমি যখন কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুললাম প্রাইমারি শিক্ষার বিষয়ে, তারপরে আমাকে আর ডাকা হয়নি এবং এ বিষয়ে আমার প্রস্তুতিগুলো প্রকাশ করারও সুযোগ পাইনি। বরং পত্রপত্রিকায় সেগুলো লিখে জানিয়েছি। এ ক্ষেত্রে আমি আর এখন বলব না যে মুক্তচিন্তার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোন পরিবেশ তৈরি করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রগতিশীল রাজনীতি ও থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। তিনি নাটক লেখেন একজন নাট্যকার হিসেবে, ইতিমধ্যে প্রশংসিতও হয়েছেন। শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক আছে এবং প্রয়োজনে পথেও দাঁড়িয়ে যান। ওই কমিটিতে তাঁর নাম থাকার জন্য কমিটিই বাতিল হয়ে গেল। আমাদের কর্তৃপক্ষ সব সময়ই একটা জুজুর ভয়ে থাকে, অতীতেও তা দেখেছি। আমি নিজে অনেকবার মিডিয়া সেন্সরের সঙ্গে লড়াই করেছি। কিন্তু এবারও দেখা গেল তার ব্যত্যয় হলো না। এক অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল পাঠ্যক্রমের কমিটি।
হেফাজতের প্রভাবে একসময় পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সেগুলো নিয়ে আমরা সোচ্চার ছিলাম কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস বা কারিকুলাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যার জন্য ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল এবং শরিফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। পরবর্তীকালে মজিদ কমিশনের বিরুদ্ধেও ছাত্ররা পথে নেমেছিল ও প্রাণ দিয়েছিল। রাস্তার আন্দোলনের সামনে শাসকগোষ্ঠী কখনো নতিস্বীকার করলেও গোপনে গোপনে তা কার্যকর হয়ে যায়।
আমাদের শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ আছে। আমরা আশা করেছিলাম শিল্পকলা একাডেমির জন্য একজন মহাপরিচালক আসবেন এবং জামিল আহমেদকে সেই পদে নিয়োগ করাতে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম। সম্প্রতি সব বিভাগীয় প্রধানও আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একশ্রেণির লোকের আকাঙ্ক্ষার মিল দেখা যাচ্ছে না। পিনাকী ভট্টাচার্য সুদূর প্রবাসে থেকে জামিল আহমেদকে অপসারণের জন্য হুমকি দিচ্ছেন। তাঁর অপরাধ, তিনি ভারতে পড়ালেখা করেছেন চার বছর, সেই কারণে তিনি ভারতের সমর্থক! কিছু লোক অকারণে মাঝে মাঝেই ভারতীয় দালালদের একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে। সেই তালিকায় এমন সব নাম রয়েছে, যাঁরা বহুবার ভারতীয় রাজনীতির বিপক্ষে কথা বলেছেন। এটিও বাঙালির মৌলিক চিন্তার ফল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে তৈরি হবে পাঠ্যক্রম, কীভাবে কাজ করবে শিল্পকলা একাডেমি? ইতিমধ্যে কিছু মৌলিক চিন্তার অধিকারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সেই চল্লিশের লাহোর প্রস্তাবকে আবার নতুন করে চিন্তার খোরাক দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে পাকিস্তান নির্মাণ করেছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, সেই পাকিস্তান কি খুব ভালো আছে? অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে ডলারের মূল্য বিবেচনায় পাকিস্তান থেকে কত এগিয়ে বাংলাদেশ! একটি ব্যর্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে বারবার সেনাবাহিনীর দ্বারা অধিকৃত, সেই রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের জন্য ভালো উদাহরণ হতে পারে?
আমাদের সমস্যা হচ্ছে, সাতচল্লিশের পরই দেখেছি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি। সব সময়ই রক্তের বিনিময়ে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। আমাদের ভাষাকে রক্ষা করতে হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হয়েছে, সেটিও রক্তের বিনিময়ে। সব সময়ই বিপুল বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে। গণতন্ত্রহীনতার কারণে আমাদের সমাজে যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শাসকগোষ্ঠীর বাইরেও ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সিভিল ভয়েজ’ অর্থাৎ জনতার কণ্ঠস্বর, সেটাও তেমন একটা গড়ে উঠতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের চিন্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, অহংকার করেছে নিজেদের শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। কিন্তু তারা অন্যের মতামতকে স্বীকার করে না অথবা একটু ভাবেও না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিলেন। কিন্তু আমলাদের ষড়যন্ত্রে তা একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আর এইসব বিশ্বমানের অর্থনীতিবিদেরা পরিকল্পনা কমিশন থেকে চলে যান। এখন ব্যাপারটি একেবারে আমলাদের হাতে, যাঁদের কাজ হচ্ছে নির্বাহী হওয়া, ভবিষ্যতের পরিকল্পনাকারী তাঁরা নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শিক্ষক তাঁদের নিয়ে একটা পাঠ্যক্রমের কমিটি হওয়ার পেছনেও থাকে আমলাতন্ত্রের প্রভাব। যাঁরা এইসব কমিটির প্রধান থাকেন তাঁরাও সাবেক শিক্ষক বটে, কিন্তু এই লোকগুলোর পাঠ্যক্রম করার কোনো দক্ষতা বা ক্ষমতা নেই। একেবারে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রধানের পদটি ধরে রাখেন এবং সব রকম সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে একসময় চাকরি থেকে বিদায় নেন। চাকরিজীবীদের দিয়ে যে কোনো উন্নয়ন হয় না, তা সারা বিশ্বে প্রমাণ আছে। শুধু চাকরিজীবী নন, সংসদ সদস্যদের দিয়েও কোনো কিছু হয় না, তা-ও প্রমাণিত।
আধুনিক রাষ্ট্রে সংস্কৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো সংস্কৃতিবিষয়ক কমিটিতে সংসদ সদস্য, আমলা আর দু-চারজন বিশেষজ্ঞ থাকেন। ওই সংসদ সদস্যের তদবির করা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা থাকে না। যাঁরা প্রতিবাদ করেন একসময় অজান্তেই তাঁদের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। বর্তমানে নানা কালাকানুন বাতিল করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি এসেছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ইতিমধ্যেই আমরা হোঁচট খেয়েছি এবং আশার কথা, ছাত্ররা ড. সামিনা লুৎফার বিষয়টি বুঝতে পেরে আন্দোলনে নেমেছেন। আশা করি, বিষয়টি নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। এটাও যেন একপেশে মীমাংসায় গিয়ে না পৌঁছায়।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে