হাসান মামুন
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিণতিতেই হাসিনা সরকারের পতন হবে, এটা সম্ভবত কেউই ভাবতে পারেননি। আন্দোলনকারী নেতারাও নন। আর সরকারটি তো ছিল ‘অতি আত্মবিশ্বাসী’। যেনতেনভাবে তিন-তিনটি নির্বাচন সেরে ফেলে ক্ষমতা ধরে রাখার আনন্দে ছিল আত্মহারা। সেটা প্রকাশ পেত রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত নেতাদের কথাবার্তায়; এমনকি সরকার-সমর্থকদের নিত্য আলাপে। তাঁরা সবাই করুণভাবে বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, দেশটির মালিক জনগণ। আর এ দেশে ন্যূনতম হলেও একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল। সেটা ধ্বংস করা আনন্দের বিষয় নয়; গৌরবের তো নয়ই।
এ অবস্থায় যে জনবিচ্ছিন্নতা ঘটে, সে-বিষয়ক উপলব্ধিও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলে এ বোধ কিছুটা থাকলেও তার কোনো মূল্য ছিল না দেশ পরিচালনাকারী ‘রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের’ কাছে। এর কাছে দলটা হয়ে পড়েছিল কেবল ‘জিন্দাবাদ’ দেওয়ার বস্তু। এর দুর্বৃত্ত অংশটাকে অবশ্য মাঝে মাঝেই নামানো হতো এমনকি নিরীহ প্রতিবাদ দমনে। এ ধারায় রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক মোকাবিলা বাদ দিয়ে ‘পিটিয়ে দেওয়ার কৌশল’ প্রয়োগ করতে গিয়েই তো কোটা আন্দোলনকে বিস্তৃত করা হলো ক্যাম্পাসের বাইরে। রংপুরে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে ইতিহাস হয়ে গেল আবু সাঈদ। একমাত্র সে-ই তার পরিবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উঠে এসেছিল। অদম্য সাহসী এ তরুণ ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ একজন সমন্বয়ক।
তার নজিরবিহীন আত্মবলিদানকেও হালকা করে দেখেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আশুরার দিনে কালো শাড়ি পরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এলেও তিনি সেটা আসলে দিয়েছিলেন নিজ সমর্থকদের উদ্দেশে। কোনো উপলব্ধির প্রকাশ ছিল না তাতে; ছিল না সংকট মোকাবিলার কোনো চেষ্টা। ঘনিয়ে আসা দুর্যোগের বিষয়েও কোনো ধারণা ছিল না। তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিতদেরও কি ছিল না? তাঁরা হয়তো ছিলেন আরও আত্মবিশ্বাসী! এত আত্মবিশ্বাস এসেছিল কোত্থেকে? সম্ভবত সেটা এসেছিল যেনতেন নির্বাচন করে করে প্রচণ্ড প্রতাপে দেশটা চালিয়ে যেতে পারার অভিজ্ঞতা থেকে। এ ক্ষেত্রে মাঠের বিরোধী দলটির কার্যকর আন্দোলন রচনায় উপর্যুপরি ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়। ওয়ান-ইলেভেনের সুবাদে প্রবলভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর মাঠে তাদের দাঁড়াতেই দেয়নি হাসিনা সরকার। সেটাকে ‘স্মার্টনেস’ বলে বর্ণনাও করা হচ্ছিল। কার্যত কোনো বিরোধী দল-মতকেই তাঁরা দাঁড়াতে দেননি।
ফেসবুকে বিচ্ছিন্নভাবে বিরূপ স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কতজনকে! তাঁদের একজন মোশতাককে মেরেই ফেলা হয় ভয়াবহ নির্যাতন করে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সরকারবিরোধী লিফলেট বিতরণকারী একজন সাবেক পেশাজীবীকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে বসেন তৃণমূলের এক আওয়ামী লীগ নেতা! সরকারবিরোধিতা যেন হয়ে গিয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। সেটাকে এভাবে বর্ণনাও করা হতো সাজানো টক শোতে। এই সব ঘটনায় জনমনে, বিশেষত তরুণমনে কী প্রতিক্রিয়া পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, সেটা বিবেচনা করে দেখার মতো বোধ দ্রুত হারিয়ে গিয়েছিল হাসিনা সরকারের ভেতর থেকে। এই বোধ থাকলে তো কোটা সংস্কারের মতো ইস্যু ঘিরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না, যা সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এটা কিন্তু ছিল অবিশ্বাস্য। ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে পরে এসে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের কাছেও ছিল অবিশ্বাস্য।
আওয়ামী লীগের কঠোর অনুগামী ছাড়া কে এসে যোগ দেয়নি আন্দোলনে? সরকার, বিশেষত সরকারপ্রধানের কথা ও কাজে দীর্ঘদিন ধরে বিরক্ত আর অপমানিত নিরীহ মানুষটিও নেমে এসেছিল রাজপথে। ঘরে ঘরে স্কুলপড়ুয়াদেরও আটকে রাখা যাচ্ছিল না, যারা কোটা বিষয়ে আদৌ অবহিত নয়। তারা নেমে এসেছিল বন্ধু কিংবা বড় কোনো ভাই পুলিশের গুলিতে হতাহত হয়েছে শুনে। পীরগঞ্জের ছেলে আবু সাঈদের আত্মাহুতির মর্যাদা দিতে নেমে এসেছিল রাজধানীর ফাস্টফুড খাওয়া ছেলেমেয়েরা। একটা সরকার কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হলে আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার নামায় আর কুক্ষিগত মিডিয়ায় একশ্রেণির পেশাজীবীকে নামিয়ে দেয় কেবল ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিতে! এ অবস্থায় একটা অনির্বাচিত সরকারকে যারা দীর্ঘদিনেও নামাতে পারেনি, তারা স্বভাবতই বসে থাকেনি। এদের ‘তৃতীয় শক্তি’ বলে অব্যাহত প্রচারও হালে পানি পায়নি তখন। অবশেষে সরকারকে যেতেই হলো অগণিত ছাত্র-জনতার রক্তে হাত রাঙিয়ে।
পদত্যাগ করে নিরাপদে সরে যেতেও অনেক দেরি করছিলেন শেখ হাসিনা। এসব কাহিনি পড়ে এখন বিস্মিত হতে হয়। তোতাপাখির মতো খালি বলা হতো, ‘এ দেশ শ্রীলঙ্কা হবে না’! দেশের অর্থনীতির অবস্থা যে শ্রীলঙ্কার মতোই করে ফেলা হয়েছে, সে বোধও ছিল না তাঁদের। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল শ্রীলঙ্কার চেয়ে খারাপ। ওখানে তো আর যা-ই হোক, ছিল একটা নির্বাচিত সরকার। অপরাধের চেয়ে তাঁরা বেশি করেছিলেন ভুল। তারপরও দুর্দশায় নিপতিত জনতা তাঁদের রেহাই দেয়নি। হাসিনা সরকারের পতনের পর গণভবনে যা যা ঘটেছে, তাতে অনুসৃত হয়েছে শ্রীলঙ্কানদের দৃষ্টান্ত। অনেক ঘটনাই অরুচিকর সন্দেহ নেই; কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের শেষদিকে কে এসব রুখবে! কে রুখবে সরকারের দলীয় ক্যাডারে পরিণত হওয়া পুলিশ বাহিনীর প্রতি নজিরবিহীন গণরোষ? দুই লাখেরও বেশি পুলিশ সদস্যের একটা দল কার্যত পলাতক হয়ে গেল সরকারপ্রধান দেশ থেকে পালানোর সঙ্গে সঙ্গে। জানি না, বিশ্বের কোথাও এমন পরিণতি হয়েছে কি না, কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর। এ অবস্থায় আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণে হয়েছে বিলম্ব। তাতেও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে দেশে। এতে অনেক নিরীহ মানুষও আক্রান্ত হয়েছে বেদনাদায়কভাবে।
আন্দোলনে ভূমিকা রাখা কোনো কোনো গোষ্ঠী এটাকে নিজেদের বিজয় ভেবে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী কর্মকাণ্ডও চালিয়েছে। এসব বেদনাদায়ক ঘটনায় নিন্দা জানানোও এখন কঠিন মনে হচ্ছে! অথচ এটা সহজেই এড়ানো যেত কোটা-প্রশ্নে সহজ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে কোনো উপরচালাকির আশ্রয় না নিলে। আন্দোলনকারীরা সংস্কার চাইলেও বিরক্ত হয়ে বা রাগ করে কোটা একেবারে বাতিল করে দেওয়া; বহুদিন পর তা নিয়ে আবার নতুন খেলায় মেতে ওঠা—এসব কেউ মেনে নেয়নি। অতঃপর গোটা একটা প্রজন্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা এবং ঘোষণা দিয়ে গুণ্ডা নামিয়ে পিটিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিটাই আসলে সূত্রপাত করে সরকার পতনের। পতনের পরও অবশ্য ফিরে আসা যায়। কিন্তু কী বলবেন তাঁরা সেই প্রজন্মকে, যারা বিগত সরকারের আমলে ভোটাধিকার প্রয়োগেরই সুযোগ পায়নি? কী বলে ভোট চাইবেন এমনকি তাদের অভিভাবকদের কাছে? একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে গিয়ে হাসিনা সরকার যে আচরণ করল, সেটা বলতে গেলে বিস্ময়কর। এটা বহুদিন গল্পকাহিনির মতো করে ছড়াবে যাদের বোধবুদ্ধি এখনো হয়নি—তাদের মধ্যেও।
পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর অনুগামী দল আওয়ামী লীগ আজ মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি। রাজনীতিতে ফিরে আসাটা তাঁদের জন্যও কঠিন করে দিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা—যাঁরা বড় কোনো অপরাধে না জড়িয়ে এত দিন দলটা করে আসছিলেন। দলটিকে যাঁরা কেবল ‘আদর্শগত কারণে’ সমর্থন করেন, তাঁরাও এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। সবকিছুর পরও তাঁদের সংখ্যা কি কম? তাঁদের পক্ষেও এখন জাস্টিফাই করা কঠিন যে, কেন দেশে তিন-তিনটি যেনতেন নির্বাচন করা হয়েছিল? গণতন্ত্রের বিনিময়ে উন্নয়ন সামনে এনে অপশাসনকে আড়ালের চেষ্টাও আর হালে পানি পাবে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে দুর্নীতির বিপুল আয়োজনও এখন সবার সামনে আসবে। এ নিয়ে জোরালোভাবে আলোচনাও কঠিন ছিল হাসিনা সরকারের আমলে। সত্য উচ্চারণের দায়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরাও প্রকাশ্যে আক্রান্ত হতেন খোদ শেখ হাসিনা দ্বারা। সে জন্য তিনি অবশ্য পেতেন দল বেঁধে এই সব অনুষ্ঠানে সমবেত চাটুকারদের করতালি।
১৫ আগস্টের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা যেদিন ফিরে এসেছিলেন বিপর্যস্ত দলটির হাল ধরতে, সেই দিনটির কথা নিশ্চয় অনেকের মনে আছে। বৃষ্টির মধ্যে বহু লোক হাজির হয়েছিল কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে। কী অসাধারণ ছিল তাঁর ফিরে আসা! ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসাটাও কী চমৎকার ছিল! এ দেশের মানুষ আরও একবার তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিল বিপুলভাবে জিতিয়ে। তিনি কিংবা তাঁর পরিবার অথবা তাঁর দেশি-বিদেশি উপদেষ্টারা এই মানুষদের ‘অকৃতজ্ঞ’ বলবেন কোন মুখে? অকৃতজ্ঞ তো বরং তিনি; কেননা এ দেশের মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু কেড়ে নিতেও তাঁর বুক কাঁপেনি। মেয়াদের পর মেয়াদ এ পথে চলার পরিণতি নিয়েও ছিল না কোনো উপলব্ধি। ১৭-১৮ কোটি মানুষের একটা দেশ তা কত দিন মেনে নেবে, এটা একবারও ভাবার ফুরসত হলো না!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিণতিতেই হাসিনা সরকারের পতন হবে, এটা সম্ভবত কেউই ভাবতে পারেননি। আন্দোলনকারী নেতারাও নন। আর সরকারটি তো ছিল ‘অতি আত্মবিশ্বাসী’। যেনতেনভাবে তিন-তিনটি নির্বাচন সেরে ফেলে ক্ষমতা ধরে রাখার আনন্দে ছিল আত্মহারা। সেটা প্রকাশ পেত রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত নেতাদের কথাবার্তায়; এমনকি সরকার-সমর্থকদের নিত্য আলাপে। তাঁরা সবাই করুণভাবে বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, দেশটির মালিক জনগণ। আর এ দেশে ন্যূনতম হলেও একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল। সেটা ধ্বংস করা আনন্দের বিষয় নয়; গৌরবের তো নয়ই।
এ অবস্থায় যে জনবিচ্ছিন্নতা ঘটে, সে-বিষয়ক উপলব্ধিও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলে এ বোধ কিছুটা থাকলেও তার কোনো মূল্য ছিল না দেশ পরিচালনাকারী ‘রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের’ কাছে। এর কাছে দলটা হয়ে পড়েছিল কেবল ‘জিন্দাবাদ’ দেওয়ার বস্তু। এর দুর্বৃত্ত অংশটাকে অবশ্য মাঝে মাঝেই নামানো হতো এমনকি নিরীহ প্রতিবাদ দমনে। এ ধারায় রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক মোকাবিলা বাদ দিয়ে ‘পিটিয়ে দেওয়ার কৌশল’ প্রয়োগ করতে গিয়েই তো কোটা আন্দোলনকে বিস্তৃত করা হলো ক্যাম্পাসের বাইরে। রংপুরে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে ইতিহাস হয়ে গেল আবু সাঈদ। একমাত্র সে-ই তার পরিবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উঠে এসেছিল। অদম্য সাহসী এ তরুণ ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ একজন সমন্বয়ক।
তার নজিরবিহীন আত্মবলিদানকেও হালকা করে দেখেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আশুরার দিনে কালো শাড়ি পরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এলেও তিনি সেটা আসলে দিয়েছিলেন নিজ সমর্থকদের উদ্দেশে। কোনো উপলব্ধির প্রকাশ ছিল না তাতে; ছিল না সংকট মোকাবিলার কোনো চেষ্টা। ঘনিয়ে আসা দুর্যোগের বিষয়েও কোনো ধারণা ছিল না। তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিতদেরও কি ছিল না? তাঁরা হয়তো ছিলেন আরও আত্মবিশ্বাসী! এত আত্মবিশ্বাস এসেছিল কোত্থেকে? সম্ভবত সেটা এসেছিল যেনতেন নির্বাচন করে করে প্রচণ্ড প্রতাপে দেশটা চালিয়ে যেতে পারার অভিজ্ঞতা থেকে। এ ক্ষেত্রে মাঠের বিরোধী দলটির কার্যকর আন্দোলন রচনায় উপর্যুপরি ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়। ওয়ান-ইলেভেনের সুবাদে প্রবলভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর মাঠে তাদের দাঁড়াতেই দেয়নি হাসিনা সরকার। সেটাকে ‘স্মার্টনেস’ বলে বর্ণনাও করা হচ্ছিল। কার্যত কোনো বিরোধী দল-মতকেই তাঁরা দাঁড়াতে দেননি।
ফেসবুকে বিচ্ছিন্নভাবে বিরূপ স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কতজনকে! তাঁদের একজন মোশতাককে মেরেই ফেলা হয় ভয়াবহ নির্যাতন করে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সরকারবিরোধী লিফলেট বিতরণকারী একজন সাবেক পেশাজীবীকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে বসেন তৃণমূলের এক আওয়ামী লীগ নেতা! সরকারবিরোধিতা যেন হয়ে গিয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। সেটাকে এভাবে বর্ণনাও করা হতো সাজানো টক শোতে। এই সব ঘটনায় জনমনে, বিশেষত তরুণমনে কী প্রতিক্রিয়া পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, সেটা বিবেচনা করে দেখার মতো বোধ দ্রুত হারিয়ে গিয়েছিল হাসিনা সরকারের ভেতর থেকে। এই বোধ থাকলে তো কোটা সংস্কারের মতো ইস্যু ঘিরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না, যা সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এটা কিন্তু ছিল অবিশ্বাস্য। ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে পরে এসে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের কাছেও ছিল অবিশ্বাস্য।
আওয়ামী লীগের কঠোর অনুগামী ছাড়া কে এসে যোগ দেয়নি আন্দোলনে? সরকার, বিশেষত সরকারপ্রধানের কথা ও কাজে দীর্ঘদিন ধরে বিরক্ত আর অপমানিত নিরীহ মানুষটিও নেমে এসেছিল রাজপথে। ঘরে ঘরে স্কুলপড়ুয়াদেরও আটকে রাখা যাচ্ছিল না, যারা কোটা বিষয়ে আদৌ অবহিত নয়। তারা নেমে এসেছিল বন্ধু কিংবা বড় কোনো ভাই পুলিশের গুলিতে হতাহত হয়েছে শুনে। পীরগঞ্জের ছেলে আবু সাঈদের আত্মাহুতির মর্যাদা দিতে নেমে এসেছিল রাজধানীর ফাস্টফুড খাওয়া ছেলেমেয়েরা। একটা সরকার কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হলে আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার নামায় আর কুক্ষিগত মিডিয়ায় একশ্রেণির পেশাজীবীকে নামিয়ে দেয় কেবল ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিতে! এ অবস্থায় একটা অনির্বাচিত সরকারকে যারা দীর্ঘদিনেও নামাতে পারেনি, তারা স্বভাবতই বসে থাকেনি। এদের ‘তৃতীয় শক্তি’ বলে অব্যাহত প্রচারও হালে পানি পায়নি তখন। অবশেষে সরকারকে যেতেই হলো অগণিত ছাত্র-জনতার রক্তে হাত রাঙিয়ে।
পদত্যাগ করে নিরাপদে সরে যেতেও অনেক দেরি করছিলেন শেখ হাসিনা। এসব কাহিনি পড়ে এখন বিস্মিত হতে হয়। তোতাপাখির মতো খালি বলা হতো, ‘এ দেশ শ্রীলঙ্কা হবে না’! দেশের অর্থনীতির অবস্থা যে শ্রীলঙ্কার মতোই করে ফেলা হয়েছে, সে বোধও ছিল না তাঁদের। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল শ্রীলঙ্কার চেয়ে খারাপ। ওখানে তো আর যা-ই হোক, ছিল একটা নির্বাচিত সরকার। অপরাধের চেয়ে তাঁরা বেশি করেছিলেন ভুল। তারপরও দুর্দশায় নিপতিত জনতা তাঁদের রেহাই দেয়নি। হাসিনা সরকারের পতনের পর গণভবনে যা যা ঘটেছে, তাতে অনুসৃত হয়েছে শ্রীলঙ্কানদের দৃষ্টান্ত। অনেক ঘটনাই অরুচিকর সন্দেহ নেই; কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের শেষদিকে কে এসব রুখবে! কে রুখবে সরকারের দলীয় ক্যাডারে পরিণত হওয়া পুলিশ বাহিনীর প্রতি নজিরবিহীন গণরোষ? দুই লাখেরও বেশি পুলিশ সদস্যের একটা দল কার্যত পলাতক হয়ে গেল সরকারপ্রধান দেশ থেকে পালানোর সঙ্গে সঙ্গে। জানি না, বিশ্বের কোথাও এমন পরিণতি হয়েছে কি না, কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর। এ অবস্থায় আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণে হয়েছে বিলম্ব। তাতেও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে দেশে। এতে অনেক নিরীহ মানুষও আক্রান্ত হয়েছে বেদনাদায়কভাবে।
আন্দোলনে ভূমিকা রাখা কোনো কোনো গোষ্ঠী এটাকে নিজেদের বিজয় ভেবে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী কর্মকাণ্ডও চালিয়েছে। এসব বেদনাদায়ক ঘটনায় নিন্দা জানানোও এখন কঠিন মনে হচ্ছে! অথচ এটা সহজেই এড়ানো যেত কোটা-প্রশ্নে সহজ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে কোনো উপরচালাকির আশ্রয় না নিলে। আন্দোলনকারীরা সংস্কার চাইলেও বিরক্ত হয়ে বা রাগ করে কোটা একেবারে বাতিল করে দেওয়া; বহুদিন পর তা নিয়ে আবার নতুন খেলায় মেতে ওঠা—এসব কেউ মেনে নেয়নি। অতঃপর গোটা একটা প্রজন্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা এবং ঘোষণা দিয়ে গুণ্ডা নামিয়ে পিটিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিটাই আসলে সূত্রপাত করে সরকার পতনের। পতনের পরও অবশ্য ফিরে আসা যায়। কিন্তু কী বলবেন তাঁরা সেই প্রজন্মকে, যারা বিগত সরকারের আমলে ভোটাধিকার প্রয়োগেরই সুযোগ পায়নি? কী বলে ভোট চাইবেন এমনকি তাদের অভিভাবকদের কাছে? একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে গিয়ে হাসিনা সরকার যে আচরণ করল, সেটা বলতে গেলে বিস্ময়কর। এটা বহুদিন গল্পকাহিনির মতো করে ছড়াবে যাদের বোধবুদ্ধি এখনো হয়নি—তাদের মধ্যেও।
পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর অনুগামী দল আওয়ামী লীগ আজ মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি। রাজনীতিতে ফিরে আসাটা তাঁদের জন্যও কঠিন করে দিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা—যাঁরা বড় কোনো অপরাধে না জড়িয়ে এত দিন দলটা করে আসছিলেন। দলটিকে যাঁরা কেবল ‘আদর্শগত কারণে’ সমর্থন করেন, তাঁরাও এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। সবকিছুর পরও তাঁদের সংখ্যা কি কম? তাঁদের পক্ষেও এখন জাস্টিফাই করা কঠিন যে, কেন দেশে তিন-তিনটি যেনতেন নির্বাচন করা হয়েছিল? গণতন্ত্রের বিনিময়ে উন্নয়ন সামনে এনে অপশাসনকে আড়ালের চেষ্টাও আর হালে পানি পাবে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে দুর্নীতির বিপুল আয়োজনও এখন সবার সামনে আসবে। এ নিয়ে জোরালোভাবে আলোচনাও কঠিন ছিল হাসিনা সরকারের আমলে। সত্য উচ্চারণের দায়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরাও প্রকাশ্যে আক্রান্ত হতেন খোদ শেখ হাসিনা দ্বারা। সে জন্য তিনি অবশ্য পেতেন দল বেঁধে এই সব অনুষ্ঠানে সমবেত চাটুকারদের করতালি।
১৫ আগস্টের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা যেদিন ফিরে এসেছিলেন বিপর্যস্ত দলটির হাল ধরতে, সেই দিনটির কথা নিশ্চয় অনেকের মনে আছে। বৃষ্টির মধ্যে বহু লোক হাজির হয়েছিল কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে। কী অসাধারণ ছিল তাঁর ফিরে আসা! ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসাটাও কী চমৎকার ছিল! এ দেশের মানুষ আরও একবার তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিল বিপুলভাবে জিতিয়ে। তিনি কিংবা তাঁর পরিবার অথবা তাঁর দেশি-বিদেশি উপদেষ্টারা এই মানুষদের ‘অকৃতজ্ঞ’ বলবেন কোন মুখে? অকৃতজ্ঞ তো বরং তিনি; কেননা এ দেশের মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু কেড়ে নিতেও তাঁর বুক কাঁপেনি। মেয়াদের পর মেয়াদ এ পথে চলার পরিণতি নিয়েও ছিল না কোনো উপলব্ধি। ১৭-১৮ কোটি মানুষের একটা দেশ তা কত দিন মেনে নেবে, এটা একবারও ভাবার ফুরসত হলো না!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে