প্রকল্প আছে, শিক্ষার্থী নেই, কেন্দ্রের বরাদ্দ আত্মসাৎ

ইলিয়াস আহমেদ, ময়মনসিংহ
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯: ৩৪
Thumbnail image

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র ২১৭টি। কিন্তু এর বেশির ভাগই মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ৩০ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে দু-একটি কেন্দ্রে হাতে গোনা শিক্ষার্থী ছাড়া বেশির ভাগ কেন্দ্রই শিক্ষক-শিক্ষার্থীশূন্য। তবু নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে।

ধর্মীয় শিক্ষায় শিশুদের অনুপ্রাণিত করতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এই প্রকল্প। গফরগাঁওয়ে নানা অনিয়মের পেছনে ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজারের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও অভিভাবকদের।

সম্প্রতি ক্লাস চলাকালে গফরগাঁও পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীবাড়ি জামে মসজিদসংলগ্ন প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রে কোনো শিক্ষার্থীকে পাওয়া যায়নি। রাস্তার পাশে কাপড় নাড়তে দেখা যায় শিক্ষক ছাহেরা আক্তারকে। কেন্দ্রটি তাঁর ঘরের বারান্দায়। সেখানে একটি ভাঙা ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলানো অবস্থায় দেখা যায়।

শিক্ষার্থী না আসার কারণ জানতে চাইলে শিক্ষক ছাহেরা আক্তার বলেন, এখন সকাল ১০টা বাজে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে ক্লাস চলে বেলা ১১টা পর্যন্ত। গত কয়েক দিন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছিল। আজকে কয়েকজন শিক্ষার্থী ঠান্ডা-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছে। তাই সবাইকে একটু আগেই ছুটি দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় মহিলা কলেজসংলগ্ন জামে মসজিদ সহজ কোরআন শিক্ষা কেন্দ্রটি। এই কেন্দ্রে সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ক্লাস হওয়ার কথা। স্থানীয়দের অভিযোগ, কেন্দ্রটির শিক্ষক রফিকুল ইসলাম একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করে থাকেন। মাঝেমধ্যে মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে এসে সেখানে ক্লাস করান। কেন্দ্রসংলগ্ন দোকানি রুহুল আমিন বলেন, নিয়মিত ক্লাস করানো হয় না বলে কেন্দ্রটির শিক্ষক রফিকুল ইসলামকে বছর দেড়েক আগে থেকেই বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো তাঁর মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থী এনে ক্লাস করাচ্ছেন। স্থানীয় শিশুদের তিনি খুব একটা পড়ান না। তার পরও তাঁর নামে নিয়মিত বেতন-ভাতা হচ্ছে।

বাঁশতলা শিলাসী মহিলা কলেজ রোড প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষক তানজিনা আক্তারের পরিবর্তে দুজন শিক্ষার্থীকে ক্লাস করাচ্ছেন নাহিদা সুলতানা স্বর্ণা নামের আরেকজন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বর্ণা বলেন, এই কেন্দ্রের শিক্ষক তানজিনা আক্তারের কোনো সমস্যা হলে মাঝেমধ্যে তিনি ক্লাস করান। শিক্ষার্থী কম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ ঠান্ডা শুরু হয়েছে; তাই কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এমনিতে ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫ থেকে ২০ জন নিয়মিত আসে বলে দাবি তাঁর।

তবে কিছুটা ব্যতিক্রম পাওয়া যায় চর ষোলহাসিয়া নদীর পাড় মক্তব কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ১২ জন শিক্ষার্থীকে ক্লাস করাচ্ছেন শিক্ষক মোছা. উম্মে সালমা। তিনি বলেন, তাঁর কেন্দ্রটিতে নিয়মিত ১৫ থেকে ২৫ জন করে শিক্ষার্থী আসে। সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে; বাকি পাঁচ দিন ক্লাস হয়।

পৌরসভার জামতলা মোড় জামে মসজিদে সহজ কোরআন শিক্ষা কেন্দ্রের সাবেক শিক্ষক ইয়াসির খান বলেন, ‘আমার মসজিদের পাশেই উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকল্পের ফিল্ড সুপারভাইজার ইমদাদুল হক স্যারের বাসা। তিনি বাসা নির্মাণ করার সময় অনেক শিক্ষককে দিয়ে কাজ করাতেন। আমাকে একদিন কাজ করার জন্য বললে আমি না করি। এতে হয়তো ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আমার মসজিদের কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর কথা ছাড়া কোনো কেন্দ্রেই কিছু হয় না। অনেকে ক্লাস না করিয়ে তাঁকে ম্যানেজ করে বেতন উত্তোলন করছেন।’

জামতলা মোড়ের স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইলিয়াস বলেন, ‘সরকার যে উদ্দেশ্যে গফরগাঁওয়ে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্প চালু করেছিল, সেটি কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শুধু প্রকল্পের সুপারভাইজার আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। অধিকাংশ কেন্দ্র শিক্ষক-শিক্ষার্থীশূন্য থাকলেও নিয়মিত বেতন উত্তোলন করে ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে। আমরা চাই এসব প্রকল্প সঠিকভাবে চলুক, না হয় সরকার বন্ধ করে দিক।’

অভিযোগের বিষয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘গফরগাঁওয়ে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষার ২১৭টি কেন্দ্র সঠিকভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। তবে কিছু কেন্দ্রে সমস্যা রয়েছে; যার কারণে ২০টি কেন্দ্র বন্ধের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করা হয়েছে। আর কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন। স্থানীয় একজন আক্রোশে এসব আমার বিরুদ্ধে করাচ্ছে। আপনারা কোনো কেন্দ্রে অনিয়ম পেলে বলেন, আমি ব্যবস্থা নেব।’

দু-একটি কেন্দ্রে অনিয়মের কথা স্বীকার করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রের একজন করে শিক্ষককে সরকার মাসিক ৫ হাজার টাকা সম্মানী দিয়ে থাকেন। তার পরও কেন্দ্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী না থাকাসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে ফিল্ড সুপারভাইজার ইমদাদুল হকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও খতিয়ে দেখা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত