এ কে এম শামসুদ্দিন
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দেশজুড়ে কার্যকর হলো বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন। আনুষ্ঠানিকভাবে এই আইন চালুর কথা ঘোষণার পরপরই ভারতজুড়ে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। জম্মু-কাশ্মীর থেকে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র থেকে আসাম—একযোগে সরব হয়ে উঠেছে বিরোধী নেতৃত্ব; বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপকভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদে ১২ মার্চ আসামজুড়ে ধর্মঘটও পালন করা হয়। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আসামের ১৬টি দলের জোট ‘ইউনাইটেড অপজিশন ফোরাম আসাম’-এর ডাকে বিভিন্ন জেলার দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।
পশ্চিমবঙ্গেও এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। মোদি সরকারের নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দু-তিন দিন আগে কেন এই আইন বলবৎ করা হচ্ছে? তাঁর কথায়, লোকসভা ভোটের মুখে এই আইন কার্যকর করার ঘোষণা আসলে বিজেপির ‘নির্বাচন স্টান্ট’ ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, এর কোনো ভিত্তি ও স্বচ্ছতাও নেই। এটা পুরোপুরি ভাঁওতা ও জুলুম। তিনি এ আইনকে মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার আইন বলে অভিহিত করেন। মমতার মতো কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কোনো অবস্থাতেই তাঁর রাজ্যে কার্যকর হতে দেবেন না। ওদিকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন আরও একধাপ এগিয়ে তামিল নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টার অভিসন্ধি বলে বিজেপির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ, এই আইন শ্রীলঙ্কার তামিল উদ্বাস্তুবিরোধী। আসলে এটি ব্যবহার করা হবে তামিলদের বিরুদ্ধে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও বসে নেই। তিনি বলেছেন, দশ বছর ধরে দেশ শাসন করে মোদি সরকার লোকসভা নির্বাচনের আগে এই বিতর্কিত আইন চালু করেছে। এমন সময়ে এই আইন চালু করা হলো, যখন দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা মুদ্রাস্ফীতির চাপে দিশেহারা। বেকারেরা কর্মসংস্থানের জন্য লড়াই করছে। আসল সমস্যা সমাধান করার বদলে মোদি এই বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে খেলা শুরু করেছেন।
ভারতের কংগ্রেস দল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকরের বিরুদ্ধে আরও জোরালোভাবে আন্দোলনে নামবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, দক্ষিণ ভারতে সংবিধান পরিবর্তন করে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দিকে বিজেপি এগোচ্ছে। বিজেপির কর্ণাটকের সংসদ সদস্য অনন্তকুমার হেগড়ের দেওয়া এক বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেছে, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে পার্লামেন্টে ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪০০, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ আসন দরকার। সেই লক্ষ্যে বিজেপি ৪০০ আসন দখলের পাঁয়তারা করেই নির্বাচনের ঠিক আগে এই আইন কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মোদির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, বাবাসাহেব আম্বেদকরের সংবিধান ধ্বংস করা। কারণ বিজেপি ন্যায়, সমতা, নাগরিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের কিছুই সমর্থন করে না। এদের লক্ষ্য সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা।’ যাঁরাই আইনটির বিরোধিতা করছেন, তাঁদের মূল অভিযোগ, আইনটি ভারতের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। কারণ এই আইনে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। যদিও বিজেপি বলছে, এই আইনে অন্য ধর্মের কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না।
বিজেপি ক্ষমতায় এসেই প্রথমে এনআরসি উত্থাপন করে ‘শরণার্থী’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যুটি সামনে নিয়ে এসেছিল। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তখন স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ‘সব হিন্দুকে ভারতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ সবাইকে দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।’ সুতরাং বাদ পড়ার মধ্যে থাকবে শুধু মুসলমানরা। তখন বলে দেওয়া হয়েছিল, মুসলমান বাদে অন্য ধর্মাবলম্বীরা ‘শরণার্থী’ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর মুসলমানদের তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং এসব অনুপ্রবেশকারীকে ভারতের বাইরে বের করে দেওয়া হবে। যদিও ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, ধর্মের ভিত্তিতে দেশের কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না। বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ইতিমধ্যে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাস করিয়ে নিয়েছে। ভারতে এযাবৎ নাগরিকত্ব স্বীকৃতির জন্য সাধারণত দুটি প্রচলিত নীতি অনুসরণ করা হতো। ১. নাগরিকদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ‘জন্মস্থানের হিসেবে’, এ ক্ষেত্রেও মুসলিম বা অমুসলিম উল্লেখ করা ছিল না। ২. ‘রক্তের সম্পর্ক’ মোতাবেক। একজন ব্যক্তি বা মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ হয় নাগরিকত্বের ভিত্তিতে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের আইন দ্বারাই নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়। ভারতে প্রথম নাগরিকত্ব আইন পাস হয় ১৯৫৫ সালে। সেই আইনে কোনো ধর্মের কথা উল্লেখ ছিল না। এই নাগরিকত্ব আইন পাস হওয়ার পর এ পর্যন্ত চারবার সংশোধিত হয়েছে। ভারতের সংবিধানের পঞ্চম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ভারতে যাঁরা বাস করেন এবং যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এমনকি যাঁদের জন্ম ভারতে নয়; কিন্তু বসবাস করেন ভারতে এবং যাঁদের মা-বাবার মধ্যে যেকোনো একজন ভারতে জন্মেছেন তাঁরাও নাগরিকত্ব পাবেন। যাঁরা ভারতে পাঁচ বছরের বেশি সময় বসবাস করছেন, তাঁরাও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। একের পর এক সংশোধনের পর পর, সর্বশেষে এসে বলা হয়েছে, যাঁরা ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বা তার পর জন্মেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য হয় তাঁদের মা-বাবা উভয়কেই ভারতের নাগরিক হতে হবে বা যেকোনো একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং অন্যজন অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না।
উল্লিখিত আইনে যাঁদের ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়েছে, তাঁদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতাবলেই ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই মোদি সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাস করিয়ে নেয়। সে বছরের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর প্রদানের মাধ্যমে বিজেপির প্রস্তাবিত ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী’ বিলটি আইনে পরিণত হয়। দীর্ঘ চার বছরের বেশি আগে পাস হলেও এই আইন বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সেই আন্দোলনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে বলা আছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে ভারতে প্রবেশ করা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এসব দেশ থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি ও খ্রিষ্টান, মোটকথা মুসলমান বাদে উল্লিখিত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা উল্লেখ আছে। তবে এসব শরণার্থীকে কিছু প্রামাণ্য নথি দিতে হবে। আবেদনকারীর কাছে যদি নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য প্রামাণ্য নথি না থাকে, তাহলে জেলা স্তরে থাকা যাচাই-কমিটি বাড়তি নথি জমা দিতে বলতে পারে। কিন্তু এর পরও দিতে না পারলে, সেই আবেদন খারিজ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ধরে নেওয়া হবে, নাকি ফের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হবে, সে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট নয়। তাতে মনে হতেই পারে, যে ব্যক্তি আবেদন করবেন তিনি নিজে থেকেই স্বীকার করে নিলেন যে তিনি সে দেশে অনুপ্রবেশকারী। এখন তার আবেদন খারিজ হলে তিনি কি অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই সে দেশে বসবাস করার সুযোগ পাবেন; নাকি তাকে বিতাড়িত করা হবে, এ বিষয়টিও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে না পারলে আবেদনকারীদের কীভাবে সাহায্য করা যায়, সে বিষয়ে সরকার ‘পরে চিন্তাভাবনা করবে’ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
এই নির্বাচনে শুধু জিততে চাইছে না বিজেপি; তারা চাইছে এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে। যাতে শরিক দলের ওপরে নির্ভর না করেই সংবিধানে নানা পরিবর্তন আনতে পারে। ভারতের যে দুটো অঞ্চলে ভালো ফলাফল করতে না পারলে তারা দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে না, সেই পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলকে টার্গেট করেই ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণের কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে এই আইন বাস্তবায়ন করতে দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ওদিকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী অতি সূক্ষ্মভাবে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে তামিলবিরোধী তকমা দিয়েছেন, যা লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে বিজেপির জোটভুক্ত তামিল আঞ্চলিক দলগুলোও চরম অস্বস্তিতে পড়বে। মমতাও একই পথে হাঁটবেন সন্দেহ নেই। তিনি এরই মধ্যে এই আইনকে বাঙালি ও সংবিধানবিরোধী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
সংশোধিত নাগরিক আইনের আগে বিজেপি সরকার আসামে এনআরসি প্রণয়ন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল অনুপ্রবেশ করা বিদেশিদের, বিশেষ করে মুসলমানদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে বহিষ্কার করা। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেছে, আসামে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাই বেশি। এরপর এটি বাতিল হয়ে যায়। তখন বিজেপি ঘোষণা দিয়েছিল, প্রথমে নাগরিকত্ব বিল আনা হবে এবং তা পাস করা হবে। বাস্তবে তাই-ই হয়েছে। অতঃপর এনআরসি আনা হবে এবং সেটা হবে সারা ভারতের জন্য। চার বছরে একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দু-তিন দিন আগে এই আইন বাস্তবায়ন করা থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যেই এটি করেছেন। তবে রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলো যে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তাতে নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাশিত ভোটের পাল্লা যদি ভারী না হয়, আশ্চর্য হব না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দেশজুড়ে কার্যকর হলো বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন। আনুষ্ঠানিকভাবে এই আইন চালুর কথা ঘোষণার পরপরই ভারতজুড়ে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। জম্মু-কাশ্মীর থেকে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র থেকে আসাম—একযোগে সরব হয়ে উঠেছে বিরোধী নেতৃত্ব; বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন সংগঠন ব্যাপকভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদে ১২ মার্চ আসামজুড়ে ধর্মঘটও পালন করা হয়। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আসামের ১৬টি দলের জোট ‘ইউনাইটেড অপজিশন ফোরাম আসাম’-এর ডাকে বিভিন্ন জেলার দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।
পশ্চিমবঙ্গেও এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। মোদি সরকারের নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দু-তিন দিন আগে কেন এই আইন বলবৎ করা হচ্ছে? তাঁর কথায়, লোকসভা ভোটের মুখে এই আইন কার্যকর করার ঘোষণা আসলে বিজেপির ‘নির্বাচন স্টান্ট’ ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, এর কোনো ভিত্তি ও স্বচ্ছতাও নেই। এটা পুরোপুরি ভাঁওতা ও জুলুম। তিনি এ আইনকে মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার আইন বলে অভিহিত করেন। মমতার মতো কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কোনো অবস্থাতেই তাঁর রাজ্যে কার্যকর হতে দেবেন না। ওদিকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন আরও একধাপ এগিয়ে তামিল নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টার অভিসন্ধি বলে বিজেপির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ, এই আইন শ্রীলঙ্কার তামিল উদ্বাস্তুবিরোধী। আসলে এটি ব্যবহার করা হবে তামিলদের বিরুদ্ধে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও বসে নেই। তিনি বলেছেন, দশ বছর ধরে দেশ শাসন করে মোদি সরকার লোকসভা নির্বাচনের আগে এই বিতর্কিত আইন চালু করেছে। এমন সময়ে এই আইন চালু করা হলো, যখন দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা মুদ্রাস্ফীতির চাপে দিশেহারা। বেকারেরা কর্মসংস্থানের জন্য লড়াই করছে। আসল সমস্যা সমাধান করার বদলে মোদি এই বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে খেলা শুরু করেছেন।
ভারতের কংগ্রেস দল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকরের বিরুদ্ধে আরও জোরালোভাবে আন্দোলনে নামবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, দক্ষিণ ভারতে সংবিধান পরিবর্তন করে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দিকে বিজেপি এগোচ্ছে। বিজেপির কর্ণাটকের সংসদ সদস্য অনন্তকুমার হেগড়ের দেওয়া এক বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেছে, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে পার্লামেন্টে ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪০০, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ আসন দরকার। সেই লক্ষ্যে বিজেপি ৪০০ আসন দখলের পাঁয়তারা করেই নির্বাচনের ঠিক আগে এই আইন কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মোদির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, বাবাসাহেব আম্বেদকরের সংবিধান ধ্বংস করা। কারণ বিজেপি ন্যায়, সমতা, নাগরিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের কিছুই সমর্থন করে না। এদের লক্ষ্য সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা।’ যাঁরাই আইনটির বিরোধিতা করছেন, তাঁদের মূল অভিযোগ, আইনটি ভারতের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। কারণ এই আইনে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। যদিও বিজেপি বলছে, এই আইনে অন্য ধর্মের কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না।
বিজেপি ক্ষমতায় এসেই প্রথমে এনআরসি উত্থাপন করে ‘শরণার্থী’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যুটি সামনে নিয়ে এসেছিল। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তখন স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ‘সব হিন্দুকে ভারতে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ সবাইকে দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।’ সুতরাং বাদ পড়ার মধ্যে থাকবে শুধু মুসলমানরা। তখন বলে দেওয়া হয়েছিল, মুসলমান বাদে অন্য ধর্মাবলম্বীরা ‘শরণার্থী’ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর মুসলমানদের তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং এসব অনুপ্রবেশকারীকে ভারতের বাইরে বের করে দেওয়া হবে। যদিও ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, ধর্মের ভিত্তিতে দেশের কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না। বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ইতিমধ্যে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাস করিয়ে নিয়েছে। ভারতে এযাবৎ নাগরিকত্ব স্বীকৃতির জন্য সাধারণত দুটি প্রচলিত নীতি অনুসরণ করা হতো। ১. নাগরিকদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ‘জন্মস্থানের হিসেবে’, এ ক্ষেত্রেও মুসলিম বা অমুসলিম উল্লেখ করা ছিল না। ২. ‘রক্তের সম্পর্ক’ মোতাবেক। একজন ব্যক্তি বা মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ হয় নাগরিকত্বের ভিত্তিতে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের আইন দ্বারাই নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়। ভারতে প্রথম নাগরিকত্ব আইন পাস হয় ১৯৫৫ সালে। সেই আইনে কোনো ধর্মের কথা উল্লেখ ছিল না। এই নাগরিকত্ব আইন পাস হওয়ার পর এ পর্যন্ত চারবার সংশোধিত হয়েছে। ভারতের সংবিধানের পঞ্চম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ভারতে যাঁরা বাস করেন এবং যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এমনকি যাঁদের জন্ম ভারতে নয়; কিন্তু বসবাস করেন ভারতে এবং যাঁদের মা-বাবার মধ্যে যেকোনো একজন ভারতে জন্মেছেন তাঁরাও নাগরিকত্ব পাবেন। যাঁরা ভারতে পাঁচ বছরের বেশি সময় বসবাস করছেন, তাঁরাও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। একের পর এক সংশোধনের পর পর, সর্বশেষে এসে বলা হয়েছে, যাঁরা ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বা তার পর জন্মেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য হয় তাঁদের মা-বাবা উভয়কেই ভারতের নাগরিক হতে হবে বা যেকোনো একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং অন্যজন অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না।
উল্লিখিত আইনে যাঁদের ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়েছে, তাঁদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতাবলেই ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই মোদি সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাস করিয়ে নেয়। সে বছরের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর প্রদানের মাধ্যমে বিজেপির প্রস্তাবিত ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী’ বিলটি আইনে পরিণত হয়। দীর্ঘ চার বছরের বেশি আগে পাস হলেও এই আইন বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সেই আন্দোলনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে বলা আছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে ভারতে প্রবেশ করা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এসব দেশ থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি ও খ্রিষ্টান, মোটকথা মুসলমান বাদে উল্লিখিত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা উল্লেখ আছে। তবে এসব শরণার্থীকে কিছু প্রামাণ্য নথি দিতে হবে। আবেদনকারীর কাছে যদি নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য প্রামাণ্য নথি না থাকে, তাহলে জেলা স্তরে থাকা যাচাই-কমিটি বাড়তি নথি জমা দিতে বলতে পারে। কিন্তু এর পরও দিতে না পারলে, সেই আবেদন খারিজ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ধরে নেওয়া হবে, নাকি ফের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হবে, সে বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট নয়। তাতে মনে হতেই পারে, যে ব্যক্তি আবেদন করবেন তিনি নিজে থেকেই স্বীকার করে নিলেন যে তিনি সে দেশে অনুপ্রবেশকারী। এখন তার আবেদন খারিজ হলে তিনি কি অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই সে দেশে বসবাস করার সুযোগ পাবেন; নাকি তাকে বিতাড়িত করা হবে, এ বিষয়টিও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে না পারলে আবেদনকারীদের কীভাবে সাহায্য করা যায়, সে বিষয়ে সরকার ‘পরে চিন্তাভাবনা করবে’ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
এই নির্বাচনে শুধু জিততে চাইছে না বিজেপি; তারা চাইছে এককভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে। যাতে শরিক দলের ওপরে নির্ভর না করেই সংবিধানে নানা পরিবর্তন আনতে পারে। ভারতের যে দুটো অঞ্চলে ভালো ফলাফল করতে না পারলে তারা দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে না, সেই পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলকে টার্গেট করেই ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণের কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে এই আইন বাস্তবায়ন করতে দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ওদিকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী অতি সূক্ষ্মভাবে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে তামিলবিরোধী তকমা দিয়েছেন, যা লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে বিজেপির জোটভুক্ত তামিল আঞ্চলিক দলগুলোও চরম অস্বস্তিতে পড়বে। মমতাও একই পথে হাঁটবেন সন্দেহ নেই। তিনি এরই মধ্যে এই আইনকে বাঙালি ও সংবিধানবিরোধী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
সংশোধিত নাগরিক আইনের আগে বিজেপি সরকার আসামে এনআরসি প্রণয়ন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল অনুপ্রবেশ করা বিদেশিদের, বিশেষ করে মুসলমানদের চিহ্নিত করে দেশ থেকে বহিষ্কার করা। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেছে, আসামে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাই বেশি। এরপর এটি বাতিল হয়ে যায়। তখন বিজেপি ঘোষণা দিয়েছিল, প্রথমে নাগরিকত্ব বিল আনা হবে এবং তা পাস করা হবে। বাস্তবে তাই-ই হয়েছে। অতঃপর এনআরসি আনা হবে এবং সেটা হবে সারা ভারতের জন্য। চার বছরে একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দু-তিন দিন আগে এই আইন বাস্তবায়ন করা থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যেই এটি করেছেন। তবে রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলো যে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তাতে নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাশিত ভোটের পাল্লা যদি ভারী না হয়, আশ্চর্য হব না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে