বাড়ছে দারিদ্র্য, পাল্লা দিচ্ছে ধনীর সংখ্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৪ মে ২০২২, ১৩: ২৮
Thumbnail image

আন্তর্জাতিক বেসরকারি সেবা সংস্থা অক্সফাম গতকাল সোমবার বলেছে, বর্তমানে বিশ্বে দুই হাজার ৬৬৮ জন শতকোটি ডলারের (বিলিয়নিয়ার) মালিক আছেন, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৫৭৩ জন বেশি। অর্থাৎ করোনা মহামারির সময় বিশ্বে ৫৭৩ ব্যক্তি নতুন করে বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। এসব বিলিয়নিয়ার মিলে ১২ দশমিক ৭ লাখ কোটি ডলারের মালিক।

এ ছাড়া করোনাকালে বিশ্বে ৯৯ ভাগ লোকের প্রকৃত আয় কমেছে উল্লেখ করে অক্সফাম বলছে, চলতি বছর নতুন করে বিশ্বে ২৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়ে যাবে। এই হিসাবে, এ বছর প্রতি ৩৩ ঘণ্টায় ১০ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সেবা সংস্থা অক্সফাম গতকাল জেনেভা থেকে প্রকাশিত ‘প্রফিটিং ফ্রম পেইন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পরিবেশন করেছে।

এতে বলা হয়, এই মুনাফা করার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খাতের কার্গিল ও লুই ড্রেফাস, সুপারমার্কেট চেইনশপ ওয়ালমার্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার, মডার্না এবং তেল কোম্পানি বিগ অয়েল। কার্গিল একাই বিশ্বের কৃষিপণ্য বিপণনের ৭০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। আর করোনাকালে শুধু ওষুধ খাতেই ৪০ জন নতুন বিলিয়নিয়ারের উত্থান হয়েছে বিশ্বে। বাংলাদেশের অবস্থা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, এই বিশ্বচিত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই। যেকোনো বিপদেই কিছু সুবিধাভোগী থাকে।এখানেও করোনা আর মানুষের বিপদের সময় কিছু লোক নতুন করে ধনী হয়েছেন। আবার গরিবের তো বটেই, ব্যাংকের চাকরিজীবীসহ সীমিত আয়ের বহু মানুষের আয় কমে গেছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধনীদের একরৈখিক সম্পর্কের বিন্যাস, একে পুঁজি করেই তাঁরা আরও ধনী হন। রাষ্ট্রই তাঁদের বিভিন্ন রকম ছাড় ও ভর্তুকি দেয়। এসব বন্ধ করলে অনেকেরই আর অত ধনী থাকার কথা নয়।

বাংলাদেশে এক কোটি টাকার বেশি জমা আছে এমন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২১) বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২৩৯টি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের একই সময়ে এ ধরনের ব্যাংক হিসাব ছিল ৮৭ হাজার ৪৯০টি। অর্থাৎ এক কোটি টাকার বেশি জমা আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা এক বছরে বেড়েছে ১২ হাজার ৭৪৯টি, যখন দেশের সীমিত আয়ের মানুষ করোনা মহামারির সময় আয়-বৈষম্য এবং উপযুক্ত চিকিৎসাসুবিধার অভাবসহ নানা সমস্যায় ভুগছিল।

ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি অনেক প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব একের অধিক গ্রাহক পরিচালনা করে থাকেন বলে দেশে কোটিপতির প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব না হলেও বেশ জটিল বলে মনে করেন ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ধনী হতে সাহায্য করেছে সরকার এ অবস্থাকে বিপর্যয় বলে উল্লেখ করে অক্সফাম বলছে, করোনায় বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি লোকের মারা যাওয়া ছাড়াও বৈষম্য হয়ে গেছে আকাশচুম্বী। এখন ধনীরা শুধু সুরক্ষিতই নন, তাঁরা এই সংকট থেকে মুনাফা লুটছেন। সরকারগুলো করোনাকালে খাবার, জ্বালানি, ওষুধ, স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল অঙ্কের টাকা ঢালায় ধনীরা সম্পদ বাড়িয়েছেন।

অক্সফাম বলছে, করোনা মহামারি, বাড়তে থাকা বৈশ্বিক আয়-বৈষম্য, খাবারের ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিলিয়নিয়াররা গত ২৪ মাসে এই মাত্রায় মুনাফা করেছেন, যা তাঁদের গত ২৩ বছরের আয়ের সমান। খাবার ও জ্বালানির মূল্য এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগে এ খাতের বিলিয়নিয়াররা মাত্র দুই দিনে এক শ কোটি ডলার মুনাফা করেছেন। এ খাতে ৬২ জন নতুন করে শতকোটি ডলারের মালিক বনে গেছেন।

সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের গতকাল শুরু হওয়া বার্ষিক সম্মেলনের সময় প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফোর্বস সাময়িকীতে প্রকাশিত বিলিয়নিয়ারদের তালিকা এবং বিশ্বব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে অক্সফাম। গরিবদের কী হবে ফোর্বস সাময়িকীর বিলিয়নিয়ার তালিকার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অক্সফাম বলছে, ময়দা, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎসহ সবকিছুতেই খরচ বাড়ছে বলে নিউইয়র্ক থেকে দিল্লি পর্যন্ত সর্বত্র সাধারণ মানুষ ভুগছে। খরচে ব্যাপক কাটছাঁট করতে হচ্ছে তাদের। পাতে খাবার ঠিক রাখতে অসুস্থতায় চিকিৎসা বাদ দিচ্ছে। কোনো বাচ্চাকে বিদ্যালয়ে পাঠাবেন, আর কাকে পাঠাবেন না—এ নিয়ে মা-বাবাকে বারবার ভাবতে হচ্ছে। জীবনযাত্রার খরচ করোনাকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব সম্প্রদায় ও সরকারগুলো গত ২০ বছরের মধ্যে গরিবি মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে পারেনি।

এ প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা বলে কার্যত কিছুই নেই, সেখানে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে গেছে। এখন সামাজিক নিরাপত্তা, রেশনিংসহ নানা উপায়ে ন্যূনতম খাদ্য জোগান ও স্বাস্থ্যসেবার দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। ধনীদের আরও ধনী হওয়ার রাশ টানতে রাষ্ট্রকেই নীতি বদলাতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন কর আরোপের সুপারিশ যাঁরা করোনাসহ বিভিন্ন সংকটকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করে কোটিপতি হয়েছেন, তাঁদের সম্পদের ওপর বার্ষিক ২ শতাংশ এবং যাঁরা শতকোটি ডলারের মালিক হয়েছেন, তাঁদের সম্পদের ওপর ৫ শতাংশ সংহতি কর আরোপের সুপারিশ করেছে অক্সফাম। এই করকে সংহতি কর অভিহিত করে সংগঠনটি বলছে, এর মাধ্যমে ২ লাখ ৫২ হাজার কোটি ডলার সংগ্রহ করা যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত