অরুণ কর্মকার
দেশে চলমান জ্বালানি-সংকট এবং এর অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে সৃষ্ট বিদ্যুৎ ঘাটতিজনিত সারা দেশে ভয়াবহ লোডশেডিং পরিস্থিতি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, একটি সাময়িক সমস্যা। সমস্যাটি নিঃসন্দেহে সাময়িক। কারণ, এই সমস্যা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকবে না। প্রকৃতির বদান্যতায় ইতিমধ্যে সমস্যার তীব্রতা কমতেও শুরু করেছে। শিগগির আরও কমবে। কিন্তু বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার মৌসুমে, প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে এই লোডশেডিং জনজীবনে যে বিপর্যস্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তাতে সরকারের শাসনব্যবস্থার দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের যৌক্তিকতা এবং ভাবমূর্তিতে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এই ক্ষত যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, বহু বছর ধরে যে এই কঠিন পরিস্থিতির কথা উদাহরণ হিসেবে বলাবলি হবে, সে কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। শুধু তা-ই নয়, আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি-সংকটের মধ্যেও পড়ে গেছি।
আমাদের দেশে সরকারের যেকোনো সাফল্য, এমনকি বিদ্যুৎ খাতের মতো দৃশ্যমান ও সুদূরপ্রসারী সাফল্যও আস্থায় না নেওয়া বা বিশ্বাস না করা লোকের সংখ্যা অগণিত। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যকেও তাঁরা সর্বদা বাঁকা চোখেই দেখে এসেছেন। এই শ্রেণির লোকের কথা বাদ দিলেও এখন এমন লোক দেশে খুব কম পাওয়া যাবে যাঁরা সরকারের ওই সাফল্যকে টেকসই বলে মনে করেন। বর্তমান জ্বালানি-সংকট এবং সেই কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়কর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সরকারের সাফল্যে অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বিশ্বাসীদেরও প্রায় একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরকারের জন্য ক্ষতটা এখানেই। এই ক্ষত সরকারের সব কাজের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে রাখবে। এই ক্ষত সারিয়ে তোলা সরকারের জন্য খুব সহজ কাজ হবে না।
আরেকটি বিষয় হলো, সরকার যে সমস্যাটিকে সাময়িক বলছে, সেটি হচ্ছে লোডশেডিং। হ্যাঁ, লোডশেডিং একটি সাময়িক সমস্যাই বটে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে পায়রা কেন্দ্রের জন্য কয়লা চলে আসবে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি থেকেও এই মাসের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। একই সময়ে ভারতের আদানি গ্রুপের ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হলে সেখান থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি বাড়বে। সর্বোপরি শুরু হয়ে যাবে বর্ষা মৌসুম। বৃষ্টি নামবে প্রকৃতির করুণাধারা হয়ে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদাও কমবে। সুতরাং লোডশেডিং সাময়িকই বটে।
কিন্তু এ কথা সবারই মনে রাখা উচিত যে পায়রা, বাঁশখালী, রামপাল তথা দেশের অভ্যন্তরের যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বারবার কয়লা এবং অন্যান্য জ্বালানি আনতে হবে। আনতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) লাগবে। এবার যেমন ডলারের অভাবে সময়মতো কয়লা আনতে না পারায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হলো, তেমনি ভবিষ্যতেও ডলার-সংকট হলে একই ঘটনা ঘটবে। আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার যে শিগগির খুব সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, তেমন সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। অতএব লোডশেডিংয়ের সাময়িক সমস্যাটি বারবার ফিরে আসার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতিটি জ্বালানিই আমরা এখন আমদানি করছি। যেমন কয়লা, ফার্নেস তেল, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রভৃতি। এরপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করতে হবে ইউরেনিয়াম। এর যে কোনোটি আমদানির জন্যই ডলার অপরিহার্য। কাজেই বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ করা আমাদের জন্য অতীব জরুরি। এর মধ্যে আরেকটি বিষয় হলো, এলএনজি আমদানি। প্রথমত, এলএনজি আমদানির জন্য অবকাঠামোগত সক্ষমতা আমাদের সীমিত। দৈনিক সর্বোচ্চ ১ হাজার মিলিয়ন বা ১০০ কোটি ঘনফুট। আর দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতাও সীমিত এবং ক্রমহ্রাসমান। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানির ওপর চাপ অপেক্ষাকৃত বেশি।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের জ্বালানি-সংকট কি আমাদের জন্য অবধারিত কিংবা অনিবার্য ছিল? এর কারণই-বা কী? সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা—মানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই যুদ্ধ শুরুতে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক রকম বাড়িয়ে দেয়। ডলারের দামও আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। এখন জ্বালানির দাম কমলেও ডলার-সংকটের কারণে তা প্রয়োজন অনুযায়ী আনা যাচ্ছে না। সরকারের এই বক্তব্যে মনে হতে পারে যে এই সংকট অনিবার্য ছিল। সরকারের তেমন কিছুই করার ছিল না, কিংবা বলা যায়, পরিস্থিতির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
কিন্তু এই সংকটময় পরিস্থিতির একটি দেশীয় প্রেক্ষাপটও আছে। সেই প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে সংকটের ভিন্ন একটি কারণ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই—সেটি হলো, দেশের জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা। এই অনীহা এমন পর্যায়ের, যাকে উপেক্ষা করাও বলা যায়। অথচ বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকার যেমন স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ধারাবাহিকভাবে তা বাস্তবায়ন করেছে, তেমনি দেশের জ্বালানি সম্পদ উন্নয়নের কাজটিও করা হলে পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ যত যা কিছুই হোক না কেন, আমাদের জ্বালানি-সংকট বর্তমান পর্যায়ে কখনোই পৌঁছাত না। নিজেদের জ্বালানি সম্পদ দিয়েই আমাদের চাহিদার শতভাগ বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হতো।
আমরা স্মরণ করতে পারি যে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের নিজস্ব ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা ছিল দৈনিক ১ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন সরকারের উদ্যোগে যখন দ্রুত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হতে লাগল, তখন গ্যাসের চাহিদাও দ্রুত বাড়তে লাগল। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়। তখন মূলত বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে শেভরন সিংহভাগ উত্তোলন বাড়ায়। ফলে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা দৈনিক ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়। তারপর উত্তরোত্তর আরও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো কিংবা নতুন অনুসন্ধানের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে দেশের ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন এখন ২ হাজার ১০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। অন্যদিকে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এলএনজি আমদানির। ডলার-সংকটে সেই আমদানিই এখন সরকার এবং জনগণের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।
ইতিমধ্যে জ্বালানি-সংকট তীব্রতর হয়ে উঠলে গত বছর সরকার তিন বছর মেয়াদি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়। সেই অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৪টি কূপ (অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং সংস্কারসহ) খননের মাধ্যমে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে মোট ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর কাজ চলমান। অবশ্য এ কাজ ২০২৪ সালের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে বলে পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা গেছে। এই পদক্ষেপের ফল হিসেবে ইতিমধ্যে কয়েকটি কূপে কিছু গ্যাস পাওয়াও গেছে। এর মধ্যে ভোলায় পাওয়া গেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস। কিন্তু সেই গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনার অবকাঠামো না থাকায় চলমান সংকট নিরসনে এর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
তবে সরকার প্রচারের জন্য হোক কিংবা কাজ দেখানোর জন্য হোক, ভোলা থেকে কিছু গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তর করে ঢাকায় আনার জন্য একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তির অধীনে যে পরিমাণ গ্যাস আনা সম্ভব হবে, তা ঘাটতি পূরণের সামান্যতম কাজেও আসবে না। যেখানে তিতাসের বিতরণ এলাকায় দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে আগামী সেপ্টেম্বরে সিএনজি আকারে আসবে পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট। এরপর আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ আসবে আরও ২০ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট ভোলা থেকে সিএনজি আকারে আনা সম্ভব হবে।
সরকার যদি ২০১৮ সাল থেকেও দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিত এবং আজ যদি আমাদের হাতে আর এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস থাকত, তাহলে আমরা কোনো জ্বালানি-সংকটেই পড়তাম না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য, বর্তমানে দেশে গ্যাসের সর্বোচ্চ চাহিদা দৈনিক চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে তিন হাজার মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশের ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস ২ হাজার ১০০ মিলিয়ন এবং আমদানি করা এলএনজি ৯০০ মিলিয়ন। দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে এখন যদি তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটও উত্তোলন করা যেত, তাহলে গ্যাস দিয়েই আমরা ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতাম।
দেশের কয়লা উত্তোলনের কথা বাদ দিলেও আমদানি করা কয়লা এবং জ্বালানি তেল স্বল্প পরিমাণে ব্যবহার করে খুব সহজেই আরও তিন-চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। সে জন্য ডলার-সংকট কোনো সমস্যাই সৃষ্টি করতে পারত না। এ ছাড়া সরকার কম দামে রাশিয়ার তেল কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কূটনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হতে পারত বলেও অনেকের বিশ্বাস। এসব পদক্ষেপের পরিবর্তে সরকার যে শুধু জ্বালানি আমদানির দিকেই ঝুঁকে থাকল, তার ফলই হলো বর্তমান সংকট। সেই সংকট সরকারের জন্য এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কতটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
দেশে চলমান জ্বালানি-সংকট এবং এর অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে সৃষ্ট বিদ্যুৎ ঘাটতিজনিত সারা দেশে ভয়াবহ লোডশেডিং পরিস্থিতি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, একটি সাময়িক সমস্যা। সমস্যাটি নিঃসন্দেহে সাময়িক। কারণ, এই সমস্যা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকবে না। প্রকৃতির বদান্যতায় ইতিমধ্যে সমস্যার তীব্রতা কমতেও শুরু করেছে। শিগগির আরও কমবে। কিন্তু বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার মৌসুমে, প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে এই লোডশেডিং জনজীবনে যে বিপর্যস্ত অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তাতে সরকারের শাসনব্যবস্থার দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের যৌক্তিকতা এবং ভাবমূর্তিতে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এই ক্ষত যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, বহু বছর ধরে যে এই কঠিন পরিস্থিতির কথা উদাহরণ হিসেবে বলাবলি হবে, সে কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। শুধু তা-ই নয়, আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি-সংকটের মধ্যেও পড়ে গেছি।
আমাদের দেশে সরকারের যেকোনো সাফল্য, এমনকি বিদ্যুৎ খাতের মতো দৃশ্যমান ও সুদূরপ্রসারী সাফল্যও আস্থায় না নেওয়া বা বিশ্বাস না করা লোকের সংখ্যা অগণিত। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যকেও তাঁরা সর্বদা বাঁকা চোখেই দেখে এসেছেন। এই শ্রেণির লোকের কথা বাদ দিলেও এখন এমন লোক দেশে খুব কম পাওয়া যাবে যাঁরা সরকারের ওই সাফল্যকে টেকসই বলে মনে করেন। বর্তমান জ্বালানি-সংকট এবং সেই কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়কর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সরকারের সাফল্যে অবিশ্বাসীদের সঙ্গে বিশ্বাসীদেরও প্রায় একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরকারের জন্য ক্ষতটা এখানেই। এই ক্ষত সরকারের সব কাজের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে রাখবে। এই ক্ষত সারিয়ে তোলা সরকারের জন্য খুব সহজ কাজ হবে না।
আরেকটি বিষয় হলো, সরকার যে সমস্যাটিকে সাময়িক বলছে, সেটি হচ্ছে লোডশেডিং। হ্যাঁ, লোডশেডিং একটি সাময়িক সমস্যাই বটে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে পায়রা কেন্দ্রের জন্য কয়লা চলে আসবে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটি থেকেও এই মাসের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। একই সময়ে ভারতের আদানি গ্রুপের ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হলে সেখান থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি বাড়বে। সর্বোপরি শুরু হয়ে যাবে বর্ষা মৌসুম। বৃষ্টি নামবে প্রকৃতির করুণাধারা হয়ে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদাও কমবে। সুতরাং লোডশেডিং সাময়িকই বটে।
কিন্তু এ কথা সবারই মনে রাখা উচিত যে পায়রা, বাঁশখালী, রামপাল তথা দেশের অভ্যন্তরের যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বারবার কয়লা এবং অন্যান্য জ্বালানি আনতে হবে। আনতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) লাগবে। এবার যেমন ডলারের অভাবে সময়মতো কয়লা আনতে না পারায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হলো, তেমনি ভবিষ্যতেও ডলার-সংকট হলে একই ঘটনা ঘটবে। আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার যে শিগগির খুব সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, তেমন সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। অতএব লোডশেডিংয়ের সাময়িক সমস্যাটি বারবার ফিরে আসার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতিটি জ্বালানিই আমরা এখন আমদানি করছি। যেমন কয়লা, ফার্নেস তেল, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রভৃতি। এরপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করতে হবে ইউরেনিয়াম। এর যে কোনোটি আমদানির জন্যই ডলার অপরিহার্য। কাজেই বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ করা আমাদের জন্য অতীব জরুরি। এর মধ্যে আরেকটি বিষয় হলো, এলএনজি আমদানি। প্রথমত, এলএনজি আমদানির জন্য অবকাঠামোগত সক্ষমতা আমাদের সীমিত। দৈনিক সর্বোচ্চ ১ হাজার মিলিয়ন বা ১০০ কোটি ঘনফুট। আর দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতাও সীমিত এবং ক্রমহ্রাসমান। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য কয়লা ও জ্বালানি তেল আমদানির ওপর চাপ অপেক্ষাকৃত বেশি।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের জ্বালানি-সংকট কি আমাদের জন্য অবধারিত কিংবা অনিবার্য ছিল? এর কারণই-বা কী? সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা—মানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই যুদ্ধ শুরুতে বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক রকম বাড়িয়ে দেয়। ডলারের দামও আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। এখন জ্বালানির দাম কমলেও ডলার-সংকটের কারণে তা প্রয়োজন অনুযায়ী আনা যাচ্ছে না। সরকারের এই বক্তব্যে মনে হতে পারে যে এই সংকট অনিবার্য ছিল। সরকারের তেমন কিছুই করার ছিল না, কিংবা বলা যায়, পরিস্থিতির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
কিন্তু এই সংকটময় পরিস্থিতির একটি দেশীয় প্রেক্ষাপটও আছে। সেই প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে সংকটের ভিন্ন একটি কারণ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই—সেটি হলো, দেশের জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা। এই অনীহা এমন পর্যায়ের, যাকে উপেক্ষা করাও বলা যায়। অথচ বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকার যেমন স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ধারাবাহিকভাবে তা বাস্তবায়ন করেছে, তেমনি দেশের জ্বালানি সম্পদ উন্নয়নের কাজটিও করা হলে পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ যত যা কিছুই হোক না কেন, আমাদের জ্বালানি-সংকট বর্তমান পর্যায়ে কখনোই পৌঁছাত না। নিজেদের জ্বালানি সম্পদ দিয়েই আমাদের চাহিদার শতভাগ বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হতো।
আমরা স্মরণ করতে পারি যে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের নিজস্ব ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা ছিল দৈনিক ১ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন সরকারের উদ্যোগে যখন দ্রুত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হতে লাগল, তখন গ্যাসের চাহিদাও দ্রুত বাড়তে লাগল। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়। তখন মূলত বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে শেভরন সিংহভাগ উত্তোলন বাড়ায়। ফলে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা দৈনিক ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়। তারপর উত্তরোত্তর আরও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো কিংবা নতুন অনুসন্ধানের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে দেশের ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন এখন ২ হাজার ১০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। অন্যদিকে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এলএনজি আমদানির। ডলার-সংকটে সেই আমদানিই এখন সরকার এবং জনগণের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।
ইতিমধ্যে জ্বালানি-সংকট তীব্রতর হয়ে উঠলে গত বছর সরকার তিন বছর মেয়াদি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়। সেই অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৪টি কূপ (অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং সংস্কারসহ) খননের মাধ্যমে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে মোট ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর কাজ চলমান। অবশ্য এ কাজ ২০২৪ সালের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে বলে পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা গেছে। এই পদক্ষেপের ফল হিসেবে ইতিমধ্যে কয়েকটি কূপে কিছু গ্যাস পাওয়াও গেছে। এর মধ্যে ভোলায় পাওয়া গেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস। কিন্তু সেই গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনার অবকাঠামো না থাকায় চলমান সংকট নিরসনে এর কোনো ভূমিকা থাকবে না।
তবে সরকার প্রচারের জন্য হোক কিংবা কাজ দেখানোর জন্য হোক, ভোলা থেকে কিছু গ্যাস সিএনজিতে রূপান্তর করে ঢাকায় আনার জন্য একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তির অধীনে যে পরিমাণ গ্যাস আনা সম্ভব হবে, তা ঘাটতি পূরণের সামান্যতম কাজেও আসবে না। যেখানে তিতাসের বিতরণ এলাকায় দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে আগামী সেপ্টেম্বরে সিএনজি আকারে আসবে পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট। এরপর আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ আসবে আরও ২০ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট ভোলা থেকে সিএনজি আকারে আনা সম্ভব হবে।
সরকার যদি ২০১৮ সাল থেকেও দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিত এবং আজ যদি আমাদের হাতে আর এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস থাকত, তাহলে আমরা কোনো জ্বালানি-সংকটেই পড়তাম না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য, বর্তমানে দেশে গ্যাসের সর্বোচ্চ চাহিদা দৈনিক চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে তিন হাজার মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশের ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস ২ হাজার ১০০ মিলিয়ন এবং আমদানি করা এলএনজি ৯০০ মিলিয়ন। দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে এখন যদি তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটও উত্তোলন করা যেত, তাহলে গ্যাস দিয়েই আমরা ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতাম।
দেশের কয়লা উত্তোলনের কথা বাদ দিলেও আমদানি করা কয়লা এবং জ্বালানি তেল স্বল্প পরিমাণে ব্যবহার করে খুব সহজেই আরও তিন-চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। সে জন্য ডলার-সংকট কোনো সমস্যাই সৃষ্টি করতে পারত না। এ ছাড়া সরকার কম দামে রাশিয়ার তেল কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কূটনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হতে পারত বলেও অনেকের বিশ্বাস। এসব পদক্ষেপের পরিবর্তে সরকার যে শুধু জ্বালানি আমদানির দিকেই ঝুঁকে থাকল, তার ফলই হলো বর্তমান সংকট। সেই সংকট সরকারের জন্য এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কতটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যাবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে