ধার দেওয়ার নামে নিয়মিত পাচার হয় চিকিৎসা সরঞ্জাম

রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ১৬
আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ৩০

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে নিয়মিত পাচার হয় চিকিৎসাসংক্রান্ত সরঞ্জাম। সম্প্রতি ৭২ পিস এফেরেসিস প্লাটিলেট কিট ও ৮০ পিস এসিডি প্যাক হাসপাতালের বাইরে পাচারকালে কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে। সেগুলোর মূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা। এই বিভাগে নিয়মিত ঘটছে আরও নানা অনিয়ম। পাচারের ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে ওই বিভাগে নিয়মিত এমন পাচারের তথ্য বেরিয়ে আসে।

জানা গেছে, গত ২০ জুলাই হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে ৯ বাক্স এফেরেসিস প্লাটিলেট কিট পাচারের উদ্দেশ্যে বের করা হয়। প্রতি বাক্সে ৮ পিস করে ৭২ পিস কিট ছিল। এর দাম ৯ লাখ টাকা। এরপর ২৭ আগস্ট একই প্রক্রিয়ায় বের করা হয় ৮০ পিস এসিডি প্যাক। এর দাম ৮০ হাজার টাকা। পাচারের সময় ওই বিভাগের মেডিকেল অফিসার শাহরিয়ার কাওসারের সিলসহ সই করা গেটপাস ছিল। তাতে লেখা ছিল ‘ডায়ামেড কোম্পানিকে ৯ বক্স কিট লোন দেওয়া হলো’।

রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের একাধিক কর্মী জানান, ওই বিভাগ থেকে প্রায়ই সরকারি সামগ্রী পাচার হয়। গেটপাসে সব সময়ই ধার দেওয়ার কথা লেখা থাকে। কিন্তু কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সামগ্রী বেসরকারি কোম্পানিকে ধার দেওয়ার নিয়ম নেই। এমনকি অন্য সরকারি হাসপাতালকে ধার দিতে হলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগে। এই বিষয়গুলো ইতিপূর্বে কর্তৃপক্ষের নজরে এলেও অজানা কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসবের পেছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। এ কারণেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বহাল রেখে তদন্ত করা হয়েছে, যাতে তাঁরা সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে সুযোগ পান।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২৭ আগস্ট কিট পাচারকালে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিনের নজরে পড়ে। তিনি একজন ওয়ার্ড মাস্টারকে বিষয়টি দেখতে বলেন। তাতেই পাচারের বিষয়টি ধরা পড়ে। এ বিষয়ে গত ৩০ আগস্ট হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর আলমকে সভাপতি করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গেটপাস দেওয়া চিকিৎসক শাহরিয়ার কাওসার তদন্ত কমিটিকে বলেন, ‘বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশে আমি গেটপাস দিয়েছি। তিনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই লিখেছি।’ 

হাসপাতালের একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে দামি কিট ও ব্লাড ব্যাগ চুরি করে বিক্রি করা এখানে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিভাগের দায়িত্বে থাকা মেডিকেল অফিসার ডা. হোমায়রা আলীম এবং ল্যাব ইনচার্জ (মেডিকেল টেকনোলজিস্ট) লায়লা খন্দকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে গরিব মানুষের চিকিৎসার জন্য কেনা কিটগুলো পাচার হয়। এ ছাড়া অনৈতিকভাবে নির্দিষ্ট কোম্পানি থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয় হেপাটাইটিস-বি, সি ভাইরাস, এইচআইভি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া নির্ণয়ের মেয়াদোত্তীর্ণ কিট। অন্যান্য কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম দামে রিএজেন্ট সরবরাহ করতে চাইলেও নেওয়া হয় না।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বলেন, এত বড় ইনস্টিটিউটের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন নন-ক্যাডার মেডিকেল অফিসার। সিন্ডিকেটের প্রভাবে তিনি সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের চেয়ার দখলে রেখেছেন। ইতিপূর্বে একাধিক সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপককে এখানে পদায়ন করা হলেও তাঁদের যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। বিভাগীয় প্রধান অফিসেও আসেন নামমাত্র। তাঁর কক্ষে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর স্বামী ডা. শামীম বহিরাগত লোকজন নিয়ে আড্ডা দেন। 
এ বিষয়ে জানতে সোমবার বিকেলে ডা. হোমায়রা আলীমকে ফোন করা হলে অন্য কেউ ধরেন। তিনি নিজেকে ডা. হোমায়রার স্বামী হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানান, হোমায়রা নেই।

জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ কিট কেনায় রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে সেবাগ্রহীতাদের রোগ নির্ণয়ের ভুল রিপোর্ট আসে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর শ্রীনিবাস (৪৫) নামের এক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসক এইচআইভি সন্দেহ করে তাঁর রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে পাঠান। কিন্তু ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর পরীক্ষায় এইচআইভি নেগেটিভ আসে। পরীক্ষার ক্রমিক নম্বর ছিল যথাক্রমে ৪২৮০৬ এবং ৪২৮৬৮। এরপর একটি বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষায় রিপোর্ট পজিটিভ আসে। ফলে হাসপাতালের চিকিৎসক আবারও রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে পাঠান। ২৭ সেপ্টেম্বর (৪২৯৮২ নম্বর) পরীক্ষায় তার এইচআইভি পজিটিভ আসে।

এদিকে সরঞ্জাম পাচার প্রসঙ্গে ডা. হোমায়রা আলীম তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত জবাবে বলেন, ‘৮০ পিস এসিডি প্যাক হাসপাতালের বাইরে নিতে কর্মরত ডাক্তার গেটপাস দেন এবং ল্যাব ইনচার্জ মালামাল বুঝিয়ে দেন। বিষয়টি আমি অবগত। হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ইতিপূর্বে বিভিন্ন নিয়মকানুনের মধ্যে চলার নির্দেশনা দেয়, যা কখনো ব্লাডব্যাংকে প্রযোজ্য ছিল না।’ অন্যদিকে তদন্ত কমিটিকে ডা. হোমায়রা মৌখিকভাবে জানান, এই কিট ও ফ্লুইডগুলো সিএমএসডি থেকে সরবরাহ করা হয়। সম্প্রতি কিছু কিটে সমস্যা থাকায় কিট ক্রাশ করে। সেগুলো ডায়ামেডকে জানানো হয়। তারা ত্রুটিযুক্ত সন্দেহজনক কিটের পরিবর্তে মানসম্পন্ন কিট দেয়। আগের বিভাগীয় প্রধানরাও এভাবেই পরিবর্তন করতেন। ল্যাব ইনচার্জ লায়লা খন্দকার বলেন, ‘বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশে ডায়ামেড প্রতিনিধি বাপ্পীকে এসব হস্তান্তর করি।’

তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ডা. হোমায়রা এ ধরনের নির্দেশ দিতে পারেন না। এসব কিট ও ফ্লুইড বাইরে নেওয়ার আগে অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে একটি স্থানীয় নিরীক্ষার পরামর্শ দেয় কমিটি।

এসব বিষয়ে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ স্বাধীন এবং এটি নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইনের অধীনে পরিচালিত। তবে যেহেতু তাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত