আয়বৈষম্য নিরসনের নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি

ড. মইনুল ইসলাম
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ১০: ৫৬

গত ১৩ এপ্রিল ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের প্রাথমিক ফলাফল পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই জরিপে বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগের মান নির্ধারিত হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৯৯। অতএব, এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বাংলাদেশ একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে এসে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণকারী একটি দেশ উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার মানে হলো দেশটি হাইজ্যাক হয়ে শ্রমজীবী জনগণের মালিকানার দেশ থেকে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের করায়ত্ত ‘শোষকের দেশে’ পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘মুক্তির সংগ্রামের’ মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে শ্রমজীবী জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির অঙ্গীকার। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০-২২ পর্বে করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ৫ শতাংশের কাছাকাছি ছিল এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। অতএব এটা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে।

কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে; ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। আয়বৈষম্য বৃদ্ধির এই মহাবিপদ এ দেশের ১৯৭৫-পরবর্তী শাসকমহল ডেকে এনেছে। দুঃখজনকভাবে আশির দশক থেকেই আয় ও সম্পদবৈষম্য ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ এবং জিনি সহগ অন্যতম। কোনো অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং শূন্য দশমিক ৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা শূন্য দশমিক ৫ অতিক্রম করে, তখন নীতিনির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক বাংলাদেশের জিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছিল শূন্য দশমিক ৪৮৩, যা ১৯৭৩ সালে ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৬। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে তা আরও বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮ মোতাবেক, ২০১২ থেকে ২০১৭, এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বর এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে; ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৫৫। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ডলারের (৩২৮ কোটি টাকা) বেশি নিট-সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের ‘আলট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ’ (ইউএইচএনডব্লিউ) ইনডিভিজুয়্যাল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অতএব, শেখ হাসিনার বর্তমান মন্ত্রিসভায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সংখ্যাধিক্যকে কাকতালীয় বলা যাবে না।

১৯৯১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সরকার পালাক্রমে এ দেশে ৩২ বছরের মধ্যে ৩০ বছর সরকারে আসীন থাকলেও দেশে আয়বৈষম্য নিরসনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না।

সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছানোর জানান দিচ্ছে, সেগুলো হলো: ১. দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতা-পিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২. দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩. দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি বাজারীকরণ হয়ে গেছে; ৪. ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপির হার বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫. দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৬. বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৭. ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটিতে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৮০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী; ৮. দেশে গাড়ি, বিশেষ করে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯. বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫. দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/ এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে। আবার অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের সন্তানদের জন্য মাদ্রাসা গড়ে তোলার হিড়িক চলছে; ১৬. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে এবং ১৭. দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

অথচ বর্তমান সরকার শুধু মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েই মাতামাতি করছে। আয়বৈষম্যের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের এই দুঃখজনক অমনোযোগ অগ্রহণযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বেড়ে দেশটি একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে, তা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবিলা করা দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, গণচীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইসরায়েল ও শ্রীলঙ্কা নানা রকম কার্যকর আয় পুনর্বণ্টন কার্যক্রম গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিনি সহগ বৃদ্ধিকে শ্লথ করতে বা থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে কিউবা, গণচীন ও ভিয়েতনাম এখনো নিজেদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, বাকি দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য-নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে। ওপরের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সফল ভূমি সংস্কার অথবা কৃষি সংস্কার নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে। বৈষম্য-সচেতন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে কয়েকটি বিষয়ে মিল দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হলো: 

১. রাষ্ট্রগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল লেভেলের শিক্ষায় একক মানসম্পন্ন, সর্বজনীন, আধুনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে। 
২. অত্যন্ত সফলভাবে জনগণের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু আছে। 
৩. প্রবীণদের পেনশনব্যবস্থা চালু আছে। 
৪. সর্বজনীন বেকার ভাতা চালু আছে।
৫. নিম্নবিত্ত জনগণের জন্য ভর্তুকি মূল্যে রেশন বা বিনা মূল্যে খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি চালু আছে।
৬. প্রবীণ জনগণের আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা চালু আছে। 
৭. গণপরিবহন সুলভ ও ব্যয়সাশ্রয়ী এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়।
৮. ‘জিরো টলারেন্স অগ্রাধিকার’ দিয়ে দুর্নীতি দমনে কঠোর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা চালু আছে। 
৯. ‘মেগা-সিটি’ উন্নয়নকে সফলভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে এবং গ্রাম-শহর ও আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে খুবই মনোযোগী।
১০. ‘ন্যূনতম মজুরির হার’ নির্ধারণ করে কঠোরভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা চালু আছে।
১১. নিম্নবিত্তদের আবাসনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
১২. কৃষকেরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পান, তার জন্য কার্যকর সরকারি নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে। 
১৩. ব্যক্তি খাতের বিক্রেতারা যেন জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারেন, সে জন্য রাষ্ট্র কঠোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।

ওপরে বর্ণিত নীতিগুলো সবই বাংলাদেশের জন্য সময়োপযোগী।

ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত