Ajker Patrika

আয়নার আয়নাবাজি

শাকেরা তাসনীম ইরা, ঢাকা
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১১: ১০
আয়নার আয়নাবাজি

রাতে ঘুমানোর আগে দাদি-নানির কাছে গল্প শুনে বড় হওয়া প্রজন্মের ঝুলিতে রয়েছে অনেক রূপকথা। এঁদের প্রায় সবাই হয়তো একবার হলেও শুনেছেন, এক চাষির জীবনে ধানখেতে পাওয়া আয়নার বিড়ম্বনার গল্প। সেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সতিন ভেবে কী দুঃখটাই না পেয়েছিল চাষির স্ত্রী। এই গল্পকে এখনো বাংলার হাসির গল্পগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। তবে বাস্তবে আয়না আবিষ্কারের কাহিনিটা কিন্তু খুব একটা হালকা বা হাসির ঘটনা নয়। আজ যে আয়নায় আমরা নিজেদের অবয়ব দেখি, সেই আয়নার পেছনে রয়েছে কত শত ঘটনা। 

বেশ কিছু প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ ইয়েন হাডার তুরস্কের এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে পাঁচ-ছয়টি অবসিডিয়ান আয়না উদ্ধার করেন। পাথরের এই আয়নাগুলোর প্রতিটিই পাওয়া গিয়েছিল আট হাজার বছর পুরোনো কবরের ভেতরে। সে কবরগুলোর প্রতিটিই ছিল নারীর। মৃতদেহের মাথার কাছে উত্তর দিকে মুখ করে আয়নাগুলো রাখা ছিল। 
ইয়েন হাডারের মতে, প্রাচীনকালে মানুষ আয়নাকে ব্যবহার করত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপকরণ হিসেবে। এ ছাড়া তান্ত্রিকদের মধ্যে নানান যজ্ঞ সাধনার জন্যও আয়না ব্যবহৃত হতো বলে জানা গেছে। 

আমরা এখন যে আয়না ব্যবহার করি, তা রাতারাতি তৈরি হয়ে আসেনি। কাচের আয়না তৈরির আগে মানুষ পাথরের ও তামার আয়না ব্যবহার করত। খ্রিষ্টের জন্মেরও চার হাজার বছর আগে মেসিপটোমিয়ায় তামার আয়নার প্রচলন ছিল। তামার আয়নার ওজন পাথরের আয়নার চেয়ে কম হওয়ায় দ্রুতই এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ধারণা করা হয়, ১৮৩৫ সালে জার্মান বিজ্ঞানী জাস্টাস ফন লিবিগ প্রথম কাচ আবিষ্কার করেন। কিন্তু লিবিগের আবিষ্কৃত কাচের আয়না মূলত আধুনিক আয়নাগুলোর মধ্য়ে অন্যতম একটি। তবে এর আগেও নাকি পৃথিবীতে তৈরি হয়েছিল কাচের আয়না। ইতিহাসবিদেরা ১৩০০ সালে প্রাচীন মিসর, পূর্ব ইউরোপ ও রোমে কাচের আয়নার অস্তিত্ব পাওয়া যায় বলে দাবি করেন। তবে তিন ইঞ্চি উচ্চতার সেসব আয়না খুব একটা মসৃণ ছিল না। এ ছাড়া পেছনের গলিত ধাতব খুব একটা ভালো ছিল না বলে আয়নাগুলো ছিল বেশ অস্পষ্ট। তাই সে সময় কাচের আয়না নির্মিত হওয়ার পরও বেশ অনেক বছর পর্যন্ত ছিল তামার আয়নার বিপুল জনপ্রিয়তা। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে কারিগরেরা নিখুঁত কাচের আয়না তৈরি করা শুরু করলে কমা শুরু করে তামার আয়নার চাহিদা। 

মূলত ১৪০০-এর দশকে ইউরোপীয় পরিবারগুলোতে কাচের আয়নাগুলো ধাতব আয়নার পরিবর্তে ব্যবহৃত হতে শুরু করল। প্রথম দিকের কাচের আয়নাগুলো ইউরোপের বিভিন্ন শহরে এসেছিল ইতালির মুরানো থেকে। ১৩ শতকের দিকে আয়নার কারিগরদের বসবাস ছিল ভেনিস শহরে। ভেনিস  শহর তখন বিখ্যাত হয়েছিল এখানকার আয়না তৈরির কারিগরদের কারণেই। একই সঙ্গে ভেনিস তখন হয়ে উঠেছিল কর্মসংস্থানের অবলম্বনও। নানান জায়গা থেকে মানুষ এসে জমা হতো ভেনিসে। উদ্দেশ্য ছিল কাচের আয়না তৈরি শেখা এবং এর মধ্য দিয়ে নিজের ভাগ্য বদলানো। কারণ, আয়নার কারিগরদের তখন বিবেচনা করা হতো শিল্পী হিসেবে। ইউরোপিয়ানদের কাছে তাঁদের ছিল আলাদা সম্মানও। এমনকি ইউরোপীয় অভিজাতরা তখন ভেনিসের আয়নাশিল্পীদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাকেও খুবই গৌরবের বলে মনে করতেন।

ভেনিসের বিখ্যাত ট্রান্সলুসেন্ট কাচের সূত্র কে নিয়ে এসেছিলেন, অথবা প্রথম আধুনিক আয়না তৈরি করতে কে প্রথমে গলিত ধাতুর মিশ্রণটি প্যানের পেছনে প্রয়োগ করেছিল, তা জানা যায়নি আজ পর্যন্ত। মুরানোতে কাচ প্রস্তুতকারীরা কঠিনভাবে তাদের বাণিজ্যের কৌশল রক্ষা করেছিল। ভেনিস সরকারও আয়না তৈরির প্রক্রিয়া রেখেছিল একেবারেই গোপন। ভেনিসে আয়না বাণিজ্যের গোপনীয়তা ছড়ানোর শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। আর যদি কখনো কোনো আয়নার কারিগর মুরানো শহর ছেড়ে যাওয়ার সাহস করতেন, তবে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে জিম্মি করা হতো তাঁর পরিবারকে। 

এসবের মধ্যে আবার প্রতিযোগিতা চলত কারিগরদের নিজেদের মধ্যেও। আয়নার কারিগরেরা সব সময় তাঁদের আয়নার সৌন্দর্য বাড়ানোর উপায় খুঁজতে থাকতেন। কেউ কেউ তাঁদের কাচে যোগ করতেন সিসা তো আবার কেউ কেউ অন্যরা আয়নার পৃষ্ঠে লাগাতেন সোনার পাত। কেউ আবার যোগ করতেন টিন-পারদের মিশ্রণ। কিন্তু এই উপকরণগুলো দিয়ে কাজ করাটা ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছিল আয়নার কারিগরদের শরীর এবং মনে। বিশেষ করে পারদ ছিল অত্যন্ত বিষাক্ত। পারদের ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়া মানুষজনের আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিডনি, হারাতে থাকে শারীরিক সক্ষমতা। স্মৃতিশক্তি হ্রাস, অনিদ্রা ও বিষণ্নতা, গুরুতর ক্ষেত্রে, প্রলাপ ও হ্যালুসিনেশন–এর সবই দেখা দিয়েছিল ভেনিসের আয়নার কারিগরদের মধ্যে। শুরুর দিকে পারদ দিয়ে অনিরাপদ পরিস্থিতিতে আয়না তৈরি করত তাঁদের অনেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়েছিল। 

ভেনিসিয় কারিগরদের জন্য আয়নার মতো সুন্দর বস্তুটিই দিনে দিনে একটি কদর্য অভিশাপ হয়ে উঠেছিল। কারণ, ১৪ শতকের পর থেকে ইউরোপে আভিজাত্যের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছিল ভেনিসের আয়না। তাই ওই অনিরাপদ কারখানাতেই দিন-রাত আয়না তৈরির কাজ করে যেতে হচ্ছিল কারিগরদের। সরকারি খবরদারি ছিল বলে চাইলেও কাজ ছাড়ার সুযোগ ছিল না তাঁদের। এর পাশাপাশি নিখুঁত কাচের আয়না তৈরির গোপন সূত্র জানা নিয়ে ভেনিসের সঙ্গে লড়াই বেধেছিল ফ্রান্সের মতো দেশেরও। ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা চতুর্দশ কিং লুই ভেনিসিয় আয়নার গোপন সূত্র জানতে ঘোষণা করেছিলেন মোটা অঙ্কের পুরস্কার। 

১৬৬০-এর দিকে চতুর্দশ কিং লুইয়ের অর্থমন্ত্রী জিন-ব্যাপটিস্ট কোলবার্ট সফলভাবে ভেনিসের মুরানো থেকে বেশ কিছু আয়না কারিগরদের ফ্রান্সে সরিয়ে আনতে সফল হয়েছিলেন এবং আরেকটি আয়না তৈরির কারখানা শুরু করেছিলেন। যার ফলে আয়নার বাজারে নাম লিখাতে শুরু করেছিল ফ্রান্সও। কিন্তু ১৬৬৭ সালে, কোলবার্টের কারখানার কারিগরেরা অদ্ভুতভাবে মারা যেতে শুরু করে। এই কারখানায়ও কারিগরেরা ভারী ধাতু এবং বিষাক্ত ধোঁয়া নিয়ে কাজ করছিল। কোলবার্টের কারখানার সেরা দুজন কারিগরের মৃত্যু কারখানাটিকে অচল করে দিয়েছিল। 

আয়নার উন্মুক্ত বাজার তৈরি হয় মূলত প্রথম শিল্প বিপ্লবের সময়টাতে। ১৭৮৪ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত যখন হাতে তৈরির পরিবর্তে মেশিনে উৎপাদন ব্যবস্থার উত্থান ঘটে, তখন অন্য অনেক পণ্যের মতো আয়নার বাজারও সম্প্রসারিত হতে থাকে। ফ্রান্সে সেন্ট-গোবেইন কারখানাটি এ সময় বেশ সস্তায় আয়না বিক্রি করতে শুরু করে বাজারে। শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে তুলনামূলক  উন্নত হয়ে উঠেছিল আয়নার কারখানাগুলোর পরিবেশ। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৈরি হতো বলে আয়না যারা বানাতেন তাদের সরাসরি রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসার হারও কমে এসেছিল। বর্তমান বিশ্ববাজারের একটা বড় অংশ ধরে রেখেছে আয়নার বাজার। একের পর এক শিল্প বিপ্লবের ফলে বিশ্বে গড়ে উঠেছে নিরাপদ এবং স্থিতিশীর আয়নার বাজার একথা ঠিক। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত আয়না তৈরির সূত্র গোপন রাখার এবং আয়না বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যে সহিংস লড়াই চলেছিল তাতে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রাণ দিয়ে গেছেন শত শত আয়নার কারিগরেরা। এর পাশাপাশি অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করার শাস্তিও ভোগ করেছেন নিজেদের জীবন দিয়ে। তাই যেখান থেকে এসেছিল পৃথিবীর প্রথম কাচের আয়না, সেই ভেনিসের মুরানো দ্বীপের আয়নার কারিগরেরা বছরের পর বছর নিজেদের তৈরি আয়নায় দেখে গেছেন নিজেদের অভিশপ্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। 

তথ্যসূত্র: লংরিডস, পাবলিশার্স উইকলি এবং অন্যান্য

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত